Thursday, November 13, 2014

সোভিয়েত দেশ ভ্রমণের স্মৃতিচারণা

সোভিয়েত দেশ ভ্রমণ -জীবনের এক পরম প্রাপ্তি 


প্রায় ত্রিশ বছরের উপর অতিক্রান্ত হলো।  কিন্তু ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রায় তিন সপ্তাহের  সোভিয়েত দেশ ভ্রমণের রমণীয় স্মৃতি আজ  কিছুটা আবছা হলেও এখনও মনের মণিকোঠায়  বেশ উজ্জ্বল হয়ে আছে।  
অফিসের কাজে ১৯৮৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী থেকে ৮ই মার্চ পর্যন্ত  একুশ দিনের  তদানীন্তন অভঙ্গ সোভিয়েত দেশ সফরে   গিয়েছিলাম। গায়ে তকমা ছিল দেশের বিশেষজ্ঞ হিসাবে।  সেজন্যে সমস্ত জায়গাতে খাতির  পেয়েছিলাম অভাবিতভাবে।  নিজেদের দেশের প্রকৌশলগত কাজে ওদেশের বিভিন্ন শহরে নানা কলকারখানা ও গবেষণা কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়েছিলাম।  এরই মধ্যে ওদেশের দূতাবাসের কর্মীদের সৌজন্যে মস্কো ও তদানীন্তন লেনিনগ্রাদ(এখন সেন্ট পিটার্সবার্গ ) শহরের আসে পাশে বেশ কিছু উল্লেখনীয় দ্রষ্টব্য স্থান দেখতে পেরেছিলাম।  সেই সফরে এই সমস্ত কাজের মধ্যেই ওদেশের সাধারণ লোকের তদানীন্তন জীবন  যাপন পদ্ধতি ,তাঁদের সংস্কৃতি ও ছোটখাট নানা ঘটনা  এই ভ্রমণের এক উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে নিয়েছিল।  

        আমাদের কোম্পানির সাথে সোভিয়েত দেশের এক বিশাল প্রতিষ্ঠানের সাথে Technical Collaboration -র  জন্যে প্রতি বছর আমাদের কোম্পানির অনেক সহকর্মীদের  বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষণের জন্যে রাশিয়ার  বিভিন্ন জায়গাতে পাঠানো হত।  আমার নামও ওই তালিকাতে থাকলেও ওই শিক্ষণে আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠে নি।  তবে এইবারের সফরের  শেষে উপলব্ধি করলাম  যে ওদেশে না গেলে জীবনে ওদের সম্বন্ধে জানাশোনা  অনেক বিষয়েই  অসম্পূর্ণ থেকেই যেত।  অনেক কিছু অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা অপূর্ণ থেকে যেত।  বহু বছর বাদে আজও  সেই আনন্দময় ভ্রমণের স্বাদ ভুলতে  পারি নি। তাই এত   বছর বাদে স্মৃতির আবছা ভান্ডার থেকে কিছু কথা সবাইয়ের সাথে ভাগ করে নেবার জন্যে এখানে লিপিবদ্ধ করছি।

 ১৯৮৩ সালের ১৬ই  ফেব্রুয়ারী  আমাদের বিমান যখন মস্কোর সর্ববৃহত বিমান বন্দর সেরেমেতিয়েভো তে অবতরণের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তার বেশ কিছুক্ষণ আগে   থেকেই নিচের দিকে জানলার কাচের  ভিতর দিযে  তাকিয়ে চারপাশে সাদা সাদা বরফের   স্তুপ  ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ছিল না।  ভাবছিলাম, এত বরফের মধ্যে কিভাবে বিমান অবতরণ করবে?  এবারে বিমানের পাইলটের ঘোষণাতে বিমানের অবতরণের কথা জানিয়ে বাইরের তাপমাত্রার কথা যখন শুনলাম -১৯ডিগ্রী সেলসিয়াস ,তখন সারা শরীরের সাথে যেন হাড় অবধি কম্পন অনুভব করলাম।  বিমান থেকে নেমে  বিমান বন্দরের মধ্যে সাত সতের ঝামেলার জন্যে বেশ কিছুক্ষণ কাটাতে হলো।  ওদিকে আমাদের ভারতীয় দূতাবাসের কর্মী সহ আমাদের কোম্পানীর ওখানের কর্ণধার শ্রীযুক্ত রাম মোহন রাওকে  দেখে মনে বল পেলাম। আমার সঙ্গে সহকর্মী তেজবাহাদুর সিং এবং কেরালার সরকারী নিগমের উচ্চপদস্থ অফিসার শ্রী নায়ার ও তাঁর অধস্তন  কর্মচারী শ্রী রাজন ছিলেন।  সমস্ত ঝামেলা কাটিয়ে প্রায় দৌড়ে সামনে রাখা বাসে উঠে একটু ধাতস্থ হলাম। হাজির হলাম মস্কোর বিশাল হোটেল ইউক্রেনাতে।  হোটেলের নিয়মকানুন সেরে আমি আর তেজবাহাদুর বেশ উঁচু তলায়  আমাদের দ্বিশয্যা বিশিষ্ট ঘরে ঢুকে গায়ের সমস্ত   জোব্বা খুলে  হালকা কিছু পরে যখন ঘরে সুস্থির হয়ে বসলাম তখন একটু স্বস্তি পেলাম। গরম রাখা ঘরে বাইরের অতিশীতল আবহাওয়ার কোনো চিহ্ন নেই।  বেশ ক্লান্ত হয়েছিলাম এই লম্বা বিমান সফরে  ,তাই বিছানাতে শুতেই নিদ্রার কোলে  ঢলে  পরলাম।

      গত রাত্রে বিদায় নেবার আগে শ্রীযুক্ত রাও আমাদের সকালের প্রাতরাশ হোটেলের ভিতরেই সেরে প্রস্তুত থাকতে বলে গিয়েছিলেন। উনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ভারতীয় দূতাবাসে  গিয়ে  এখানের উপযুক্ত শীতের গরম পোশাক  যোগাড় করে দেবেন। আমরা সকালে উঠেই স্নান করে,দাড়ি কেটে প্রাতরাশের জন্যে এখানের তত্ত্বাবধাযকা বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা  করলাম। উনি আমাদের দেখিয়ে দিলেন প্রাতরাশের জায়গা।  এই ছোট  খাওয়ার জায়গাগুলিকে বলা হয় 'স্তলোবায়া।'  এখানে গিয়ে বেশ ভিড় দেখলাম। ওখানে নানা ধরনের পাউরুটি ,বিস্কুট (পদস্থ নয়) , লম্বা লম্বা ধরনের মাংস ভরা  জিনিস গরম জলের ভিতর রয়েছে (কালবাসা) , ফল, এক ধরনের নোনতা স্বাদের ক্রিম ( নাম স্মিতানা ), এক রকমের ঘোল (যার নাম কিফির) পাওয়া যায়।  যা যা খেতে ইচ্ছে  প্লেটের উপর নিয়ে কাউন্টারে গিয়ে দাম মিটিয়ে খাওয়া শুরু করতে হয়।  এগুলোর দাম বেশ সস্তা।  মোটামুটি এক রুবলেই প্রাতরাশ ভালো ভাবে হয়ে যায়।  আমরা আগের রাত্রেই হোটেলে নিজেদের রুমে আসার আগেই আমাদের ভারতীয় টাকাকে রুবলে পরিবর্তিত করে নিয়েছিলাম হোটেলের নিচের ব্যাংক  কাউন্টার থেকে। আমাদের ভারত থেকে আসার সময় ভারতীয় টাকা প্রতিদিন হিসাবে এবং মোট কিছু ডলার দিয়ে দিয়েছিল।  তখন এখানে এক রুবলের দাম ছিল ১৪ টাকা আর এক ডলারের দাম ছিল ১২ টাকা। তবুও চোরা  পথে অনেকেই ডলার কিনতে চাইত ভারতীয়দের কাছ থেকে। আমরা যদিও সে পথে যাই নি।  ওখানে কোনো কিছু কিনলে বা ভালো কথা বলে একটা ধন্যবাদ  রেওয়াজ আছে,  রাশিয়ানে বলে 'স্পাসিবা';আমরাও শিখে গিয়েছিলাম প্রথম থেকেই এবং সুযোগ পেলেই সবাইকে বলতাম। সবাই খুব খুশি হত।

    প্রাতরাশ সেরে নিচের লাউঞ্জে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর শ্রী রাও আর একজন সঙ্গীকে নিয়ে হাজির হলেন আমাদের হোটেলে। রাশিয়া সফর শুরু হয়ে গেল।  বাইরে বেরিয়েই মনে হলো সমস্ত কিছু জমে যাবে, এত ঠান্ডা বাইরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতীয় দূতাবাসে হাজির  হলাম।  শ্রী রাওয়ের সঙ্গী আমাদের  সবাইকে নিয়ে একটি ঘরে নিয়ে গেল, সেখানে বিভিন্ন  ওভারকোট ,হাতের দস্তানা ,গলার মাফলার ও মাথার লোময়ালা গরম টুপি রয়েছে। আমরা সবাই নিজেদের মাপ ও পছন্দ অনুযায়ী সমস্ত গরম পোশাকের সম্ভার নিয়ে সেগুলি পরে  ফেললাম ওই সঙ্গীটির সাহায্য নিয়ে। এগুলো সবই চাপানো হলো দেশ থেকে আনা আমাদের সমস্ত জামা কাপড় ও গরম পোশাকের উপরে। তখন আয়নাতে আমাদের সকলেরই  চেহারা  কিম্ভুতকিমাকার  দেখাচ্ছিল। দূতাবাসে শ্রী রাওয়ের ঘরে আর এক কাপ কফি খেয়ে আমরা এবারে ওই সঙ্গীটির সঙ্গে বেরিয়ে  পরলাম।  এবারে বাইরে বেরিয়ে আর অত শীত লাগছিল না ,বরং বরফের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে বেশ ভালো লাগছিল। সেদিন সঙ্গীটি আমাদের প্রথমেই ওদের এক বৈদ্যুতিক ও অন্যান্য সরঞ্জামের দোকানে নিয়ে গেল।   বৈদ্যুতিক সরঞ্জামগুলি দেখনসই না হলেও  মজবুত ও টেঁকসই।  সেটার  প্রমাণ  পরে পেয়েছিলাম। ওখান থেকে বেশ কিছু বিদ্যুতিক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে সমস্ত লটবহর নিয়ে হোটেলেই ফিরে এলাম। এটাই হলো প্রথম দিনের মুখ্য সফর সূচী। দুপুরের খাওয়া দাওয়া আমাদের দূতাবাসের কর্মীটি এক
 রেস্টুরাঁন্তে  নিয়ে গিয়ে  খাইয়ে  দিয়েছিল।  এখানে নিরামিষাসী লোকেদের খাবার খাবারের দোকানে পাওয়া একটু ঝকমারি। আমাদের সঙ্গী তেজ বাহাদুরকে   নিয়ে এই সফরের সর্বত্র এজন্যে খুব ঝামেলা ভোগ করতে হয়েছিল।

 বিকেলের দিকে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার সেই সব গরম পোশাক চাপিয়ে বেরোতে হলো।  আমাদের হোটেলের   ঠিক পাশেই   মস্কোর সব চেয়ে বড় নদী মস্কয়া।  এই প্রচন্ড শীতে জমে শক্ত বরফে  পরিণত হয়েছে। সে এক মজার দৃশ্য।  ছেলে,মেয়ে,যুবক ও বয়স্করা ওখান দিয়ে সাইকেল,গাড়ি চালাচ্ছে অবলীলাক্রমে। কেউ কেউ স্কেটিং করছে ওর  উপরে। কাতারে কাতারে লোক উপরের রেলিং দিয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করছে। এখান থেকে কাছেই কিছু আলো ঝলমলে দোকান পত্র বাইরে থেকে দেখলাম। এখানে অল্পস্বল্প রাশিয়ান ভাষা না জানলে খুবই অসুবিধার। বেশির ভাগ লোক  ইংরাজি বোঝে না।  তার উপরে দোকান পাট ,অফিস, নানা রকম জিনিসের সম্ভার কেনাকাটা করা খুবই মুস্কিল। এখানে সব জায়গাতে সব কিছু রাশিয়ান ভাষায়  লেখা। রাশিয়ান ভাষার অনেক হরফ দেখলে ইংরাজির মতন দেখায়, কিন্তু সেগুলোর উচ্চারণ ভিন্ন। আমি দেশে থাকতে আমাদের অফিসে রাশিয়ান বিশেষজ্ঞদের সাথে ওদের শুনে শুনে কিছু কিছু ভাঙা  ভাঙ্গা কাজ চালানোর মতন রাশিয়ান শিখেছিলাম, তা ছাড়া রাশিয়ান হরফ টা বেশ আয়ত্ত করে গিয়েছিলাম।  এ ছাড়া  আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে রাশিয়া থেকে ইংরাজি ও ইংরাজি থেকে কিছু সাধারণ কথোপকথনের  একটি বই নিয়ে গিয়েছিলাম।  ফলে সারা সফরে একা একা অনেক সময় বেরোলেও কখনও আমাকে বিশেষ অসুবিধাতে পড়তে হয় নি।  তেজবাহাদুর আগে একবার ট্রেনিং নিতে  রাশিয়াতে  গিয়েছিল,সেজন্যে ও অল্প  কিছু বলতে ও বুঝতে পারত।  কিন্তু কেরালার সরকারী নিগমের দুই বন্ধু আমাদের নায়ার সাহেব ও রাজনের খুবই  অসুবিধা হয়েছিল।

 দু চারদিন ওই লটবহর গরম ভারী পোশাকের বোঝা নিয়ে ঘোরাফেরা করে বেশ কাঁধে ব্যথা হয়েছিল। ওখানে আমাদের পুরোপুরি  সফরসূচী তৈরী করতে ওদের মূল অফিসে একটি  মিটিঙের  ব্যবস্থা করতে বেশ দেরী হচ্ছিল। সেই সময় মনের সুখে একা একা এবং সবাই মিলে  একজন দোভাষীর সাথে খুব ঘুরে নানা দোকান পত্র,কিছু কিছু বেড়ানোর জায়গা দেখে নিয়েছিলাম।  এই সময়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করে খুব অবাক হয়েছিলাম। এখানে সমস্ত জায়গাতে মহিলারাই কাজ করে চলেছে।  ট্রাম,বাস,মেট্রো ,ভারী ভারী ট্রাক  সব কিছুই চালাচ্ছে বিভিন্ন বয়সের নারীকর্মী। বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে অবিরাম কাজ করে চলেছে মহিলারা। হোটেল,রেস্তোরার সমস্ত কাজে রয়েছে মহিলারা।  রাস্তার বরফ রাত ভর  পরিস্কার করছে মহিলা কর্মীরা অনলস ভাবে। কাউকে কোনো জায়গাতে কাজে  ফাঁকি দিয়ে গাল গল্প করতে চোখে পড়ে নি।  এক এক সময় দেখে মনে হয়েছে যেন দেশটা মেয়েরাই চালাচ্ছে। পুরুষ কর্মীর দেখা পাওয়া ভার।  এখানে সমস্ত পুরুষ ও মহিলাদের কাজ করা সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক। তবে সবচেয়ে অবাক করেছে এখানে মা,দিদিমার  বয়সী বৃদ্ধ মহিলাদের ব্যবহার ও কর্মনিষ্ঠা দেখে। বারে বারে শ্রদ্ধায় মাথা  নত হয়ে এসেছে এদের দেখে।

 এই প্রসঙ্গে দুটি ঘটনার কথা বলতেই হয়,যা আজও আমার চোখের সামনে উজ্জ্বল ভাবে ভাসে।  প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল  আমাদের কোম্পানির সাথে রাশিয়ার প্রধান সংযোগকারী অফিস " TIAJPROMEXPORT" -র সদর দপ্তরে। শ্রী রামমোহন রাওয়ের সাথে আমরা চারজন ওই   অফিসে রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গাতে আমাদের কর্মসূচী নির্ধারণে গিয়েছিলাম। ওখানে প্রতিটি অফিসে প্রবেশের মুখে আমাদের সমস্ত গরম পোশাক ওখানে কর্মরত মহিলার হাতে জমা দিয়ে  ঢুকতে হত।  এখানেই আমার মায়ের বয়সী এক মহিলার হাতে গরম পোশাকগুলি  দিয়ে  টিকিট নিয়ে ভিতরে গিয়েছিলাম। আলোচনা শেষ হবার পরে ওই জায়গাতে এসে ভদ্রমহিলার হাত থেকে পোশাক গুলি নিয়ে যখন পড়বার চেষ্টা করছিলাম ,উনি আমার অসুবিধা দেখে ঠিক আমার মায়ের মত করে সস্নেহে রাশিয়ানে বলে উঠলেন, বাছা  তোমাকে ওগুলো পরিয়ে  দেব।  পুরো কথা না বুঝলেও ভাবভঙ্গী থেকে ব্যাপারটা বুঝেই মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালাম। এক গাল হেসে ওই ভদ্রমহিলা  প্রথমে মাফলার টাকে কায়দা করে এমন ভাবে মাথার উপর থেকে গলা পর্যন্ত জড়িয়ে দিয়ে ওখানে  টুপি  চাপা দিয়ে দিলেন ,আমি তো অবাক।  তারপরে ওভারকোট ও দস্তানা পরিয়ে দিয়ে স্বস্তি  পেলেন।  আমি তো হতভম্ব, মুখ দিয়ে ধন্যবাদ দেবার  বেরোচ্ছিল না।  ঠিক যেন আমার মা  আমাকে সাজিয়ে দিলেন। ওকে রাশিয়ানে 'স্পাসিবা অর্থাত ধন্যবাদ' ছাড়া আর কোনো কথা জানা ছিল না।  কিন্তু বয়স্ক   লোকেদের কাছ থেকে এরকম মায়ামমতাপূর্ণ ব্যবহার ইউরোপের  অন্য  কোথাও দেখি নি।
 এবারে দ্বিতীয় ঘটনাটির কথা বলি।  এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমি।  একদিন দুপুরে  হোটেলের  স্তলোবায়াতে কিছু খেতে গিয়েছিলাম। একজন অতিবৃদ্ধাকে ওখানের ঝাড়পোছ  করতে দেখেছিলাম। হঠাত ওখানে একটি অল্পবয়সী মাতাল যুবকের  আবির্ভাব। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বেহুশ অবস্থায় টেবিলের উপর দুর্গন্ধময় বমি করে ফেলল।  স্তলোবায়ার কর্মী এবং অন্যান্যেরা ওই যুবককে এই মারে তো সেই মারে। হঠাত দেখি সেই বৃদ্ধা ছেলেটির মাথা নিজের কোলের মধ্যে নিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে মৃদুস্বরে বলতে শুরু করে  দিল,এই ভাবে চললে তুমি কদিন বাঁচবে? তারপরে তাকে পরিস্কার করে স্তলোবায়া থেকে ধরে ধরে বাইরে নিয়ে  গেল।  ফিরে এসে সেই দুর্গন্ধময় বমি বিনা বাক্যব্যয়ে পরিস্কার করলো, মেঝে সাফ করে দিল।  এরকম মমতাময়ী মূর্তি আমাদের দেশেও  বিরল।
বহু সময়ে একলা ঘুরতে বেরোলে রাস্তাঘাটে কোনো কিছু ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা  করতে হলে সামনে কোনো বয়স্কা মহিলাকেই প্রশ্ন করতাম।  দু চার কলি রাশিয়ানে কথা বলতে পারলে ঐসব মহিলারা একগাল হেসে আমার প্রশ্নের জবাব তো দিতেনই এবং তার সঙ্গে আরও অনেক কথা গড়গড়  করে বলে যেতেন , যার  অনেক কিছু   রাশিয়ান ভাষাতে পটু না থাকার জন্যে বুঝতে পারতাম না।  তবে তাঁদের আন্তরিক ও মমতাময় ব্যবহারে স্পাসিবা অর্থাত ধন্যবাদ বলে সরে পরতাম।
এই সব  ঘটনা দেখে আমার দৃঢ় ধারনা হয়েছিল যে সত্যি এককালে নিশ্চয় এই সোভিয়েত ভূখন্ড আমাদের দেশের সাথে যুক্ত ছিল, এবং সেজন্যে আমাদের বেশ কিছু সংস্কারের সঙ্গে এদের বেশ গভীর মিল আছে।

     মস্কোতে আমরা বেশিদিন ছিলাম না, কারণ আমাদের কর্মসূচীতে মস্কোর কোনো কল কারখানাতে আমাদের কোনো প্রযোজন ছিল না।  আমরা রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত শহর লেনিনগ্রাদে (বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবার্গ নামে পরিচিত) সবচেয়ে বেশিদিন  ছিলাম।  ওখানে অফিসের কাজকর্মের মধ্যে সময় ও সুযোগ পেলেই একা একাই চারিদিকে বাসে ও মেট্রোতে অবাধে ঘুরে বেড়াতাম।  তবে মস্কো এবং লেনিনগ্রাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে ওখানের বাসে,ট্রামে এবং মেট্রোতে  লোকের উপছে পরা ভিড় আমাকে আমার শহর কলকাতার কথা বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছে। বাসের এমন ভিড় অনেক সময় কলকাতাকেও হার মানিয়েছে। একদিন তো ভিড়ের চাপ এত অসহ্য হয়েছিল যে, মাঝপথে বাস থেকে নেমে পড়তে  হয়েছিল। বাকি রাস্তা হেঁটে গিয়ে কাজ সেরে ফেরার পথে সারা রাস্তা হেঁটেই হোটেলে ফিরেছিলাম। কিন্তু এত ভিড়ের মধ্যেও সবাইকে সুশৃঙ্খল ভাবে যাতায়াত করতে দেখেছি। বাস চালিকা একজন শক্তসমর্থ মহিলা। স্টপেজ এলেই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে বাসের  বায়ু নিরোধক দরজা খুলে দেওয়া এবং যাত্রীদের ওঠানামা ভালোভাবে শেষ হলেই আবার যন্ত্রের সাহায্যে দরজা বন্ধ করে বাস চালনা খুবই দক্ষতার সঙ্গে করছেন এই মহিলা। বাসে কোনো কন্ডাক্টর নেই টিকিট কাটবার জন্যে। বাসের ঢোকার প্রান্তে একটি  টিকিটের রোল রাখা আছে।  বাসের ভাড়া  ৪ কোপেক সমস্ত দূরত্বের জন্যে। এখানে ট্রাম, বাস ও মেট্রোতে এই ধরনের ভাড়ার ব্যবস্থা সারা রাশিয়াতে। লোকেরা বাসে উঠে এক টুকরো টিকিট ওই রোল থেকে ছিড়ে নিয়ে চার কোপেক  ওর  পাশে রাখা একটি বাক্সে ফেলে দিচ্ছে। যারা ওই রোল থেকে অনেক দূরত্বে  দাঁড়িয়ে  আছে ,তারা সামনের লোকেদের রিলের মাধ্যমে চার কোপেক দিয়ে দিচ্ছে আবার সেই লোকেরা  একই ভাবে ওই লোকটিকে টিকিটের টুকরো ফেরত দিচ্ছে। কেউ এদিকে নজর দেবার জন্যে না থাকলেও  কেউ কিন্তু ফাঁকি দিয়ে টিকিট না কেটে বাস থেকে নামছে না।  এটা ওদের চরিত্রে ঢুকে গেছে। এর জন্যে কাউকে পুলিশী করতে হয় না।  দেখে ভালো লেগেছে আর নিজেদের দেশের  স্বভাবগুলোর কথা মনে করে লজ্জিত হয়েছি।

   এখানে লোকেদের বই পড়ার প্রতি অনুরাগ দেখে মুগ্ধ হয়েছি আর এতেই এদের  সমৃদ্ধ সংস্কৃতির পরিচয় পেয়েছি। ট্রাম,বাস,মেট্রোতে যেখানেই গেছি, ওই অত   ভিড়ের  মধ্যেও লোকে বসে ,দাঁড়িয়ে নানা ধরনের বই,পত্র পত্রিকা পড়েই  চলেছে। অল্প বয়সীদের মধ্যে কাউকে কাউকে হাসি গল্প করতে দেখলেও বেশির ভাগ লোকই  বই পড়াতে গভীরভাবে  মগ্ন।  বিশ্বের বোধ হয় সব  থেকে বেশি বই প্রকাশ হয় এই  দেশ থেকেই। বইয়ের দোকানের সামনে দীর্ঘ জনতার লাইন বই কিনবার জন্যে। ওখানে কোনো বইয়ের প্রথম প্রকাশনার সমস্ত কপি নি:শেষিত হলে আর বই পাওয়া যায় না।  আমার নিজের দু একটি টেকনিক্যাল  বইয়ের প্রয়োজন ছিল, ওখানের দূতাবাসের বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে কোনো লাভ হয় নি।  এখানে বিশ্বখ্যাত অনেক লাইব্রেরী আছে মস্কো সহ বিভিন্ন প্রদেশে।  মস্কোতে একটি বিশাল বাড়ি আছে যেটি  আমাদের ইউক্রেনা হোটেল থেকে সামনের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে।  বাড়িটির নাম ' Dom kniga ' অর্থাত বই বাড়ি।  ওখানে যাওয়ার অনুমতি ও সময় পাওয়া যায় নি বলে  ওর ভিতরের কান্ড কারখানা দেখে উঠতে  পারি নি।

    এখানে অনেক জিনিস দেখেই অবাক হয়েছি। মস্কো সহ পরের দিকে বিভিন্ন ছোট বড় শহরে যে কোনো ধরনের দোকান থেকে যখন কোনো ছোট,বড়  জিনিস কিনেছি ,সব জায়গাতেই এক দাম দেখেছি। বড় মল এবং ছোট রাস্তার ধারের মনোহারী দোকানে এক দাম।  প্রত্যেকটি জিনিসের গায়ে দাম লেখা থাকবেই সে যত ছোটখাট জিনিস  হোক।  আমার কাছে এত বছর পরেও ওখানে কেনা  একটা ছোট মাপার টেপ রয়েছে । দেখতে খুবই সাধারণ ,আমাদের এখানে অনেক ভালো জিনিস পাওয়া যায়. কিন্তু এক জায়গাতে এখনও সেই দামের  ছাপ অমলিন হয়ে রয়ে গেছে।  এটাও একটা বড় ধরনের  ভালো নিয়মের প্রাপ্তি।

 ওখানে গিয়ে যে জিনিসটা বারে বারে চোখে পড়েছে সেটা হলো ওদেশের  মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ ,দেশের প্রতি গভীর অনুরাগ, নিয়মানুবর্তিতা আর কাজের প্রতি নিষ্ঠা।  এই সবগুলোই একটা জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।  এই গুণাবলীর  সব কটারই  বিশেষ অভাব আমাদের দেশের সার্বিক জনমানসে।  আগেই বলেছি যে ওদেশে তখন এক রুবলের দাম ডলারের থেকে বেশি ছিল টাকার হিসাবে। তবুও ওখানে ডলারের চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। আসলে ওদের বড় বড়  হোটেল ও বিশেষ কিছু দোকান ছিল ডলার শপ,  খুব দামী এবং বিদেশী ও সুন্দর সুন্দর জিনিস পাওয়া যেত শুধু ডলার দিয়ে। আমাদের হটেলেও এরকম একটি  ডলার শপ ছিল উপরের তলায়।  সেখানে খুব সুন্দর নানা ধরনের পোশাক ,সাজগোজের জিনিস ও অন্যান্য সামগ্রী দেখেছি প্রশংসনীয় চোখে। কিন্তু অস্বাভাবিক দামের জন্যে কিছু কিনে উঠতে পারি নি।  শুধু কিছু সুন্দর সুন্দর পুতুল দেখে যাওয়ার আগে ডলার কতটা হাতে থাকে তার উপর নির্ভর করে ওখান থেকে  কয়েকটি পুতুল গিন্নীর জন্যে নিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল।  সৌখিন পুতুলের প্রতি গিন্নীর একটু দুর্বলতা ছিল।  এই ডলার শপের  কেনাকাটা নিয়ে পরে আরও বিস্তারিত লিখব।

এদেশের সাধারণ লোকেদের দেশের প্রতি অনুরাগ ও দেশাত্মবোধ দেখে বারে বারে মুগ্ধ হয়েছি। কত স্বল্পেতে এরা খুশি, এই বলে  যে এটা   আমার  দেশের তৈরী জিনিস। একটা ছোট ঘটনার কথা বলি।  একবার ডলার শপে একটি জাপানী প্যানাসনিক  পকেট  ট্র্যানসিস্টর কিনি।  একটি অনুরূপ সেট  অন্য  অনেক ডলার শপে না পাওয়ায় আমি এমনি দোকানে ওই জিনিসটা খুঁজতে যাই।  এরকম একটি দোকানে ঢুকে একজন মহিলা কর্মচারীকে জাপানী ঐরকম সেটের কথা জিজ্ঞাসা  করলে ও সেটি নেই বলে  বিরক্তি প্রকাশ করে।  এবারে আমি ওই দোকানের অন্য একটি জিনিসের দাম জিজ্ঞাসা করতে গেলে সে আমায় সটান বলে দেয়  যে ওটা তো জাপানী নয়, তবে তুমি  জেনে কি করবে! বুঝলাম যে সব ছেড়ে  আমি যে জাপানী জিনিসের কথা প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম তাতেই ওঁর দেশপ্রেমে আঘাত লেগেছে. সত্যি বলতে গেলে ওই কর্মচারীটি সেদিন আমাকে কোনো কিছু আর দেখাতে রাজী হলো না।  ওদের ওখানের ফ্রিজ ,গাড়ি ও নিত্য প্রয়োজনীয়  অনেক জিনিস দেখতে  ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মত সৌখীন এবং উতকৃষ্ট মানের  না  হলেও,ওরা কিন্তু সেগুলি ব্যবহার করেই খুশি থাকত  এবং সেই নিয়ে কোনো বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখি নি প্রকাশ্যে। এতে কিছুটা হলেও ওদের  এই দেশপ্রেম  এবং দেশে তৈরি জিনিসের প্রতি আকর্ষণ  বেশ ভালো লাগত। ওখানের অনেক জিনিস বিশেষ করে বৈদ্যুতিক সামগ্রী  দেখতে আমাদের দেশে পাওয়া অনুরূপ সামগ্রীর মত  সুদর্শন না লাগলেও কিন্তু অনেক বেশি কার্যকরী ও  টেঁকসই।  ওখান থেকে আনা ছোট Immersion Heater, Hotplate, Electric Steam Iron ,Small Portable Projector  বহুদিন হয়ে   দিয়েছে। দু একটি আজও ভালই কাজ করছে এত বছর পরে।

    আমাদের দেশে কোনো সুঅভ্যাসের  কথা উঠলেই নানা রকম সরকারী ও বেসরকারী বিজ্ঞাপন দিয়ে বহু অর্থ ব্যয় করেও আমাদের মধ্যে সে বিষয়ে সচেতনতা আনা খুবই মুস্কিল, কিছু সময়ে অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হয়।  কিন্তু ওদের ওখানে যেমনি  সরকারী প্রশাসনের চারিদিকে নজর আছে, তার সাথে দেশের সাধারণ নাগরিকদের সমস্ত সুঅভ্যাস পালনে সচেতন হতে দেখেছি সর্বত্র। ওখানে বড় ছোট কোনো শহরে রাস্তাতে বেরোলেই কিছু দূর অন্তর অন্তর নানা  মনিষীদের আবক্ষ মূর্তি বেদীর উপর বসা বা দাঁড়ানো   অবস্থায় দেখেছি। এগুলো সব জায়গাতে যে আবরণ দিয়ে ঢাকা তা নয়, কিন্তু সমস্ত মূর্তি প্রতিনিয়ত সরকার কিংবা জনসাধারণের পক্ষ থেকে পরিস্কার রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়।  একদিন রাস্তাতে ঘুরে বেড়াবার সময় আমি একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে একটি মূর্তির বেদী পরিস্কার করতে দেঝেছিলাম।
আরও একটি ব্যাপারে খুবই নজর পরেছিল ওদের সচেতনার ব্যাপারে।   ওখানে রাস্তাতে যেখানে  সেখানে  ময়লা ফেলা  অপরাধ বলে গণ্য  করা হয়।  এজন্যে রাস্তাতে কিছুদূর অন্তর ডাস্টবিন রাখা আছে শহরের সর্বত্র।  বাচ্চা থেকে বুড়ো  সমস্ত বয়সের লোকজন  নিজেদের হাতের ময়লা ডাস্টবিনে ফেলা   একটা আশু কর্তব্য বলে বদ্ধ ধারনা  করে নিয়েছে নিজেদের  মনে।  এখানে এত শীতের মধ্যেও  বাচ্চা,বুড়ো  সব বয়সের লোকেদের খুব আইসক্রিম খেতে দেখেছি।  আইসক্রিম খাবার পরে   যতক্ষণ না কাছের ডাস্টবিন নজরে না  আসে,ততক্ষণ ব্যাগের মধ্যে আইসক্রিম কাপগুলিকে  রেখে দিতে দেখেছি। ডাস্টবিনে ফেলে তবে শান্তি!

     ওখানে প্রচন্ড শীতের জন্যে বহু প্রদেশে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস উত্পাদন হয় না, এর মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় সব্জিপাতি  ও ফলের সম্ভার অন্তর্ভুক্ত। এগুলিকে অন্য প্রদেশ থেকে আমদানী করতে হয়. সেজন্যে যখন তখন অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি  দেখা যায় বিভিন্ন  ছোট শহরের বিভিন্ন প্রান্তে।  এজন্যে এখানের গিন্নীদের সব সময়ে হাতে দু একটি ব্যাগ ঝোলানো থাকে, যদি কথাও কোনো জিনিস সুবিধামত পাওয়া যায় , তাহলে লাইন দিয়ে কিনে নিয়ে যাবে।  ওদের দেশে সব ব্যাপারে লাইন দেওয়া একটি প্রচলিত  রীতি।  এই নিয়ে ওদের মধ্যে কোনো অসন্তোষ নেই, কিংবা অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পরে জিনিস ফুরিয়ে গেলে  সেই নিয়ে কোনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে না।  ভাবখানা এই ,ঠিক আছে, আজ ফুরিয়েছে, আবার এলে চেষ্টা চালাব।  এই নিয়ে ওখানের হোস্টেলে  ট্রেনিং রত ভারতীয় ছেলেদের কাছে এক মজার গল্প শুনেছি।  একবার এরূপ একটি হোস্টেলের কিছু ছেলে একটি দোকানের সামনে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে পরেছিল  ,তারপরে পিছনে পিছনে লাইন পড়ে গেল এই  ভেবে,কিছু নিশ্চয় দেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে ওই হোস্টেলের ছেলেগুলি এক এক করে লাইন থেকে সরে পড়ল।  লাইনের লোকেরা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপরে বিমর্ষ মুখে বাড়ি ফিরে গেল।  চিন্তা করা  যায়,এখানে এরকম হলে কি ঘটনা ঘটতে পারে !

মস্কোতে যাওয়ার দু চারদিনের মধ্যেই ওখানের  জগত বিখ্যাত মেট্রো স্টেশন দেখতে গেলাম সহকর্মী তেজ বাহাদুরের  সঙ্গে। লন্ডনের টিউব রেল এবং   রাশিয়ার মেট্রোর সাথে  পাল্লা দেবার মত দ্রুত পরিবহব ব্যবস্থা বোধহয় বিশ্বের আর কোথাও  নেই।  প্রথম মেট্রো দর্শনেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।  এখানে মেট্রোতে ভ্রমনের  জন্যে যে কোনো দূরত্বের জন্যে ভাড়া  মাত্র পাঁচ  কোপেক।  সেজন্যে প্রত্যেক স্টেসনে ঢোকার মুখেই বেশ কয়েকটি মেশিন রয়েছে যেখানে ১৫/২০/২৫ কোপেকের মুদ্রা ফেললেই নির্দিষ্ট  সংখ্যক পাঁচ কোপেকের মুদ্রা বেরিয়ে আসবে। এবারে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়াতে হবে।  ওখানে নিজের লাইন এলে,টিকিট পাঞ্চ  করলেই একটা লম্বা রডের মত বাধা সরে যাবে এবং মেট্রোর চলমান সিঁড়িতে   প্রবেশের সুবিধা পেয়ে যাবে। আমাদের দেশের মত কেউ যদি ফাঁকি দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে তবে ওই  লোহার ডান্ডা তার পায়ে জোরে মারবে যে তার আর ওঠার ক্ষমতা থাকবে না।  যদিও আমি কোনো লোককে এরকম কাজ করতে দেখি নি।  এর পরে এই চলমান সিঁড়ি দিয়ে  এক এক জায়গাতে  অনন্ত ভাবে নীচে নেমে যাওয়া এবং মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া। স্টেসনের   চারিদিকে প্রচন্ড ভিড় ও ব্যস্ততা। প্রত্যেক মেট্রো স্টেশন এক একটি অপূর্ব স্থাপত্যের নিদর্শন।  চারিদিকে ঝকঝকে তকতকে।  প্রত্যেক স্টেশনেই দুদিক দিয়েই এক মিনিট অন্তর  ট্রেন আসা যাওয়া করছে। সুতরাং কোনো  হুড়োহুড়ি করার প্রয়োজন নেই। শুনলাম,যে এখানে ট্রেন আসা যাওয়ার সময়ানুবর্তিতা থেকে ঘড়ি মিলিয়ে   নেওয়া যায়।  ঘড়ির কাঁটা  ঠিক ঘুরে এক মিনিটে এলেই দুদিক থেকে ট্রেন এসে স্টেসনে ঢুকছে। মস্কোর মেট্রোতে  তখন তিন স্তরে ট্রেন চলাচল করত।  সংযোগ কারী   স্টেসনে  এসে পরের স্তরে নিজের জায়গাতে সহজেই চলে যাওয়া যায়।  রাশিয়ান ভাষা টা  জানার জন্যে  দুএকদিন পরে  আমি যেদিক সেদিকে চলে গিয়ে ঘুরে আসতে পারতাম আমার নিজের মূল স্টেসনে।  এখানেও এই মেট্রো চলাচল ও নিয়ন্ত্রণ সবই মহিলাদের অধীনে চলছিল দেখেছিলাম। একবার আমি কিছু জিনিস কিনে স্টেসনের  বেঞ্চে  ফেলে রেখে  এসেছিলাম। দুটো স্টেসন পরেই সেটা খেয়াল হওয়াতে তখনি উল্টোদিকের ট্রেনে চেপে আবার নিজের স্টেসনে  ফিরে এসে দেখি ,আমার জিনিস যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে  আছে ,কেউ হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখে নি।  তবে মস্কো শহরের মত রমরমা লেনিনগ্রাদ শহরের মেট্রোতে দেখিনি।  এখানে প্রতিটি ট্রেনে প্রচন্ড ভিড় ,প্রতি স্টেসনে   অনেক লোক নামছে আবার সমসংখ্যক লোকে ট্রেনে উঠে আসছে। কিন্তু কোনো ঠেলাঠেলি বা কোনো বিশৃঙ্খলা নেই কোথাও।  যে যার জায়গাতে বসে বা দাঁড়িয়ে বই,পত্র পত্রিকা পড়েই  এই যাত্রাপথ অতিবাহিত করছে।  আমাদের কলকাতা মেট্রো এই রাশিয়ান নকশাতে তৈরী ,কিন্তু তার আজ যে হতদশা সে  কথা ভুক্তভোগীমাত্রই  সবাই জানে। আর মেট্রো স্টেসনকে  পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কথা না বলাই ভালো।   মস্কো শহরের মেট্রো নেটয়ার্ক যে কতদিকে বিস্তৃত তা বলে বোঝানো যাবে না।   প্রতিটি  লাইন আবার প্রতিনিয়ত দূর থেকে দূরান্তরে  বিস্তৃত করা হচ্ছে। এতে করে শহর থেকে বহুদূর বসবাসকারী জনসাধারণ সহজেই এই শহরে নানাবিধ  কাজ করার জন্যে সহজেই যাতায়াত করতে পারছে।

     আমাদের মস্কোতে থাকার কর্মসূচী বেশিদিন না থাকার জন্যে মস্কোর আশেপাশের কিছু দ্রষ্টব্য জায়গা দেখে নেওয়ার চেষ্টা  করেছিলাম। এর মধ্যে প্রথমেই ছিল মস্কোর  বিখ্যাত রেড স্কোয়ার।  মস্কো শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই প্রসিদ্ধ জায়গাটি অনেক দিক দিয়ে খুবই দর্শনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ।  এই রেড স্কোয়ারেই রয়েছে কম্যুনিস্ট পার্টির সদর দপ্তর ,বিখ্যাত ক্রেমলিন ,চতুর্দিক দিয়ে ঘেরা ও সুরক্ষিত।  এর এক পাশে রয়েছে প্রাচীন সেন্ট ব্যাসিলিকা  গীর্জা।  এর মিনারগুলি খুবই সুন্দর ও কারুকার্য করা।  একদম সামনেই রয়েছে সেই বিখ্যাত মহামতি লেনিনের সমাধিক্ষেত্র।  এখানেই লেনিনের মরদেহ  আজও  শায়িত অবস্থায় রয়েছে। প্রতিদিন হাজারে হাজারে দর্শনার্থী এই সমাধিক্ষেত্র দর্শনের জন্যে ওখানে লাইন দেয়।  ওখান দিয়ে বহুবার আমরা গাড়ি করে গিয়েছি, কিন্তু ওখানে নেমে ওই সাপের কুন্ডলির মত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ওই মহান ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানানোর সময় পাই নি।  ওখানের দরজায় সর্বদা সশস্ত্র সেনাদের মোতায়েন করা থাকে। যখন ওখানে  এই সেনাদলের স্থান পরিবর্তনের সময় হয় তখনকার  দৃশ্য খুবই সুন্দর এবং সেটা দেখার জন্যে বহু লোকের ভিড় হয়।  ওখানে থাকাকালীন লেনিনের প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তি ও শ্রদ্ধার নিদর্শন দেখেছি।  শহরের অনেক জায়গাতে,  সমস্ত অফিস কাছারি, কল কারখানার সর্বত্র দেওয়ালে নানা রকমের লেনিনের ছবি টাঙিয়ে রাখতে দেখেছি।  প্রতি ছোট বড় শহরে লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হতে দেখেছি। পরে যদিও রাশিয়ার নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লেনিনের গুরুত্ব খুবই কমিয়ে দেওয়া হয়. একবার এমন কথাও হয়েছিল যে লেনিনের ওই মরদেহ সমাধি  স্থল থেকে  এনে কবর দিয়ে দেওয়া হবে. তবে সেটি পরে কার্যকর হয় নি।  তবে লেনিনের ওই সমাধিক্ষেত্র তখন ওখানের  সোভিয়েতবাসীদের কাছে তীর্থক্ষেত্র হিসাবে পরিগণিত হতে দেখেছি।  রেড স্কোয়ারের  অন্যদিকে ,লেনিনের সমাধিক্ষেত্রের ঠিক সামনেই রয়েছে সোভিয়েত দেশের সর্ব বৃহত   ডিপার্টমেন্টাল  ষ্টোর  গুম।  অত বড় ষ্টোর   ইউরোপের কোনো শহরে দেখি নি।  ওর  পরিধি ও আয়তনের আন্দাজ করা খুবই মুস্কিল।  ওখানে প্রবেশ ও নির্গমের কতগুলি পথ আছে তা হিসেবে আনতে  পারি নি.তবে এটা বুঝেছিলাম যে আমরা একসাথে না ঘুরলে ওখানে যে কোনো মুহুর্তে দলছাড়া  হয়ে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।  সেই অঘটন ঘটেও গিয়েছিল, তারপরে অনেক খুঁজে পেতে, অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনরকমে হারাধনের চারটি ছেলে একত্র হয়ে হোটেলে ফিরেছিলাম।  বাড়িটি বহুতল বিশিষ্ট  এবং প্রতি তলাতে অগুন্তি দোকানের সংখ্যা। সেখানে কি যে পাওয়া যায় না, তা বলে বোঝাতে পারব না।  আর প্রতিটি দোকানে অসংখ্য লোকের ভিড়।  সেখানে জিনিস কিনতে লাইন, বিল মেটাতে লাইন আবার জিনিস নেবার জন্যে লাইন। ওখান থেকে কি কি জিনিস কিনেছিলাম আমরা সবাই,এখন আর সেকথা মনে নেই। ওখানে সব জিনিস খুবই দামী।  তবুও অত লোকের ভিড়, সব দোকানের ভিতর এত  লোক গিজগিজ করছে  কেন ,  বুঝে উঠতে পারি নি।     মনে হয়   শুধু ঘুরেই নানা রকম সুসজ্জিত দোকানের সারি দেখেই মনের সাধ  মিটিয়েছিলাম।  তবে একটা জিনিস মনে আছে।  আমার এখান থেকে নিয়ে যাওয়া জুতোর  সোল্ ফেটে  যাওয়াতে সেখান দিয়ে হাঁটবার সময় বরফ জল ঢুকে পায়ে ঠান্ডা লাগছিল।  সেজন্যে আমার জুতো  কেনার খুব প্রয়োজন ছিল।  কিন্তু সমস্ত জুতোর দোকানের ভিতরে প্রচন্ড লাইন, ভেবে পেলাম না যে এত লোকের সবার কি এত জুতো কেনার দরকার! সেই জুতো  কেনা হলো একটি ছোট শহরের দোকানে গিয়ে। আমার পা নাকি এত রোগা এবং মাপে ছোট যে শেষে ছোটদের বিভাগে গিয়ে কোনরকমে এক জোড়া  জুতো  পাওয়া গেল, সেটাকেও আবার দুটো  মোজা পড়ে  পড়তে হত।  কি ঝামেলা বলোতো ! তবে দোকান পাটে  ওখানের  বিক্রেতাদের অসাধারণ ভদ্র ও সাহায্য করার মানসিকতা আমাদের খুবই মুগ্ধ করেছিল।

  মস্কো থেকে অন্য শহরে চলে যাবার আগে আরও কয়েকটি যাওয়ার কথা বলে মস্কোতে দিন  কাটানোর গল্প শেষ করব।  মস্কোতে তখন বেশ কিছু আমাদের কোম্পানির ছেলেরা  কর্মরত এবং ট্রেনিঙে ছিল।  তাঁরা যোগাযোগ না করলে আমাদের পক্ষে তাঁদের পাত্তা পাওয়া মুস্কিল।  এমনি সময়ে একদিন হোটেলের রিসেপসন থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হলো যে একজন ভারতীয়   আমার সাথে দেখা করার   জন্যে  নিচে অপেক্ষা  করছে।  আমি তাড়াতাড়ি করে নিচে নেমে দেখি যে আমাদের রাঁচী অফিসের কালিদাস সান্যাল ও তাঁর স্ত্রী আমার পূর্বপরিচিত সেবন্তী আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। খানিকক্ষণ কথা বলার পরে ওরা আমাকে ওদের হোটেলে ওদের সাথে যাবার জন্যে সাদর আমন্ত্রণ  জানালো।  সেবন্তী আমার খুবই পরিচিত, ওর সাথে রাঁচীতে সবাই মিলে নাটক,জলসা   ইত্যাদি অনুষ্ঠান করে খুব হৈ  চৈ করেছি বিয়ের আগে।  আমি উপরে গিয়ে সমস্ত পোশাক গায়ে চাপিয়ে  গাড়িতে ওদের হোটেলে গেলাম। ওদের হোটেলটিও  খুব সুদৃশ্য ও বড়সড়।  ওদের ফ্ল্যাট টি খুবই সাজানো গোছানো। অনেক পুরানো  বিষয় নিয়ে আড্ডা দিলাম বহুদিন পরে এই বিদেশ বিভূয়ে।  সেবন্তী রান্নার  ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা  দিচ্ছিল। নানা রকম সুস্বাদু খাবার  দিয়ে  মধ্যাহ্ন  ভোজন  শেষ করলাম।  খাওয়ার পরে ওদের হোটেল ঘোরবার  ফাঁকে ওদের সুদৃশ্য ডলার শপ  দেখে মুগ্ধ হলাম। ঠিক করে নিলাম সময় পেলে ওখানে গিয়ে কিছু কেনাকাটি করব।  ওদের হোটেল আমাদের হোটেল থেকে হাঁটাপথে  বেশি দূরে নয়।  ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওদের দেওয়া পথনির্দেশিকা ধরে হোটেলে পৌঁছে গেলাম সহজেই।

এর পরের দিন হোটেল থেকে ওখানের একটি জনপ্রিয় শিল্প মেলা দেখতে গেলাম বেশ খানিকটা দূরে মেট্রো  করেই।  মেট্রো ধরে কোনো জায়গাতে যাওয়া কোনো সমস্যাই নয়।  গিয়ে দেখি এলাহী ব্যাপার। মেলাটি বেশ অনেকখানি জায়গাজুড়ে , একদিনে স্বল্প সময়ে ওই মেলার অংশ বিশেষ দেখা যেতে পারে।  সেই ভাবেই কিছু প্যাভিলিয়ন  দেখতে শুরু করলাম। হরেক রকম শিল্প সামগ্রীর বিরাট প্রদর্শনী।  দেখে চোখে তাক লেগে যায়।  ভাষা সমস্যার জন্যে সব কিছু বুঝতে পারছিলাম না।  একটি স্টলে মহাকাশ গবেষণা ও মহাকাশ যান সম্বন্ধীয় জিনিসপত্র দেখে ভালো লাগলো। এক জায়গাতে খুব ভিড় দেখে এগিয়ে দেখি সেখানে বিশাল বরফের   স্তূপ বানিয়ে সেখান দিয়ে দর্শকেরা স্লেজ গাড়িতে মহানন্দে ঘুরছে।  ইতিমধ্যে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম ,সন্ধ্যা হয়ে আসছিল।  তাই ওখান থেকে বিদায় নিয়ে  আবার মেট্রো ধরে হোটেলে ফিরে এলাম।  সোজা স্তলোবায়াতে গিয়ে এক কাপ  কফিতে চুমুক দিয়ে কিছুটা ক্লান্তি দূর করলাম। গিয়ে দেখি, হোটেলের ঘরে তেজবাহাদুর ঘুমোচ্ছে। এরা কি  জন্যে এখানে  এসেছে! জিজ্ঞাসা করতে বলল, যে ওগুলি ওর অনেকবার দেখা আছে।  আর কথা বাড়ালাম না।

এখানে একটা মজার কথা বলতে ভুলে গেছি। যখনি রাশিয়ান দোভাষীর সাথে গাড়ি করে মস্কয়া নদীর ধার দিয়ে হোটেলে ফিরেছি  ,তখনি এই নদীর পারে এক জায়গাতে খুব জনসমাগম দেখেছি। নানা  বয়সের লোককে বেশ উত্তেজনার সাথে হৈ চৈ করতেও দেখেছি। একদিন দোভাষী কে ওখানের ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করাতে বেশ একটা মজার খেলার কথা জানা গেল।  মস্কোতে বিশেষ করে এই জমে যাওয়া নদীর এক জায়গাতে গর্ত খুড়ে  সেখান দিয়ে পুরোপুরি নিরাভরণ হয়ে   বরফের স্তরের নিচের ঠান্ডা জলে কে কতক্ষণ   দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তার প্রতিযোগিতা হয়।  এ নিয়ে খুবই উত্সাহ ও উন্মাদনা দেখা দেয় অংশগ্রহন কারী  প্রতিযোগী এবং তাদের ঘিরে থাকা দর্শকদের মধ্যে।   এটা নাকি ওখানকার এক বিশেষ বিনোদনের অঙ্গ ও খুবই জনপ্রিয় স্পোর্টস।  আজব ব্যাপার!

আমার কোনো জায়গাতে গেলে সেখানের নানা  ছবি তলার সখ বহুদিনের।  ইউরোপ ভ্রমনের সময়  ছবি তুলেছিলাম। তবে তখন ছিল ফিল্ম ক্যামেরা  এবং দেশে রঙিন ফিল্মের প্রচুর দাম এবং প্রথম প্রথম সেই রঙিন ফিল্ম ডেভেলপ করে প্রিন্ট  করার ব্যবস্থা ছিল না।  আমি ওগুলো ভাইকে বিদেশে পাঠিয়ে প্রিন্ট করিয়ে আনতাম। ইউরোপ ভ্রমনের সময় ওখান থেকেই ওই সব কাজ করিয়ে এনেছিলাম। রাশিয়াতে যাবার সময় এদেশ থেকে কোনো রঙিন ফিল্ম নিয়ে যেতে পারি নি, কারণ রাঁচীতে ওগুলো পাওয়া যেত না ,আর আমাকে রাঁচী থেকে দিল্লী হয়ে বিদেশে যেতে হয়েছিল। রাশিয়াতে এসে মস্কো শহরে কোনো নামী দামী রঙিন ফিল্ম  পাওয়া যায় নি।  ওখানে  ORWO ফিল্ম ব্যবহার করতে হয়েছিল। সেগুলোর মান খুব খারাপ এবং  ওখানের প্রিন্টিং র মান আরও খারাপ। সেজন্যে  স্মৃতি বলে কিছু ছবি নিজের সংগ্রহে থাকলেও  সেগুলো কাউকে দেখানোর মত  পদস্থ ছিল না।  ওখানে এমন সব জায়গাতে গিয়েছি, এমন সব দুষ্প্রাপ্য ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলাম, আজকের ডিজিটাল ক্যামেরা থাকলে কত কত সুন্দর স্মৃতি ধরে রাখতে পারতাম. এই দু:খ আমার কোনদিন যাবে না।
তবে ওখানে সর্বপ্রথম এক ধরনের কলাকৌশলে যে কোনো পজিটিভ ফটো থেকে সাদা কালো বা রঙিন যে কোনো বর্ধিত মাপের  ল্যামিনেটেড  ফটো বানিয়ে দিত।  আমি আগে রাশিয়া থেকে আসা কয়েকজনের কাছে এই ধরনের ছবি দেখে সঙ্গে করে বাবা, মা, শ্বশুর ,ছেলেদের ও নিজেদের একটি যুগল ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো ওখান থেকে সুন্দর ভাবে ল্যামিনেট করে নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলি ত্রিশ বছর পরেও বেশ অক্ষত আছে।  এটা আমি ইউরোপ কিম্বা আমেরিকাতে  দেখিনি।

 আগেই বলেছি এখানের কর্মরতা মহিলাদের আন্তরিক কর্মনিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধের কথা।  বিভিন্ন স্টোরে ,বাসে, ট্রামে,মেট্রোতে  কর্মরত  কিংবা শীতের রাতে রাস্তার ধারে বরফ সরানোর হাড়  হিম করা কাজের মধ্যেও ওদের কর্মনিষ্ঠা কোনদিন ভুলতে পারব না।  আর ভুলতে পারব না হোটেলের বিভিন্ন ফ্লোরে কর্মরতা ফ্লোর লেডিদের  নি:শব্দ কর্মব্যস্ততার কথা ও তাঁদের দায়িত্ববোধের কথা।   দুপুর,গভীর রাত যখনি দেখেছি ওনাদের ,তখনি দেখেছি আপনমনে হয় বই পড়ছেন নতুবা উল বুনছেন, নতুবা অন্য কিছু করছেন, কিন্তু কখনো গাল গল্প করতে দেখি নি।  গভীর রাতে আমাদের বিমান ধরবার জন্যে যখন হোটেল  ছাড়তে হয়েছে ,তখন সেই ছাড়পত্র নিতে ওই ভদ্রমহিলাদের কাছে যেতে হয়েছে। টাকা পয়সা আগেই মিটিয়ে দিয়ে রসিদ নিতে হয়েছে।  সেগুলি  ওর খাতাতে  অন্তর্ভুক্ত করে অনুমতিপত্র দিয়েছেন, যার ফলে নিচে হোটেল থেকে বেরোনোর সময় সহজেই বেরোনো গেছে। এইরকম বেমক্কা সময়ে কোনবার এদের ঘুমিয়ে পড়তে দেখি নি।  কাছে গেলেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা করে কাগজপত্র দেখে নিজের কাজ করে আমাদের শুভ রাত্রি ও শুভ যাত্রার কথা শুনিয়েছেন।  বলেছেন' দাসভিদানিয়া ' অর্থাত আবার দেখা হবে  , বন্ধু।  এ জিনিস আমাদের দেশে বিরল।

মস্কো থেকে অন্য জায়গাতে  আগে এখানে খাওয়া দাওয়ার সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু আলোচনা করতে চাই।  এখানে ইউরোপের মতন পথের ধারের সস্তাতে খাবারের দোকান তেমন চোখে পড়েনি।  সেজন্যে সকালে রোজই হোটেলের স্তলোবায়াতে গিয়ে ওখানের সেই একঘেয়ে খাবার খেতে হত।  দুপুরে অনেক সময় দূতাবাসের কর্মীর সাথে ঘুরতে বেরোলে বাইরের কোনো রেস্তোরাতে খাওয়া হত কালে ভদ্রে। রাত্রে হোটেলেই নিচের দামী রেস্তরাতে খেতে হত।  ওখানে ভাষার সমস্যা ছিল অর্ডার দেবার সময়।  তেজ্বাহাদুরকে নিয়েই মুস্কিল হত নিরামিষাসী খাবার খেতে।  আমরা অনেক সময় চিকেন চেয়ে পাই নি, কিংবা  দেরী করেছে।  রান্নাও তেমন সুস্বাদু নয়. ওখানে গরুর মাংসের চলটাই  বেশি। কিন্তু ওর  বিকট গন্ধেই গা গুলিয়ে আসতো।  একদিন দুপুরে আমি একলা নানা জায়গাতে ঘুরে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে হোটেলে এসে  স্তলোবায়াতে কিছু খাবার খেতে চাইলাম। পাউরুটি এবং চিকেন চাওয়াতে আমাকে বলল ,যে চিকেনের কোনো গরম খাবার নেই।  অগত্যা ক্ষিধের মুখে একটি অতি শীতল চিকেনের টুকরো ,যার থেকে তখনও  ঠান্ডা ধোঁয়া  বেরোচ্ছে, তাই খেতে হলো মাস্টার্ড  সস দিয়ে। সে কি করুন অবস্থা।  রাশিয়াতে গিয়ে আমাদের অনেক সহকর্মী ট্রেনিঙে গিয়ে খুবই  কষ্টে ভুগে রোগা হয়ে ফিরেছে ,আবার কিছু সহকর্মী যারা এগুলো খেতে পেরেছে তারা নধর কান্তি  হয়ে ফিরেছে। আমার অধস্তন এক খুবই কাছের সহকর্মী রাশিয়া থেকে ফিরবার পরে  ওর  গোলগাল নাদুস নুদুস চেহারা দেখে ওকে বুলডগ আখ্যা দিয়েছিলাম। তবে আমরা সবাই অভ্যাসের দাস,বিদেশ বিভূয়ে গেলে একটু মানিয়ে নিতে না পারলে সবদিক দিয়ে অসুবিধা হয়।  তবে মস্কোর পরে লেনিনগ্রাদ ও পরবর্তী শহরগুলিতে এত খাতির  পেয়েছি যে এই অসুবিধাগুলো সুদে আসলে পুষিয়ে গিয়েছিল।

 মস্কো থেকে আপাত বিদায় নিয়ে এবার আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থল , রাশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ শহর  লেনিনগ্রাদ।   এর বর্তমান নাম সেন্ট পিটার্সবার্গ।  রাশিয়ার মস্কো শহর থেকে ওদের দ্রুতগামী এক্সপ্রেস ট্রেনেই আমরা ওখানে গিয়েছিলাম। এই ট্রেন যাত্রাটি নানা দিক দিয়ে ঘটনাবহুল। এর কথা পরবর্তী অংশে জানাব তোমাদের। আমাদের লেনিনগ্রাদের ট্রেন ছিল রাত্রে।  যাবার আগে সমস্ত গোছগাছ করার সময় আমাদের কর্ণধার শ্রীযুত রামমোহন রাও আমাকে বিশেষ করে কিছু খবরের কাগজ নিয়ে যেতে বলেছিলেন, কারণ জানান নি, তবুও  কথামত নিয়ে গিয়েছিলাম। পরে খুব কাজ দিয়েছিল সেই কাগজ।  ট্রেনে আমাদের ক্যুপেতে শ্রী রাও ছাড়া ,আমি,তেজবাহাদুর ও কেরালার শ্রী রাজন ছিল।  শ্রী নায়ার অন্য ক্যুপেতে  ছিলেন ।  ট্রেনে যাত্রীদের সমস্ত তত্ত্বাবধানের জন্য একজন    ভদ্রমহিলাকে দেখেছিলাম। তিনি একাধারে সব কাজ দ্রুতগতিতে একের পর এক করে যাচ্ছিলেন যন্ত্রবত।   বিরাট করিডরওয়ালা ট্রেন এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত।  প্রথমে ভদ্রমহিলা আমাদের টিকিট পরীক্ষা করে গেলেন।  পরে এসে আমাদের রাত্রে সবার জন্যে  বিছানা, বালিশ ও কম্বল দিয়ে গেলেন।  পরে এক গ্লাস ঠান্ডা জল দিয়ে গেলেন সবাইকে। আমাদের পাশের ক্যুপে এক নাইজেরীয় উচ্চপদস্থ দূতাবাসের কর্মী যাচ্ছিলেন।  উনি আমাদের ক্যুপেতে এসে আড্ডা জমালেন।  বেশ খোশ  মেজাজের লোক।  কথায় কথায় জানা গেল যে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার নিয়ে ওদেশের বন্দর নগরী  ওডেসা তে যাচ্ছেন।  নাইজেরিয়ার একটি লোক এখানে কাজ করতে এসে উন্মুক্ত স্থানে একটি রাশিয়ান মেয়ের শ্লীলতা হানি  করতে যাওয়ার মুখে রাশিয়ান সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেপ্তার হয়।  প্রাথমিক বিচারে  ওই নাইজেরিযানের প্রাণদন্ডের  আদেশ দেওয়া হয়।  এখন এই নাইজেরিয়ান বরিষ্ঠ কর্মচারী চলেছেন যে কোনপ্রকার কূটনৈতিক  উপায়ে শাস্তির পরিমান মকুব অথবা কমানো যায়।  রাশিয়াতে সমস্ত ব্যাপারে সামরিক প্রশাসনের কড়া  নজর ও নিয়ন্ত্রণ ছিল।  সে ব্যাপারে আইন অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট লোকেদের উচিত শাস্তি দেওয়া হত।  এজন্যে লোকেদের এই সম্বন্ধে সচেতনতা  মজ্জাগত হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে আড্ডা মারতে মারতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল ,হঠাত  সেই তত্ত্বাবধায়ক ভদ্রমহিলার আবির্ভাব এবং অত্যন্ত সংযত ও কঠিন  স্বরে আমাদের গভীর রাতে অন্য সহযাত্রীদের  ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো অবিলম্বে বন্ধ করতে বললেন।  এর পরে তো আর কথা চলে না ,আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে যে যার জায়গাতে শুয়ে পড়লাম ,আর নাইজেরীয় ভদ্রলোককে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায়  দিলাম।  বেশ ভোরেই দরজায়  করাঘাত শুনে দরজা খুলে দেখি ,সেই তত্ত্বাবধায়ক   হাতে ধুমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে হাসিমুখে হাজির। আমাদের 'দোবরে  উতরা ' অর্থাত  শুভ প্রাত:কাল  বলে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরাও প্রত্যুত্তরে ওনাকে স্পাসিবা অর্থাত ধন্যবাদ জানিয়ে  চায়ের কাপগুলো নিয়ে নিলাম। চা খাবার পরেই শ্রী রাও আমাকে প্রাত:কৃত্য সেরে আসতে বললেন দ্রুত এবং সঙ্গে দু একটি খবরের কাগজ নিয়ে যেতে বললেন।  আমি তাড়াতাড়ি টয়লেটে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে দেখি যে সারা টয়লেট নানা রকম ছেড়া ও নোংরা কাগজ কাগজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এবারে বুঝলাম যে টয়লেটে  তেমন জলের ব্যবস্থা এবং টয়লেট পেপার না থাকার ফলে এই অবস্থা। তখন রাও সাহেবের খবরের কাগজ নিয়ে আসার কারণ বুঝতে।  পারলাম।  কোনরকমে আমার কাজ কাগজ দিয়ে সেরে আমাদের ক্যুপেতে ফিরলাম, তখন দেখি রাও সাহেব  হাসছেন। এখানের  পাবলিক টয়লেট গুলি  বোধহয় আমাদের দেশের অনুরূপ ব্যবস্থাকেও লজ্জা দেবে।   এদেশের এটা একটা  খারাপ দিক বলে মনে  হয়েছে ,তবে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হয় নি।  এ ছাড়া  এই ট্রেন যাত্রাতে আর একটি মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।  রাও সাহেব বললেন যে কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন লেনিনগ্রাদ  পৌঁছে যাবে। এটি একেবারে নন স্টপ ট্রেন ছিল।  ট্রেন লেনিনগ্রাদ স্টেশনে পৌছানোর বেশ কিছু আগে থেকেই কেউ যাতে টয়লেটে না ঢোকে সেদিকে এই ট্রেন তত্ত্বাবধায়ক মহিলার কড়া নজর থাকে। রেল কর্তৃপক্ষ কোনমতেই মূল স্টেসনের  আশেপাশে কোনো পূতিগন্ধময় ময়লা যাতে স্টেসনের  সৌন্দর্য হানি না করতে  পারে,তার জন্যে এই সতর্কতা।  নামার অল্প আগে সেজন্যে একজন যাত্রীকে টয়লেট থেকে বার করার জন্যে ওই মহিলাকে টয়লেটের দরজায় সজোরে করাঘাত করতে দেখেছিলাম।  কিছুক্ষণের মধ্যে লেনিনগ্রাদ স্টেসনে ট্রেন পৌঁছলে আমরা মালপত্র নিয়ে নেমে পরলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলের পথ ধরলাম।

        হোটেলে পৌঁছে নিজেদের ঘরে গিয়ে বেশ ভালো লাগছিল। হোটেলটি একেবারে শহরের মূল সড়ক নেভস্কি প্রস্পেক্টের  উপরে।  রাস্তার অন্যদিকেই বহতা মূল নদী নেভা   তখন জমে বরফ   হয়ে গেছে মস্কোর মস্কয়া   নদীর  মত।   মূল রাস্তা দিয়ে বাস,ট্রাম, গাড়ি  চলেছে। বাস, ট্রামে  উপছে পড়া  লোকের ভিড়।  এই শহরেই আমাদের বেশ কয়েকদিনের থাকা এবং এখানের এক গবেষনাগারের কর্মকর্তাদের সাথে  আলোচনার পরে   বিভিন্ন জায়গাতে কল কারখানা দেখতে যাওয়ার কর্মসূচী নির্ধারণ করা।  এই শহরটিকে বেশ আপনার মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, এখানে বেশ স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করে  কিছু করা যেতে পারে,যদি অবশ্য সময় পাওয়া যায়।  এখানে অন্য প্রসঙ্গতে যাওয়ার আগে দুটি বেশ মজার ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।  মস্কোতে কোনদিন বাসে,ট্রামে চড়তে সাহস পাই নি।  এখানে একদিন বাসে চেপে বসলাম ,উদ্দেশ্য ওখানের পোস্টঅফিসে  যাওয়া।   বাসে চড়েই  টের  পেলাম, চিড়ে চ্যাপটা  হওয়া কাকে বলে।  সবাইকে টিকিট কাটতে দেখছিলাম, আমি কাটব ভাবছিলাম, কিন্তু আমার মত কলকাতার ভিড় বাসে চেপে অভ্যস্ত লোকের কাছেও ওই প্রচন্ড ভিড় অসহনীয় মনে হলো।  এর ফলে আমি পরের স্টপেই  বাধ্য হয়ে নেমে পড়লাম, টিকিট না কেটেই। মনটা খচখচ  করছিল  অপরাধবোধ থেকে। কিন্তু কিছু করার ছিল না।  ওখান থেকে নির্দেশ মত সোজা রাস্তা ধরে কিছুটা হাঁটার পরেই আমি পোস্টঅফিসের  হদিস পেয়ে গেলাম। রাশিয়াতে ওদের নিজস্ব এক ধরনের কাঠের  পুতুল পাওয়া যেত, যেটি একটার পেটে  আরেকটা পুতুল রেখে এরকম করে গোটা চারেক পুতুল রাখা যেত।  এই পুতুলগুলো একেবারে টিপিক্যাল রাশিয়ান ধরনের, আগে ইউরোপে কিংবা অন্য  দেশে দেখিনি।  ভেবেছিলাম যে ,ঐরকম একটা পুতুলের সেট  আমার ভাইঝিকে আমেরিকাতে পাঠিয়ে দেব ওখান থেকে। পোস্ট অফিসটি বেশ বড়সড় এবং ব্যবস্থাপত্র বেশ ভালো মনে হলো।   পোস্ট অফিসে গিয়ে পুতুলের মাপমত কার্টন ,কিনে ওটাতে ভালোভাবে ভরে  ,ঠিক মত প্যাক করে, ঠিকানা লিখে যখন কাউন্টারে পৌঁছালাম ,তখন ওরা বলল যে ওখান থেকে আমেরিকাতে কোনো কিছু পাঠানো যাবে না।  কোনো কারণ বলল না, বলল নিয়ম নেই।  অথচ অনেকেই এখান থেকে ভারতবর্ষে অনেক কিছু উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছে, কোনো ঝামেলা হয়েছে বলে শুনিনি।   অগত্যা কি আর করা, ওই পুতুলের প্যাকেট হাতে নিয়ে এবারে সোজা রাস্তা দিয়ে হেঁটে হোটেলে পৌঁছে একেবারে ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্রাম নিলাম।

    এই  শহরেই   এক  গবেষণা কেন্দ্রেই আমাদের  বিশেষ টেকনিক্যাল আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভারতের কেরালা প্রদেশে যে বিশেষ উষ্মসহ নানা ধরনের চুল্লির বিশেষ আস্তরণ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল ,তার সমস্ত প্রযুক্তিগত কারিগরী জ্ঞান ও বাস্তব সম্মত কার্যধারা স্বচক্ষে দেখার জন্যেই আমাদের চারজনের বিশেষজ্ঞ হিসেবে এ দেশে আসা।  এই গবেষণা কেন্দ্রে বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের সাথে আলোচনা করার জন্যে পরের দিন ওখানে হাজির হলাম। বিরাট এলাহী ব্যবস্থা।  এখানে ওদের দলের প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে আমাদের পূর্বপরিচিত একজন বন্ধু ছিলেন।  উনি আমাদের দেখে খুব খুশি হলেন।  উনি রাঁচীতে আমাদের অফিসে এসে নারকম প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের ট্রেনিং দিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন। তবে শুনেছি, উনি ওখানের পার্টির সদস্য ছিলেন, সেজন্যে লোক হিসাবে খুব  খোলামেলা লোক ছিলেন না।  যাই হোক আমাদের আলোচনা মোটামুটি একতরফা ভাবেই শেষ হলো।  কারণ এই বিষয় সম্বন্ধে আমাদের সকলের জ্ঞানের পরিধি ছিল খুবই সীমিত  ,তারপরে ভাষাগত সমস্যার জন্যে দোভাষীর মারফত সমস্ত কথাবার্তা হওয়ার জন্যেও অযথা বহু সময়   অপব্যয় হচ্ছিল। দুপক্ষেরই একের অপরের কথা বুঝতে বেশ অসুবিধা  হচ্ছিল।  এখানেই একটা চমক লেগেছিল প্রথম দিনেই। আমাদের আলোচনা শেষ হয়ে যাবার পরে আলোচনার সারাংশ  লিপিবদ্ধ করে একটি নথি বানানো হচ্ছিল। এই সমস্ত করছিলেন একজন বেশ বয়স্ক জ্ঞানবৃদ্ধ লোক।   ওর  সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো  ডক্টর কার্কলিট  নামে। আমি রাশিয়ান জার্নালে এই বিদগ্ধ বিজ্ঞানীর নাম খুবই পড়েছি।  ওনার মত একজন লোককে এই কাজ করতে দেখে অবাক হলাম। পরে বিশদে সব শুনে খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম।  ওদের দেশে অবসর নেবার পরে সরকার থেকে সবাই নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী পেনসন পায়।  তবে অবসরের পর কর্মক্ষম থাকলে  সে  সংস্থায় নিচু পদে কাজ করতে পারে। এই কাজে বেতন বেশ কিছু কম।  এই ভদ্রলোক অবসর সম্প্রতি নিয়েছিলেন ওখানের ডাইরেক্টর হিসাবে বহুদিন কাজ করার পরে।  অবসরের পরে উনি ওখানেই বেশ নিচু পদে কাজ করছেন। ওখানে চাকরিতে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মাইনের মধ্যে তহাত বেশ কম।  তবুও মাইনে কম পেলেও আমাদের দেশে এই পদ্ধতি  আকাশ  কুসুম।  ওখানে দিন দুই আলোচনার ফাঁকে আমাদের ওখানের ক্ষুদ্র আকারে বিশেষ ধরনের উষ্মসহ চুল্লির আস্তরণ একেবারে হাতে কলমে কিভাবে তৈরী হচ্ছে তার বিশদ প্রক্রিয়া দেখানো হলো।  এখানে গবেষণা করে সাফল্য লাভ করলে তবেই সেটিকে ছোট আকারে বাস্তবে পরীক্ষা করা হত স্টিল প্ল্যান্টের বিভিন্ন  চুল্লিতে।  সেখানের সাফল্য অসাফল্যের উপর নির্ভর করে এটিকে তারপরে কারখানাতে বানিজ্যগতভাবে  তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়।  সুতরাং এই গবেষণা কেন্দ্রের গুরুত্ব অপরিসীম। কেরালাতে প্রযুক্তিগত  প্রকৌশলের অনেকখানি অবদান এখান থেকেই পাওয়া যাবে।  এখানেই আমাদের দেশের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন রকমের উষ্মসহ পদার্থের বাণিজ্যগত উত্পাদনের কারখানা দেখার কর্মসূচী নির্ধারণ করে দেওয়া হলো।   ওখানে  মধ্যাহ্ন ভোজনের এলাহী ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাশিয়াতে কোনো অফিসিয়াল লাঞ্চ বা  ডিনারের  ব্যবস্থা মানে বিভিন্ন রকমের  রাশিয়ান ও ইউরোপিয়ান মদের ব্যবস্থা। এর পরেও এই হ্যাপা পোহাতে হয়েছে আমাকে বিশেষত।  আমি কোনদিন ধুমপান কিংবা মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিলাম না।  সুতরাং ভদ্রতা রক্ষা করার জন্যেও আমাকে বেশ অসুবিধায় পড়তে  হত।  সেবারে রাত্রেও এক বিশাল হোটেলে আমাদের সম্মানে বিশাল পার্টির বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।  একদিনে দু দুটো পার্টি  তাতে আবার অত মদ খাওয়ার আধিক্যের ফলে বেশ ঝামেলাতে পড়তে হয়েছিল আমাকে।

 এবারে অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এখানকার কিছু রীতি নীতি নিয়ে আলোচনা  করব।  আগেই বলেছিলাম যে এখানে মেয়েরাই সর্বত্র বিরাজমান।  এরা কর্মক্ষেত্রে এত কাজকর্মের পরে বাড়ি গিয়ে সেখানের অন্দরমহলের  দায়িত্বও নিজের হাতেই রাখে। ছেলেরা এক কর্মস্থলে যাওয়া ছাড়া  আর যে কিছু করে সে সম্বন্ধে আমার বেশ সন্দেহ রয়ে গিয়েছিল। এতৎ সত্ত্বেও  দেশের সমস্ত আইনে  ছেলেদের   তুলনায় মেয়েদের সঙ্গে বিশেষ বৈষম্য মূলক আচরণ করা হয়।  উদাহরণ স্বরূপ।, ছেলেদের অবসরের বয়স ৬০ কিন্তু মেয়েদের অবসরের বয়স ৫৮।  অবসরের পরে ছেলেদের পেনসনের পরিমান একই রকমের কর্মের জন্যে মেয়েদের তুলনায় বেশি।  এমন কি একই ধরনের দক্ষতাপূর্ণ কাজে মেয়েদের মাইনে ছেলেদের থেকে  অপেক্ষাকৃত কম।  এই বৈষম্যমূলক আচরণ  ইউরোপ ও আমেরিকাতেও লক্ষ্য করেছি। এরকম একটি জায়গাতে  কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, যে আমাদের দেশ অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত দেশের থেকে পিছিয়ে থাকলেও, কর্মক্ষেত্রে এরকম বৈষম্যমূলক আচরণ এরকম আইন করে করা হয় না।  আমার মানে হয় ,এই বৈষম্যের ফলেই ইউরোপ,আমেরিকা, বিশেষ করে রাশিয়ার মেয়েরাই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে  আন্তর্জাতিক নারী দিবসের উত্পত্তি ঘটায়। এই বিষয়ে একেবারে এই লেখার একেবারে শেষে আমি এখানের  সফরের শেষে আমার পরম প্রাপ্তির কথা বিশদে উল্লেখ  করব।

 এর আগেই এখানের সাধারণ জনসাধারণের মধ্যে নিয়ম শৃঙ্খলা কঠোর ভাবে মেনে চলার কথা জানিয়েছিলাম।   এই সব ব্যাপারে প্রশাসন যেমন সদা সতর্ক , সাধারণ মানুষ ততোধিক সচেতন এগুলো পালন করা নিয়ে। এগুলো যেন তাদের মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে, কাউকে এর জন্যে আলাদা করে মনে করিয়ে দিতে হয় না।  এখানে পাবলিক   প্লেসে  যে কোনো ধরনের  ধূমপান পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এখানের দেশের ভিতর চলাচলের প্লেনে ধূমপান একেবারেই বর্জনীয়। সে সময়ে আমাদের দেশের বিমানেও এরকম  কড়া কড়ি ছিল না ধূমপানের বিরুদ্ধে। ট্রেনে লম্বা সফর কালে করিডর ট্রেনের একেবারে শেষপ্রান্তে একটি জায়গাতে গিয়ে কেবল ধূমপানের  অনুমতি ছিল।  অফিসেও এরকম একটি বেশ নির্জন জায়গাতে গিয়ে ধূমপান করার অনুমতি ছিল।  এসব জায়গাতে গিয়ে অত কষ্ট করে একেবারে পাড়  নেশাড়ু  ছাড়া  কারো  পক্ষে ধূমপান করা পোষাত না বলেই মনে হয়।  আর ওখানে আইন ভঙ্গ করলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের হেপাজত ও বিচার।  সেখানে গুরুত্ব বুঝে হয় জরিমানা অথবা কয়েদখানা অথবা উভয়ই ভোগ করতে হত।  সেজন্যে সহজে ও সজ্ঞানে  কেউ আইন ভঙ্গ করতে সাহস দেখাত না।

 এখানের বয়স্ক মহিলাদের মমতাপূর্ণ ব্যবহারের কথা আগে বিশদভাবে লিখেছি। এবারে এখানের তরুণী  ও যুবতীদের কথা কিছু লিখব।  এখানের তরুণী  ও উঠতি যুবতীরা বেশ সরল, সুশ্রী এবং নিষ্পাপ  চেহারার বলে মনে হয়েছে। এগুলো আমার যেটুকু চোখে পড়েছে তার  ভিত্তিতেই বলা।  যদিও মাত্র ২১ দিনের সফরে এই নিয়ে পুরো দেশের কোনো জাতি বা আচার আচরণ নিয়ে পুরোপুরি মত  দেওয়া সম্ভব  নয় , তবুও যেটুকু দেখেছি এবং আমার পূর্বসূরী আমাদের কোম্পানির সহকর্মীদের মুখ থেকে শোনা কথার ভিত্তিতেই আমার এই অনুভব।  এখানের এই তরুনীদের  একেবারেই কোনো উগ্র প্রসাধন করতে দেখি নি ।  সেটা তাঁদের রুচির জন্যে অথবা প্রসাধন দ্রব্যাদির উচ্চ দামের জন্যে  সেটা বলা মুস্কিল। তবে মাঝবয়সীদের যেরকম উগ্র প্রসাধন করতে দেখেছি, এইসব তরুণী  ও বয়স্কা মহিলাদের একেবারে সাদামাটা ভাবে বিচরণ করতে দেখেছি পথে ঘাটে, দোকানে, রেস্তরাতে, মেট্রোতে, বাসে।  এরা খুবই সরল প্রকৃতির মনে হত এবং সেজন্যে  মাঝে মধ্যেই এশীয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের  বিদেশী ছাত্রদের পাল্লায় পরে যেত এবং তাদের যথেচ্ছ ব্যবহারের শিকার হয়ে যেত।  এই সব দেশের শিক্ষার্থীরা  বেশি বিদেশী মুদ্রা ভাতা হিসাবে পেত।  সেখান থেকেই   দামী পোশাক,  প্রসাধনের লোভ দেখিয়ে এদের  প্রলুব্ধ করত।  এই সব মেয়েরা  সরল  বিশ্বাসে এবং এই সব প্রলোভনের কবলে পড়ে এদের হোস্টেলে গিয়ে এদের যাবতীয় কাজ করে দিত।  এই সব বিদেশীরা এদের সাথে  অভিনয় করে অনেক আকাশ কুসুম  স্বপ্ন দেখাত. এমন কি তাঁদের বিয়ে করে দেশে নিয়ে যাবার কথাও বলে আশ্বাস দিত।  এই সব কথাবার্তা এরা বিশ্বাস করে এদের সজ্জা সঙ্গীণী   হত এবং এদের ভোগের শিকার হত।  শেষে এই সব বিদেশীদের ওখানের ট্রেনিং শেষে চলে আসার সময় এরা বুঝতে পারত যে কি ভাবে এরা সব দিক দিয়ে প্রতারিত হয়েছে। এগুলো আমার কিছু শোনা কথা এবং কিছু প্রত্যক্ষ অফিসের সহকর্মীদের নিজেদের মুখের স্বীকারোক্তি এবং ওখানে কুকীর্তির ছবি দেখে দৃঢ় ধারনা হয়ে গিয়েছিল। এই সব কাজকর্মে আমাদের দেশের সবাই ওই দেশের এই সব মেয়েদের কাছে কত নিচে নেমে যেতে হয়েছে তা ধারনাতীত। এগুলো শুনে লজ্জায় মাথা কাটা গেছে।  এইসব অভিজ্ঞতা এবং এখানের সরকারী নিয়ম অনুসারে সন্তানেরা  উচ্চ শিক্ষার পর থেকে  রাষ্ট্রের সম্পত্তি হয়ে যাওয়ায় ,এখনকার তরুণীরা বিবাহের ব্যাপারে একেবারেই বিমুখ হয়ে পড়েছে।  যদিও এগুলো সবই  আমাদের সফরের সময়ের কথা।  তারপরে তো রাশিয়াতে অনেক আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে সমস্ত ব্যাপারে।  সেজন্যে এখনকার অবস্থা বলতে  পারব না।
 এখানের মায়েরা একেবারে আমাদের দেশের মায়েদের মতন ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন থাকত।   স্কুলের শেষ পরীক্ষার পরে উচ্চ শিক্ষাতে যাবার জন্যে  তাদের সন্তানদের খুবই এক শক্ত পরীক্ষাতে বসতে হত।  সেই পরীক্ষাতে সসম্মানে নির্দিষ্ট মানের মধ্যে উত্তীর্ণ হলেই তবেই মিলত উচ্চ শিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশের অনুমতি।  নতুবা রাষ্ট্রের নির্দেশে বাকিদের বিভিন্ন  বৃত্তিমূলক কাজের জন্যে পড়াশুনা করতে হত।  এখানে যেহেতু সবার কাজের দায়িত্ব সরকারের হাতে ,সুতরাং বেকারত্বের চিন্তা কাউকে করতে হত না।  কিন্তু মায়েদের ওই সময়ে চিন্তা ঠিক আমাদের দেশের মায়েদের কথা মনে করিয়ে দিত।

   রাশিয়াতে যাবার আগে আমার অনেক সহকর্মী যারা আগে রাশিয়াতে ট্রেনিং কিম্বা অন্য  ওদেশে গিয়েছিলেন তাদের কাছে অনেক ওখানের সম্বন্ধে নিন্দাজনক খবর শুনেছিলাম। তবে এগুলোর বেশির ভাগ মহিলা  মহলের গাল গল্প বলে আমি কিংবা আমার গিন্নী এ বিষয়ে কর্ণপাত করি নি।  শুনেছিলাম যে রাশিয়াতে সর্বত্র ভিখারীরা খুবই জ্বালাতন করে বিদেশীদের, তাঁদের কাছে পয়সা চায় এবং তার জন্যে ছিনতাই করতেও নাকি পিছপাও হয় না।  আমার ওই স্বল্প  ২১ দিনের সফরে রাস্তাঘাটে,  বাসে,মেট্রো স্টেসনে  কথাও কোনো ভিখারী চোখে পড়ে নি, সুতরাং তাদের দ্বারা উপদ্রবের প্রশ্নই উঠতে পারে না।  এমন কি একদিন এক মেট্রো স্টেসনে আমার হাত থেকে বেশ কিছু  খুচরো  পয়সা মেঝেতে পড়ে  সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়েছিল।  আমি নামতে না নামতেই একজন জীর্ণপোশাক পরিহিত ব্যক্তি নিজের থেকেই ওগুলো কুড়িয়ে আমাকে ফেরত দিয়েছিল। আমি ওনাকে স্পাসিবা বলে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি আজও অম্লান রয়েছে আমার স্মৃতিতে। আরেকটি  রসালো  গল্প আমার রাশিয়া থেকে প্রত্যাগত কতিপয়  সহকর্মী তাঁদের স্ত্রীদের কাছে নিজেদের সততা যাচাইয়ের উদ্দেশে ওখানের বারবনিতাদের হাতে হয়রানির কথা শুনিয়েছিলেন। অনেক গিন্নীরা আবার তাঁদের স্বামীদের রাশিয়া যাবার আগে এই ব্যাপারে সাবধান করে দিতেন। কিন্তু আমাদের বয়স্ক কিছু সহকর্মীরা ফিরে এসে যেসব ছবি দেখাতেন তাতে করে তারা কিভাবে ওখানে অবসর সময় কাটিয়েছিলেন সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ লেগেছিল।  আমার ২১ দিনের সফরে বহু সময় আমি বেশ রাত করে পায়ে হেঁটেই  লেনিনগ্রাদের রাস্তা দিয়ে হোটেলে পৌঁছেছি, কিন্তু আমার চোখে এই ধরনের কোনো মহিলা কিংবা তাদের অভদ্রচিত আচরণের কোনো দৃশ্য চোখে পড়ে নি।  আমার স্ত্রীর কান ভারী করার জন্যে আমার এক প্রতিবেশী বৌদি এরকম খবর রসিয়ে বলতে এসেছিল, কিন্তু আমার স্ত্রী এই ব্যাপারে কোনো কৌতূহল না দেখানোতে  ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন।

 রাশিয়াতে থাকাকালীন অনেক সাধারণ  উপহার দ্রব্যের সামগ্রীর দোকানে ঘোরাঘুরি করেছিলাম, কিন্তু তেমন কোনো সৌখিন জিনিস চোখে পড়ত না।  ছোটখাট উপহার দেবার সামগ্রী, ওখানের বিখ্যাত দর্শনীয় জায়গার ল্যামিনেটেড  ফটো ফ্রেম পাওয়া যেত, সেরকম কয়েকটি কিনে এনেছিলাম। ওখানে মাদার মেরী ও যিশুর একরকমের ছবি একটি দোকান থেকে বেশ  সুদৃশ্য  ফ্রেমে কিনে এনেছিলাম। এতবড় মাপের এই ছবি সহজে ওখানের অনেক দোকানে খুঁজে পাই নি।  একদিন কথায় কথায় এই ফ্রেম ওয়ালা ছবির কথা শ্রী রাওয়ের সামনে বলাতে উনি ওনার স্ত্রীকে দিয়ে ওই ছবিটা ওনাকে দিতে বিশেষ অনুরোধ    করলেন,পরিবর্তে ওর কাছে থাকা পাইন কাঠের উপর কাপড়ের উপরে রাখা একটি ছবি দিতে  চাইলেন। বসের স্ত্রী বলে কথা, অনুরোধ ফেলতে পারি নি সেদিন। আমার বাড়ির দেওয়ালে সেই ছোট ছবিটি আজও  রয়ে গেছে, তবে এতদিনে বেশ বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেদিকে তাকালে আমার ওই বড় ফ্রেমে বাধানো ছবিটার কথা এখনও  মনে পড়ে।  বসেদের এই লোভী প্রবৃত্তি এখনও  সর্বত্র রয়েছে এবং এগুলো ঠেকানো সময়ে সময়ে বেশ মুস্কিল হয়ে পড়ে।   তবে ডলার শপে গিয়ে ভালো জিনিস কিছুতেই আর চোখে পড়ে নি. তবুও শেষ মুহুর্তের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এবারে আমার জুতো  আর ছেলেদের গরম জামা কেনার অভিজ্ঞতা দিয়েই এখানে কেনাকাটার গল্প শেষ করব.
জুতো  কেনাটা অতি অবশ্য   দরকার হয়ে পড়েছিল।  অবশেষে আমাদের এক দোভাষী আমাকে দোনেত্স্ক শহরের এক বড় জুতোর দোকানে নিয়ে গেল। ওখানের সেই হাস্যময় সেলসম্যান আমার পায়ের রোগা ও ছোট চেহারা দেখে আমাকে বাচ্চাদের বিভাগে নিয়ে গেলেন।  সেখানে অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরে এবং অনেক জুতোতে  পা গলিয়ে মোটামুটি একটি জুতো  পাওয়া গেল, যেটা আবার দুটো মোজা  পড়ে পড়তে হত।  তবে এই জুতাটি খুবই টেকসই এবং বেশ গরম।  ভিতরে গরম লেস দিয়ে মোড়া।  ঠান্ডা কোনমতেই ঢুকতে পারবে না।  তবে বেশ ভারী।  ওটা  পড়েই  আমি দেশে ফিরেছিলাম। তবে এখানে ওই জুতোর কোনো প্রয়োজন হবে না।  শেষে ওটা একজনকে  ট্রেকিঙের  জন্যে দিয়ে দিয়েছিলাম। ছেলেদের গরম জামা কিনতে গিয়েও ঝকমারি। ওখানে বয়স বলে যে জামা দেখায় সেটা বোধহয় আমারও  বড় হবে।  শেষকালে ওই ভদ্রলোকের  সহায়তায়  দুটো জামা পছন্দ হলো ,তবে দেশে ফিরে সেটি পড়তে ওদের দু এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তবে হরেক লোকের হরেক রকমের পছন্দ এবং সেগুলো বেশ অদ্ভূত। আমার সহকর্মী তেজবাহাদুর  ওখান থেকে একগাদা স্টিলের বাসন  এনেছিল।   ওগুলো হয়ত  খুবই খাঁটি কিন্তু কিরকম যেন কালচে  ও ম্যাটমেটে।

 রাশিয়াতে বিভিন্ন জায়গাতে আমাদের নানা কলকারখানা দেখার কোনো বিশদ বিবরণ  চাই না  এই  ব্লগে।  তবে  বলতে চাই , যে এই সময়ে বিভিন্ন জায়গাতে আমাদের যেমন সমাদর ও বিপুল অভ্যর্থনা করা হয়েছে সেগুলো কল্পনাতীত। আমরা  তার যোগ্য ছিলাম কিনা সে বিষয়ে আমার মনে অন্তত বেশ সন্দেহ  ছিল।  ওখানে একটি ইস্পাত তৈরির কারখানাতে আমাদের জন্যে  ভিডিও ছবি   তোলার  ব্যবস্থা হয়েছিল এবং ওখানে থাকাকালীন বিভিন্ন জায়গাতে আমাদের ছবি তুলে আমরা থাকতে থাকতেই সেই ছবির প্রিন্ট বানিয়ে সবাইয়ের হাতে এক কপি তুলে দেওয়া হয়েছিল। অন্য যে সব কল কারখানাতে বিশেষ   ধরনের উষ্মসহ  ইঁট  ও চুল্লির আস্তরণ তৈরির ব্যবস্থা দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছিল, সেগুলো দেখে আমরা খুবই খুসি ও হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এরকম ধরনের উত্পাদিত বস্তু আমাদের ভারতের কেরালা প্রদেশে  তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।  দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে পরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে এই পরিকল্পনা কার্যকরী হয়ে ওঠে নি।  এই সময়ে বিভিন্ন শহরে আমাদের সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত বিশেষ ধরনের  খাবার দাবার ও রাশিয়ান ও বিদেশী দামী মদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল প্রায় প্রতিদিন।  এই সময়ে ওদের আতিথেয়তা  কোনদিন   ভুলতে পারব না।

 লেনিনগ্রাদে থাকাকালীন ওখানের দোভাষী মহিলা কর্মী আমাদের দুটি বিখ্যাত জায়গা দেখাতে নিয়ে যান।   এখানে প্রবেশের জন্যে আগে থেকে সরকারী অনুমতিপত্র প্রয়োজন, তা ছাড়া  প্রবেশ মূল্য বেশ চড়া।  আমাদের দোভাষী সমস্ত ব্যবস্থা আগাম করে নিয়েছিলেন। এই দুটি জায়গা দর্শনের স্মৃতি আজও  সদা জাগরুক।
প্রথমটি হলো নেভা নদীর তীরে অবস্থিত জাদুঘর হার্মিতাজ ( Hermitage) . এই জাদুঘরটি বিশ্বের সব থেকে প্রাচীন ,বিশাল ও মূল্যবান মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে।  এই জাদুঘরের বিশাল বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সম্ভার ছটি বড় বাড়িতে অবস্থিত।  এর মুখ্য বাড়িটি ছিল রাশিয়ার  জারেদের প্রধান কার্যালয়।  এটি ছিল শীতকালীন রাজপ্রাসাদ।  বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা বরেণ্য শিল্পী ও চিত্রকরদের  অমূল্য চিত্রকলা ও অন্য সংস্কৃতি সংগ্রহ করে  এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
রাশিয়ান জারিনা ক্যাথরিন দি গ্রেট ১৭৬৪  ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে মহামূল্যবান ২০০টির বেশি চিত্রকলা কিনে এনে এই জাদুঘরের  সূত্রপাত করেন।  প্রথম দিকে এটি  ক্যাথারিনের  নিজস্ব জাদুঘর ছিল এবং খুব কম লোকই এটিকে  দেখতে   পারতেন। ক্রমশ: এটি অমূল্য সম্ভারে পরিপূর্ণ হতে  থাকে।  অবশেষে ১৮৫২ সালে জার  নিকোলাস  ১ এটিকে সর্বসাধারণের  জন্যে   উন্মুক্ত করে দেন।
এই জাদুঘরে পাশ্চাত্য শিল্পের বিশিষ্ট শিল্পী  Michelangelo,Leonardo Da Vinci,Rubens, van Dyck, Rembrandt, Poussoin,Claude Lorrain, Watteau, Tiepolo, Canaletto, Canova, Rodin, Monet, Pissaro,Renoir, Cezane,Van gaugh, Gauguin, Picasso & Matisse  দের  অপূর্ব শিল্পকর্ম বিশাল বিশাল সুদৃশ্য হলঘরে সুন্দরভাবে রাখা আছে।  এই  বাড়িটিও একদিনে দেখা সম্ভব নয়।  তাছাড়া এখানে প্রবেশের টিকিট পাওয়াও খুবই মুস্কিল।  রাশিয়ান এমব্যাসীর কর্মীদের সহায়তায় আমরা এই মিউজিয়াম দেখতে পেরে খুবই  মুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ সকলের কাছে। এখানে আমাদের জন্যে বিশেষ করে ছবি তোলার অনুমতি পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সেগুলির প্রিন্ট পাওয়ার পরে খুবই হতাশ হয়েছিলাম। শুধু বুকের মধ্যে সেই  জাদুঘরের অনবদ্য বেশ কিছু দৃশ্য  আজও দেখতে পাই ও অনুভব করি।  

  আরেকটি বিখ্যাত জায়গা দেখতে গিয়েছিলাম এই  সময়ে।  লেনিনগ্রাদ থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক ও কবি আলেক্সান্দার পুশকিনের  নামাঙ্কিত পুশকিন শহরে। এটি ১৭০৮ সালে তদানীন্তন জার  শাসকের নামে স্থাপিত হলেও ,অনেক ওঠানামার পরে ১৯৩৭ সালে পুশকিনের শততম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এটিকে পুশকিন নামে অভিহিত করা হয়।  ওখানেও বিশাল রাজকীয় প্রাসাদ ও সুন্দর জাদুঘর ও সংগ্রহশালা নির্মিত  হয়েছে।  ওখানে অনেক কষ্টে অনুমতি পেয়ে দোভাষীর সঙ্গে আমরা এই জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলাম। এই জাদুঘর  হার্মিতাজের মতন লোকের ভিড়ে ঠাসা নয়।  তবে এখানেও খুবই সুন্দর সুন্দর চিত্রকলা ও অন্যান্য  সামগ্রীর সম্ভার সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে।  সব কিছুতেই অপূর্ব নিপুণতা, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার চাপ সবাইকে মুগ্ধ করবে।  প্রবেশের আগেই আলেক্সান্দার পুশকিনের বিশাল মূর্তি জাদুঘরের দিকে মুখ করে আছে।  ভিতরেও আরও মূর্তি দেখেছিলাম। 

   এইভাবে কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে আমাদের রাশিয়া সফর প্রায় শেষপথে  এসে হাজির হলো।  আমরা লেনিনগ্রাদ থেকে রাত্রের বিমানে  মস্কো ফিরে এলাম শেষের কদিনের অপেক্ষায়।  ওখানে সফরের কর্মব্যস্ততার মধ্যে কোনো শহরের অনেক কিছু দর্শনীয়  জায়গাতেই যাওয়া সম্ভব হয় নি।  তবে মস্কো থেকে লেনিনগ্রাদে যাওয়ার আগে রাশিয়ান দূতাবাসের এক বরিষ্ঠ  দোভাষী কে বিশেষ করে রাশিয়ার বিখ্যাত টিভি টাওয়ার যেটি (Ostankino Tower) নামে খ্যাত, সেটি দেখার অনুমতির ব্যবস্থা করতে বিশেষ ভাবে বলে গিয়েছিলাম। এটির উচ্চতা ছিল ৫৪০ মিটার(১৭৭২ ফুট ). ১৯৭৬ সালে কানাডার টরন্টোর সি এন এন টাওয়ারের গঠনের পূর্বে এটি ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ Free Standing Tower . আরও শুনেছিলাম যে এই টাওয়ারের একেবারে উপরে একটি ঘূর্ণায়মান রেস্তোরা (The Seventh Heaven Restaurant)  আছে।  সেখানে খাওয়ার খরচ খুব বেশি ছাড়া  সেখানে জায়গা পেতে হলে কূটনৈতিক অনুমতি একান্তই আবশ্যক।  আমাদের রাশিয়ান দূতাবাসের বন্ধুদের আগে থেকে সবিশেষ অনুরোধ  করাতে তারা ওখানে আমাদের যাবার এবং ওই রেস্তুরান্তে খাবার  ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এই টিভি টাওয়ারের গঠন শৈলী দেখবার মত।  ওখানে গিয়ে লিফটে চড়ে উপরে যাবার সময় তীব্র গতির ফলে কান বন্ধ   হয়ে গিয়েছিল।  ওখানে সর্বাধিক উঁচু দর্শক গ্যালারী থেকে সমস্ত মস্কো শহরের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।  এই পর্যন্ত সাধারণ দর্শকদের প্রবেশাধিকার থাকে।  এর পরে আমরা মান্যগণ্য অতিথির জন্যে  একটি বিশেষ সিঁড়ি দিয়ে রেস্তরাতে গেলাম। পুরো গোলাকার এই রেস্তোরা অতি সুন্দর ও সুদৃশ্য ভাবে সাজানো।  আমরা চারজন ও রাশিয়ান দূতাবাসের দুজন দোভাষী মহিলা  একটা টেবিলে গোল হয়ে বসলাম। চারদিক দিয়ে বাইরের দৃশ্য সুন্দর ও স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছিল।  রেস্তোরাটি এত ধীরে ঘোরে , যে প্রথমে কিছু বোঝা যায় না। অর্ডার দেওয়া  খাবার খেতে খেতে কিছু বাদেই বাইরে তাকিয়ে দেখি পটভূমিকা বদলে গেছে। তখন বুঝতে পারলাম যে এটি খুবই ধীরে ঘুরছে এবং  জন্যে এই বদল।  ওখানে খেতে গিয়ে এক বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছিল।  ওদের বিখ্যাত ও দামী খাবার ক্যাভুরি আমাদের জন্যে অর্ডার দেওয়া হয়েছিল।  এটি ছোট ছোট কালো কালো মাছের ডিমের মত।  ওরা এগুলি খুব চেটেপুটে খায়।  এটি খুব দামী ও খানদানী খাবার ,সেটা আমাদের আগে বলা হয়েছিল।  কিন্তু একটু মুখে দিতেই সারা পেটের  মধ্যে গুলিয়ে উঠেছিল, বমি হওয়ার উপক্রম।  তাকিয়ে দেখি সবারই একই অবস্থা ,ব্যতিক্রম শুধু দুই রাশিয়ান মহিলা।  কোনরকমে অল্প স্বল্প খেয়ে ভদ্রতা রক্ষা করেছিলাম, কিন্তু আজও সেই অদ্ভূত খাওয়ার স্বাদের অভিজ্ঞতা ভুলতে পারি নি।  
পরে শুনে খুব দু:খিত হয়েছিলাম, যে ২০০০ সালের ২৭শে  আগস্টের এক বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে ওই টাওয়ারের  রেস্তোরাটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। কিছু প্রাণহানিও ঘটে।   

  একুশ দিনের  রাশিয়া সফর প্রায় শেষ হয়ে এলো।  এখান থেকে অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরছি।  এখানে না এলে এই দেশ সম্বন্ধে অনেক না জানা ও ভ্রান্ত ধারনা থেকে যেত মনের মধ্যে।  তার জন্যেই আমার কোম্পানির কাছে খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করছি।  রাশিয়ার এই সফরের একেবারে বিদায় লগ্নে যে ঘটনাটি আমাকে বিশেষ ভাবে নাড়া  দিয়েছিল  তার স্মৃতি ও রেশ আজও প্রতিবছরের ৮ই মার্চ থেকে নতুন করে রোমন্থন করি।  আমাদের রাশিয়া থেকে  আসার দিনটি ছিল ৮ই মার্চ। ততদিন পর্যন্ত আমি এই দিনটির আন্তর্জাতিক তাত্পর্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল   ছিলাম না।   এটা  আমারই   অজ্ঞতা।  আগেই জানিয়েছি ,রাশিয়াতে আসার কয়েকদিনের মধ্যে এদেশের মেয়েদের সমস্ত কার্যে নিয়োজিত হওয়া বিশেষ ভাবে নজরে পড়েছিল।  আসার দুচার দিন আগে থেকেই মস্কো শহরের চারিদিকের সমস্ত দোকান, বাজার, রেস্তঁরা ও অন্যান্য জায়গাতে খুব সাজগোজের বাহার লক্ষ্য করেছিলাম। লোকজনদের  কারণ জিজ্ঞাসা করাতে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলাম।  জবাব এলো, জানোনা  ঐদিন তো আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের  দিন. সেই উপলক্ষেই এই সব সাজগোজের আয়োজন চারিদিকে। জানলাম ওই দিনটিতে সারা রাশিয়াতে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বিশেষ সমারোহে  পালিত হয় নারীদের অধিকার,স্বাতন্ত্র্য, সুখ সুবিধা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের  অধিকারের দাবিতে।  এই আন্দোলন বহু বছর আগে ইউরোপ,আমেরিকার অন্য শহরের সাথে রাশিয়াতে সূত্রপাত ঘটেছিল।  সেদিন নাকি রাশিয়ার বেশির ভাগ শহরের কর্তৃত্ব মেয়েদের হাতেই চলে যায়।  মেয়েরা শহরের সর্বত্র সেদিন আনন্দ উল্লাস ,হই চৈ, সমাবেশ ,গান বাজনা ইত্যাদি নিয়ে মেতে ওঠে।  সেদিন কোনো জায়গাতে ছেলেদের বলতে গেলে  প্রবেশাধিকার থাকে না।  আমাদের হোটেলের  সমস্ত জায়গা  মনোরম সাজে সজ্জিত করা হয়েছিল।  নিচের রেস্তোরা কে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল ,যেন মনে হচ্ছিল স্বর্গপুরী।  আমাদের প্লেন ছিল রাত দুটোতে।  দুপুরে কিছু খাবার স্তলোবায়া থেকে কিনে রেখেছিলাম। সেগুলো দিয়ে রাত্রের খাওয়া সমাধা করে আমি শেষবারের মত সমস্ত কিছু দেখে নিয়ে মালপত্র সুটকেসে  গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। হঠাত দেখি আমার সঙ্গী তেজবাহাদুর ঘরে নেই।  কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে ওর খোঁজে  নেমে গেলাম। রেস্তরার ভিতরে যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না. সেখানে তখন বিভিন্ন সাজে সুসজ্জিতা রাশিয়ান সুন্দরীদের ভিড়।  অনেকক্ষণ খেয়াল করার পর  কালোকোট  পরা তেজ্বাহাদুরকে নজর করলাম। সবিস্ময়ে দেখলাম যে ওকে ঘিরে রাশিয়ান সুন্দরীরা বৃত্তাকারে  উদ্দাম গতিতে নেচে চলেছে আর বেচারা তেজ্বাহাদুরকে ওদের সঙ্গে অদ্ভূত ভঙ্গিমায় হাত পা ছুঁড়ে নাচতে বাধ্য করেছেন।  সবাই মদ খেয়ে এত মত্ত যে ওদের কবল থেকে তেজ্বাহাদুরকে ছাড়িয়ে আনা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।  শেষে মরীয়া হয়ে হোটেলের একটি মহিলাকে কোনক্রমে তেজ্বাহাদুরকে দেখিয়ে ডেকে আনতে বললাম। এর পরে অতি  কষ্টে  তাকে ওখান থেকে বার করে সোজা বগলদাবা করে উপরে চলে এলাম। খুব বকাবকি করে ওকে একটু ধাতস্থ করে ওর  জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে সাহায্য করলাম। অবশেষে বিদায় নেবার সময় হয়ে এলো।  গায়ে শীতের জোব্বা চাপিয়ে  হোটেল থেকে বেরিয়ে   এলাম ,  তখনও সঙ্গীত ও নাচের মূর্ছনা কানে ভেসে আসছিল।  সেই শুনতে শুনতে এবং এক অবিস্মরনীয়  সন্ধ্যার স্মৃতি নিয়ে গাড়ি আমাদের বিমানবন্দরের দিকে নিয়ে  চলল।  
 মনে আসছিল কবিগুরুর সেই গান: 
   
  আজি এ আনন্দসন্ধ্যা সুন্দর বিকাশে , আহা।  
        মন্দ পবনে আজি ভাসে আকাশে 
        বিধুর ব্যাকুল মধুমাধুরী ,আহা।  
        স্তব্ধ গগনে গ্রহতারা নীরবে 
       কিরণসঙ্গীতে সুধা বরষে , আহা।  
প্রাণ মন মম ধীরে ধীরে প্রসাদরসে আসে  ভরি, 
      দেহ পুলকিত উদার হরষে ,আহা।   
        

      

Friday, October 10, 2014

উত্তর কলকাতার দে-মল্লিক বাড়ির সুপ্রাচীন কুলদেবী শ্রী শ্রী সিংহবাহিনী মাতার পূজার বর্ণনা ও ইতিহাস

ভূমিকা 

২০১৩ সালের আনন্দবাজার পত্রিকার ৭ অক্টোবরের 'কলকাতার কড়চা ' বিভাগের এক প্রতিবেদনে সর্বপ্রথম উত্তর কলকাতায় বাংলার দে-মল্লিক পরিবারের  এক সুপ্রাচীন কুলদেবী  সিংহ বাহিনী মাতার পূজার কথা জানতে পেরেছিলাম। ওই সূত্রে আরও জানতে পেরেছিলাম যে ওই বছরে এই  চারশো বছরের পূজা উপাসনা সম্পন্ন হবে ৩৯ নম্বর জ্যোতিন্দ্রমোহন এভেনিউএর  হেমেন্দ্রমোহন মল্লিকের বিশাল বাসভবনে।  খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিলাম যে, এই স্থানটি অরবিন্দ সরণি ও জ্যোতিরিন্দ্রমোহন এভিনিউ র  সংযোগস্থলের কাছাকাছি।

দেবীদর্শন 

আমরা উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ির পূজাপরিক্রমা চলাকাকীন  ঠনঠনিয়ার দ্বারিকাভবনের দত্তবাড়ির প্রতিমা দর্শন সমাপ্ত করে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট ধরে চিত্তরঞ্জন এভিনিউ ধরে  দিকে কিছুটা এগোতেই অরবিন্দ  সরণির অদূরে সুসজ্জিত হেমেন্দ্র মল্লিকের বাসভবন সহজেই পেয়ে গেলাম। বাড়িতে প্রবেশ করার সময়ে ওদের সুসজ্জিত প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে  ঢুকেই  মনে হলো এক স্বপ্ন পুরিতে এসে পড়েছি।



আগে এই উত্তর কলকাতার অনেক বনেদী বাড়িতে গেছি, কিন্তু কোথাও  এরকম পেশাদারীত্বের সঙ্গে বনেদিয়ানার মেলবন্ধন  দেখি নি।  ভিতরের প্রশস্ত পূজাপ্রাঙ্গন বহু লোকের ভিড়ে এবং মায়াময় পরিবেশে খুবই সুন্দর লাগছিল।  প্রাঙ্গনের  চতুর্দিকে এবং নিচ থেকে উপরে মৃদু আলোতে এবং অপরূপ অঙ্গসজ্জায় সজ্জিত ছিল।  






ভিড় এড়িয়ে সিংহবাহিনী  দেবীর পূজামন্ডপে হাজির হলাম। এক হাত প্রতিমা অষ্টধাতুময় চতুর্ভুজা শ্রী শ্রী সিংহবাহিনী দেবীমাতাকে  পুষ্হ্পমাল্যের মধ্যে আবৃত দেখলাম। শুভ্র ধাতুর সিংহাসনের উপরে নীল চাঁদোয়ার নিচে সগৌরবে বিরাজমান এই দেবী।  এই দেবীমূর্তি হস্তিমুণ্ড পারিপদ রক্ষা করে সিংহপৃষ্ঠাধিষ্ঠিত  শঙ্খ -চক্র -ধনুর্বাণ ধারণ করে আছেন।  শিরোশোভা  ধাতুময় পঞ্চমুন্ড রজতকিরীট ,ধাতুময় বস্ত্রদ্বারা আবৃতা।   





পূজামন্ডপের  সবকিছুতেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও নিপূণ পেশাদারিত্বের ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়।  
দেবীর দক্ষিণ পার্শ্বে রক্তবসনাবৃত নবপত্রিকা এবং বাম পার্শ্বে লাল পাড়  শাড়িতে আবৃত লক্ষ্মীর ঝাঁপি দেখতে পাওয়া যায়।  ওই ঝাঁপিতে সোনার চোখ ও সোনার  নাক দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল।   এটি সুবর্ণ বনিক সম্প্রদায়ের একটি প্রচলিত রেওয়াজ। অন্য বাড়িতেও এরূপ রেওয়াজ চোখে পড়েছিল।  



প্রতিমা প্রবেশের মুখে দুটি সুন্দর ভেনাসের প্রতিমূর্তি রাখা রয়েছে।  মৃদু স্বরে  সঙ্গীতের  মূর্ছনা  এক  স্বর্গীয়  পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল।  
আমার কন্যাসমা  এক পরিচিত বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম যে এই সিংহবাহিনী মাতার এক সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে।  এছাড়া এই দেবীর পূজার সাথে এই -মল্লিক পরিবারের এক সুদীর্ঘ সম্পর্কেরও  এক যোগাযোগ রয়েছে। এই বাড়িতে পূজার সমস্ত পরিচালনা বাড়ির প্রবীণ  সদস্যেরা সুন্দরভাবে সম্পন্ন   করছিলেন।  এই মন্ডপে  নামমাত্র মূল্যে এই সিংহ বাহিনী  দেবীর পূজার ইতিহাস ও দে-মল্লিক বাড়ির সঙ্গে এই পূজার যোগাযোগ সম্বলিত একটি তথ্যপুস্তিকা  অভ্যাগত অতিথিদের বিতরণ করা হচ্ছিল। মন্ডপ থেকে বেরোনোর আগে প্যাকেটে করে ভোগ সামগ্রী দর্শকদের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন এক বর্ষীয়ান  ভদ্রলোক।  

হেমেন্দ্র মল্লিকের  বাড়িতে চারশো বছরের পূজার বিশেষত্ব 

দে -মল্লিক বংশের শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনী দেবীর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শ্রী বৈদ্যনাথ মল্লিকের পরিবার  চারশো বছরে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।  এখন এদের প্রায় সর্বসমেত ৪৫০ শরিক রয়েছে। প্রতিবছরে নতুন নতুন শরিকের বাড়িতে পালা করে এই দেবীমাতার পূজা করা হয়ে থাকে।  এবারে এই পূজার চারশো বছরের পূর্তি উপলক্ষে হেমেন্দ্র মল্লিকের বাড়ি পছন্দ করার অনেকগুলি কারণ রয়েছে।  প্রথমত হেমেন বাবুর বাড়িতে এক বিশাল পরিসরের বনেদী ঠাকুর দালান রয়েছে।  এই দেবী মাতার  পূজার বিশেষ বছরে মহাসমারহে অত্যধিক সংখ্যক অতিথি অভ্যাগত ও আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে  আদর অভ্যর্থনা এখানেই করা সম্ভবপর ছিল।  হেমেন বাবুর  বাড়িতে শেষবার ১৯৯২ সালে এই দেবীমাতার পূজা সম্পন্ন হয়েছিল।  এই বাড়ির মেয়ে ও বৌয়েরা যাদের গত এক দশকের মধ্যে বিয়ে হয়েছে তাঁরা এই বছরে সর্বপ্রথম  এই বাড়িতে পূজা হওয়াতে আনন্দে আত্মহারা।  সবাই অতিথি অভ্যাগতদের আদর যত্নে আত্মহারা  ছিলেন।  
হেমেন বাবু এই দেবীমাতার বড়বাজারের বিলাস রায় কাটরায় অবস্থিত দেবোত্তর সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে নিযুক্ত আছেন।  

এই শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনী দেবীমাতার বিসর্জন হয় না।  বিজয়া দশমীর প্রথাগত বিসর্জনের পরেই এই দেবীমাতা অন্য এক শরিকের বাড়িতে  তাঁর সিংহাসন সমেত চলে যান।  সেখানেই এই দেবীমাতার নিত্যপূজা অনুষ্ঠিত হয় সকাল ও সন্ধ্যাতে।  হেমেন মল্লিকের বাড়ির এক প্রতিনিধি সূত্রে জানা   গেছে যে এই দেবীমাতা সারা বছর  বিভিন্ন শরিকের বাড়িতে পালা করে নিত্য পূজিতা হন।  
 গতবছরে সপ্তমীর দিন  সকালে এই দেবীমাতা শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনীকে  শোভাযাত্রা সহকারে  হাঁসপুকুরের এক শরিকের বাড়ি থেকে হেমেন মল্লিকের বাড়িতে আনা হয়েছিল।  ষষ্ঠীর দিন রাত্রে ঘটে দেবীর বোধন সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।  মল্লিক বাড়ির লোকেরা বৈষ্ণব  ধর্মাবলম্বী হলেও শাক্ত মতে দেবীমাতার পূজা সম্পন্ন হয়।  পূজার তিন দিন অর্থাত  সপ্তমী,অষ্টমী ও নবমী  তে প্রতিবছর পাঠা বলি দেওয়া হয়।  কিন্তু এই  মাংস বাড়ির লোকেরা স্পর্শ করেন না।  দেবীমাতার অন্নভোগ হয় না।  নানা রকমের ফল ও মিঠাই ছাড়া বিভিন্ন রকমের ভাজা খাবার যথা লুচি, সিঙ্গারা, কচুরী  ইত্যাদি ভোগ হিসাবে দেবীমাতাকে নিবেদন করা হয়।  ভোগের দ্রব্যসামগ্রীতে কোন নুন, ঝাল বা টমেটো ব্যবহার করা হয় না. তবুও ভোগের স্বাদ খুবই সুস্বাদু হয়।  

  বাড়ির মহিলারা পূজার সময় সাবেকি গহনা দিয়ে নিজেদের সুসজ্জিত করেন। বাড়ির একজন বয়স্কা মহিলার কথাতে জানা গেল  যে পূজার সময় তাঁরা কোমরে বিছে  গোট , নাকে বড় নথ ,হাতে নানা বর্ণের রুলি ও পায়ে মল পড়েন।  মহাষ্টমীর  সন্ধিপূজার সময় বাড়ির সধবা মহিলারা লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরে ধুনা পোড়ানোর অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।  
২০১৪ সালে এই শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনী দেবীমাতার পূজার পালা পড়েছে   এদের অন্য এক শরিক প্রয়াত  কাশীনাথ মল্লিকের সিন্দুরিযাপট্টিতে অবস্থিত ঠাকুরবাড়িতে। প্রয়াত কাশীনাথ মল্লিক ছিলেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণের পরম ভক্ত। এই ঠাকুরবাড়িতে দেবী সিংহ বাহিনীর মূর্তি দর্শন  উপলক্ষে ঠাকুর শ্রী  রামকৃষ্ণ শুভাগমন করেছিলেন। ২০১৪ সালে কাশীনাথ মল্লিকের বর্তমান প্রজন্ম  শ্রী বৈদ্যনাথ মল্লিকের ১৪২ মহাত্মা গান্ধী রোডের বাড়িতে এবারে দেবীমাতার পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি মহাত্মা গান্ধী রোড ও রবীন্দ্র সরণির  সংযোগস্থলে রাস্তার ওপরেই লোহার  ফটকওয়ালা  বাড়ি।  

শ্রী শ্রী সিংহবাহিনী দেবীমাতার ইতিহাস ও দে-মল্লিক বাড়ির সহিত সম্পর্ক 

দেবীমাতা শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনীর এক চমকপ্রদ ইতিহাস আছে।  এই দেবী মূর্তির অর্চনার সঙ্গে এই দে-মল্লিক পরিবারের  সম্পর্ক অতি সুপ্রাচীন, আনুমাণিক চারশো বছরের।  
প্রাচীন ইতিহাস গবেষণা ও পর্যালোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায়  যে,আনুমাণিক ইংরাজী ৬০০ খ্রীস্টাব্দে বৈশ্য বংশীয়  পূশ্যভুতির বংশধর রাজা হর্ষবর্ধনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজা রাজ্যবর্ধন দেবের কুলদেবী ছিলেন এই দেবীমাতা শ্রী শ্রী সিংহবাহিনী।  বৈশ্য  কুলদেবী এই দেবীমাতাকে এক সময় জয়পুর রাজ ভগবানদাসের ভ্রাতুষ্পুত্র মহারাজ মানসিংহ  ছলে, বলে, কৌশলে ও নীতিবহির্ভূত কোনো   উপায়ে  অপসারিত করে নিজ গৃহে তাঁর গৃহদেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন।  কথিত আছে যে রাজা মানসিংহের মৃত্যুর পরে পূজার দায়িত্বে থাকা ব্রাহ্মণ পুজারী মুসলমান নবাবের হাত থেকে রক্ষা করার   জন্যে  দেবী সিংহবাহিনীর মূর্তি নিয়ে অধুনা বাংলা দেশের চট্টগ্রামে চলে যান এবং ওখানের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের  গুহায় নির্জনে পূজা করতে  থাকেন।  

     এবারে এই দে -মল্লিক বংশের  পূর্ব ইতিহাস শোনা গেলে এদের সহিত শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনী মাতার পূজার সম্পর্ক বুঝতে সহজ হবে।  বর্তমানে শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনী দেবীমাতা কলকাতার অতি প্রাচীন বাংলার শ্রীসম্পন্ন ও খ্যাতনামা গৌতম গোত্রীয়  দে- মল্লিক বংশের কুলদেবী।  প্রাচীন ঐতিহ্যময় এই সুবর্ণ বণিক পরিবারটির জাতিগত পদবী 'দে।' এই বৈশ্য বংশের উত্পত্তি  অযোধ্যা প্রদেশের রামগড় নগরে।  বংশের আদি পুরুষ  সোমভদ্র দে'র স্বর্ণ ব্যবসা  ছিল।  তারপর দীর্ঘ দিনের ব্যবধানে  প্রায় -দশম দ্বাদশ উত্তর  পুরুষ পরে মুসলিম রাজত্বে 'মল্লিক' উপাধি অর্জিত হয়।  সম্রাট আকবরের  রাজত্বকালে এই পরিবারের অন্যতম পূর্বপুরুষ বনমালী মল্লিক হুগলী জেলার ত্রিবেণী তীরে সুবিশাল জমিদারির পত্তন করেন।  বনমালী মল্লিক এই জমিদারী থেকে প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হন।  নদীয়া জেলার 
 কাঁচরাপাড়ায়  তাঁর একটি আবাদ ছিল।  এই আবাদের পাশে তিনি খাল কাটিয়েছিলেন।  এই খালটি আজও 'মল্লিক খাল' বলে পরিচিত।  তাঁরই সুযোগ্য পুত্র বৈদ্যনাথ মল্লিক স্বপ্নাদেশে শ্রী শ্রী সিংহবাহিনী দেবীমাতা  প্রাপ্ত হন।  

    আনুমাণিক ১০২০ বঙ্গাব্দে এই মল্লিক বংশের পূর্বপুরুষ শ্রী বৈদ্যনাথ মল্লিক কর্মান্তরে  বাংলা দেশের ঢাকা শহরে গমন করেন।  সেইখানে তিনি আদিম পূর্বপুরুষ বৈশ্য রাজা রাজ্যবর্ধন দেবের কুলদেবী শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনীর    মাহাত্ম্য ও অনন্যসাধারণ  মহিমার কথা শুনতে   পান।  তিনি আরও অবগত হন যে শ্রী শ্রী দেবীমাতা  মহারাজা মানসিংহের পুজারী কর্তৃক  চট্টগ্রাম পাহাড়ের গুহামধ্যে গোপনে পূজিতা হচ্ছেন।  তিনি ততক্ষনাত দেবীদর্শনের মানসে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গমন করেন  এবং সেখানে দেবী কর্তৃক সাধু ও নিজে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে দেবীমাতা প্রাপ্ত হন এবং স্বদেশে সপ্তগ্রামে নিয়ে আসেন।  

      শুভ গোবিন্দ দ্বাদশী তিথিতে দেবীমাতা শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনী মল্লিক বংশে প্রতিষ্ঠিতা হন।  বিগত চারশো বছর এই পরিবার  সগৌরবে এই  পূজা করে আসছেন।  সরস্বতী নদী মজে যাওয়াতে ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে যুক্ত জাহাজাদির চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে  সপ্তগ্রামের পতন ঘটে।  অন্যদিকে কলকাতা নগরীর  শ্রী সম্পদ  বৃদ্ধির সঙ্গেসঙ্গে এই মল্লিক পরিবার  স্থায়ীভাবে কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে ব্যবসা এবং বসবাসের জন্যে চলে আসেন।  সেই  অবধি দেবীমাতা শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনী   কলিকাতা নগরে অধিষ্ঠিতা আছেন।  

   এবারে এই দেবীমাতা শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনী মূর্তির কিছু বর্ণনা দেওয়া যাক।  এক হস্ত পরিমিত  অষ্টধাতুময় চতুর্ভূজা  শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনী দেবীমূর্তি  হস্তীমুন্ড পারিপদ রক্ষা করে  সিংহ পৃষ্ঠস্থিতা  শঙ্খ -চক্র-ধনুর্বাণ  ধারণ করে আছেন।    শিরোশোভা ধাতুময়  পঞ্চমুন্ডময়  রাজকিরীট ,ধাতুময় বস্ত্রদ্বারা আবৃতা।  উল্লেখিত ধাতুময় বস্ত্রে  খোদিত নানারূপ কারুকার্য  ও তত্সঙ্গে রাজা রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধনের সময়ে প্রচলিত ভাষার অক্ষরে খোদিত ছিল।  তেজময়ী দীপ্তি-বিস্ফোরিতা ত্রিনয়ন -বাত্সল্য ও দৃঢ়তায় পরমাজ্জ্বল, শ্রী শ্রী সিংহ বাহিনী  দেবীমাতা গঠনে বঙ্গদেশীয় অন্যান্য দেবীমূর্তির সহিত  সাদৃস্যবিহীন।     

Sunday, September 14, 2014

পূণ্যভূমি দক্ষিণ পাসাডেনার বিবেকানন্দ হাউস -দ্বিতীয় পর্ব

ভূমিকা 

স্বামী বিবেকানন্দের দক্ষিণ পাসাডেনার ৩০৯ নম্বর মন্টেরী রোডে অবস্থিত মীড ভগিনীদের বাসভবনে আগমনের ঘটনা এবং কালক্রমে সেই বাসভবনের  পুণ্য স্মৃতি হিসাবে বিবেকানন্দ হাউস নামে পরিচিত হবার বিশদ বিবরণ আগের পর্বে আলোচিত হয়েছে। এই পর্বে এই বাসভবনে অবস্থানকালীন স্বামীজীর সমস্ত কিছু কার্যকলাপ ,তাঁর খাওয়া দাওয়া , পোশাক- আশাক, সবাইয়ের সাথে বাড়ির একজন লোকেদের মত চাল চলনের কথা বিশদ ভাবে আলোচনা করার প্রয়াস করব।  এই সমস্ত থেকে স্বামীজীর সম্বন্ধে পাঠক কুলের একটি অন্যরূপ ধারণা প্রকাশ পেতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।  

    মন্টেরী  রোডের রাস্তার বিপরীত থেকে বিবেকানন্দ হাউসের দৃশ্য



স্বামীজী যখন মীড ভগিনীদের বাড়িতে আগমন করলেন সেই সময়ে ওই বাসভবনে মীড পরিবারের অনেক সদস্য থাকতেন। এরা  হলেন পরিবারের কর্তা মি: জেস মীড ,তাঁর তিন মেয়ে ,তাঁর দুই নাতি-নাতনি -মিসেস হ্যান্সব্রো -র চার বছরের  মেয়ে ডরোথি আর মিসেস ওয়াইকফের সতের বছরের ছেলে রাল্ফ ; আর ছিল বাড়ির দেখাশোনা করার লোক মিস ফেয়ারব্যাংকস।  ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, এতগুলো লোক এই ছোট্ট বাড়িতে কীভাবে বসবাস করত।  কিন্তু এর সঙ্গে সমাগত অতিথি অভ্যাগতদের নিয়েও তাঁরা বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যেই বাস করতে পারতেন বলে মনে হয়।  
 স্বামীজী যখন এই বাড়িতে থাকতেন,তখন তিন বোন (এবং কিছু দিন মিস ম্যাকলাউডও ) ঘুমাতেন সামনের দুটি ঘরের মধ্যে বড় ঘরটিতে -(মিসেস হ্যান্সব্রো  -র ভাষাতে 'হাসপাতালের রোগীদের মতো। ') স্বামীজীকে  ব্যবহারের জন্য একটি ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল- তা পূর্বেই বলা হয়েছে।  বৃদ্ধ মি: মীড (তখন তাঁর বয়স ৮৪ বত্সর ) নিচের তলায় শুতেন, রাল্ফ থাকত সামনের ছোট ঘরটিতে। আর মিস ফেয়ার ব্যাংকস এবং ডরথী ঘুমাতেন গির্জার চূড়ার  ন্যায় ছোট চিলেকোঠাতে।  মিসেস কোহেন  মনে রেখেছিলেন   যে,সেই ছোট চিলেকোঠাতে  উঠতে হত স্বামীজীর ঘর এবং স্নানের ঘরের মধ্যিখানে অবস্থিত সরু একটা  সিঁড়ি  বেয়ে।  এভাবেই স্বামীজী জনবহুল এ বাড়িতে একান্তভাবেই  নিজের মতো করে থাকতে পারতেন।  এই বন্ধুত্বভাবাপূর্ণ খোলামেলা অবসরময়  পরিবেশে স্বামীজী ইচ্ছামতো বসবাস করতে পারতেন -  ভদ্রতা জ্ঞাপক গৃহস্থালির কোনও আনুষ্ঠানিক চালচলন তাঁকে বিব্রত করত না।  মিসেস হ্যান্সব্রো বলেছেন -" যদিও স্বামীজী বাইরে যাবার সময় বা কোন অপরিচিত  ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাঁর পোশাক -পরিচ্ছদ সম্বন্ধে খুবই  সচেতন ছিলেন, বাড়িতে কিন্তু তিনি যেমন-তেমনভাবেই চলাফেরা করতেন। এক রবিবার সকালবেলা তিনি বলে উঠলেন ,'বাড়িতে আমি পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে এতটা  সচেতন থাকব কেন ?-আমি তো আর বিয়ে করতে চাইছি না!'  আর একদিন যখন আমার বোনপো  রাল্ফ স্বামীজীর জুতো পালিশ করছিল, তখন স্বামীজী  তাকে বললেন,' জান ,রাল্ফ  ! এই অদ্ভূত মেয়েলি ব্যাপারটা আমার কাছে যাচ্ছেতাই বলে মনে হয়  !' পাশ্চাত্য দেশে বিভিন্ন সময়ে   এবং স্থানে রকমারি সব  'পোশাক' পরে যাবার যে একটা বাধ্যতামূলক ব্যাপার আছে, তাকে স্বামীজী একটা লোক-দেখানো ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিতেন।" 

   প্রতিদিন সকাল প্রায় ৭ টা নাগাদ স্বামীজী সাদা-কালো রং -এর স্নান ঘরের হেরিং  মাছের কাঁটার মতো দেখতে সেলাইয়ের ডিজাইন দেওয়া খসখসে পশমি  বস্ত্রের পোশাক ,কোমরে দড়িবাঁধা - পরেই নিচে নেমে আসতেন।  স্নান করার পর এলোমেলো  ভিজে চুলেই থাকতেন-যেমনটি মিসেস  ব্লজেটের  বাড়িতেও থাকতেন।  এ সময় তোলা  তাঁর একটা  ফটোগ্রাফেও তাঁর এলোমেলো লম্বা চুল দেখতে পাওয়া যায়। 
  
তাঁর চুল যে লম্বা থাকত ,তা অসাবধানতাবশত  নয়-বরং অন্যের খুশির আবদার  রাখতেই তিনি এরূপ চুল রাখতেন। মিসেস হ্যান্সব্রো তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন," তাঁর চুলগুলি খুবই সুন্দরভাবে ঢেউখেলানো ছিল।  বাস্তবিকই এগুলো এতই  সুন্দর ছিল এবং তাঁর চেহারার সঙ্গে এতই মানান সই ছিল যে , আমরাই তাঁকে তাঁর চুল  ছাঁটতে দিতে চাইতাম না।"  তিনি আরও বলেন,"স্বামীজী তাতে কোনো  আপত্তি করতেন না।  তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আপনভোলা মানুষ।"

  ওপরতলা থেকে নেমে আসা এবং প্রাতরাশ আরম্ভ হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে স্বামীজী কিছু সময়ের জন্য বাড়ির  পেছনের নির্জন বাগানে একাকী পায়চারি করতেন  অথবা কখনও কখনও একই রকমের নির্জন রাস্তার উপর দিয়ে বেড়িয়ে  আসতেন।  কখনো কখনো গান গাইতেন বা মন্ত্র পাঠ করতেন - কখনো  একেবারে নীরব এবং আত্মসমাহিত হয়ে থাকতেন।  প্রাতরাশ সাত্টাতেই  আরম্ভ হতো ,কারণ রাল্ফের স্কুল স্কুল আরম্ভ হত সাড়ে আটটাতে এবং সবচেয়ে ছোট বোন্ হেলেন ওই সময় লস এঞ্জেলসে তাঁর বীমা কোম্পানির কাজে  যোগদান করতে যেত।  স্বামীজী  বেশ  হালকা এবং ভালো আমেরিকান খাবারই খেতেন।  তাঁর খাবারের মধ্যে মুখ্যত ছিল ফল, দুটি ডিম (তিনি ডিমের পোচ -ই পছন্দ করতেন),দুই টুকরো টোস্ট এবং চিনি ও ক্রিম  দিয়ে দুকাপ কফি।  একদিন মিসেস হ্যান্সব্রো  তাঁকে তৃতীয় এককাপ কফি খাবার  উপরোধ করতে লাগলেন। পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত স্বামীজী বললেন -"বেশ ,দাও।  মেয়েমানুষের স্বভাবই হচ্ছে পুরুষ কে প্রলুব্ধ করা।" কিন্তু তিনি খাওয়া-দাওয়া,কফি-পান  ও পাইপে তামাক খাওয়ার ব্যাপারেও বেশ সংযত-ই 
 থাকতেন।  
     
    যদিও 'বোনঝি হেলেন ' এবং রাল্ফ বাধ্য হয়েই তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ  সেরে চলে যেত, মিসেস হ্যান্সব্রো,মিসেস ওয়াইকফ এবং স্বামীজী কিন্তু ধীরেসুস্থে প্রাতরাশ সারতেন।  তাঁরা  কখনও অত তাড়াহুড়ো করতেন না।  পরবর্তী কালে কোন  কোন কদাচিত দুর্লভ দিনে স্বামীজীর যদি সকালবেলা  ক্লাস না  থাকত, তাহলে তিনি আবার বাগানে গিয়ে পায়চারি করতেন অথবা পড়ার ঘরে বইগুলোয়  চোখ বোলাতেন।  মিসেস হ্যান্সব্রো তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন -" কখনও  কখনো তিনি বাড়ির সামনের মাঠে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করতেন।  ডরোথী র অনেকগুলো বন্ধুবান্ধবী ছিল -তারা সবাই এসে হাজির হতো এবং তিনি সবাইয়ের  সাথে হাত ধরে 'রিঙ্গা -রিঙ্গা '-ঘোরার খেলা বা অন্য রকমের খেলার আনন্দ উপভোগ করতেন  -তাঁর ছোট ছোট সঙ্গীরা খেলায় যেমনটি আনন্দ উপভোগ  করত -তিনিও ঠিক তেমনি আনন্দ পেতেন।  কিন্তু আবার তিনি শিশুদের চালচলন  লক্ষও করতেও ভালোবাসতেন  এবং তিনি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার  ব্যাপারেও বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। 

   মিসেস হ্যান্সব্রো  তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন : " তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে   কথা বলতে ভালোবাসতেন  এবং  তাদের কাজকর্ম  সম্পর্কর নানা প্রশ্নও করতেন:কেন তারা এ খেলাটা  বা ও খেলাটা করতে ভালবাসে এরকম নানা ধরনের প্রশ্ন।  তিনি শিশুদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সমস্যাদি সম্পর্কেও বিশেষ আগ্রহী ছিলেন এবং সময়- সময় তিনি এ বিষয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করতেন।  তিনি মোটেও শাস্তিদান  পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না।  তিনি বলেছেন যে এ পদ্ধতিতে কোনও  উপকারই পান নি।  তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলতেন-'আমি কখনো এমন ব্যবহার করব না ,যাতে শিশুরা ভয় পায়।' কখনও কখনও স্বামীজী পিছনের বাগানে  একটি চালার নিচে শিশুদের সঙ্গে বসে তাদের ছবির বইগুলি দেখতেন।  "তিনি বিশেষভাবে 'এলিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড ' এবং 'এলিস থ্রু দি  লুকিং গ্লাস' -বই দুটি পড়ে বেশ মজা পেতেন।  তিনি বলতেন যে বই দুটিতে মানবমনের ক্রিয়াকলাপের  চিত্রটি যথার্থভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং  ক্যারল-এর একটি বিশেষ  অন্তর্দৃষ্টি আছে এবং সেটি অতি অসাধারণ -যার ফলে তিনি এই বই দুখানি লিখতে পেরেছিলেন। বাস্তবিকই স্বামীজী মনে করতেন যে 'এলিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড' হচ্ছে এই শতাব্দীর(উনবিংশ শতাব্দী) মধ্যে লেখা শিশুসাহিত্যের  মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।"   

   রাল্ফ স্বামীজীকে খুব ভালবাসত এবং যে কোন সময় ,যে কোন ভাবেই  স্বামীজীর সেবা নিজেই  চেষ্টা করত। সে স্বামীজীর জুতো  পালিশ  করে দিত- ওপরতলা থেকে স্বামীজীর  স্বামীজীর ধুমপানের জিনিস নামিয়ে এনে দিত এবং স্বামীজীর ইচ্ছেমত  আরও অনেক ছোটখাট কাজকর্ম করে দিত।  সময়-সময় তাঁরা দুজনে  গল্প গুজবও করতেন।  একবার স্বামীজী রাল্ফকে  জিজ্ঞাসা করলেন ,' তুমি কি তোমার নিজের চোখ দেখতে পাও?' উত্তরে রাল্ফ বলল  যে সে আয়নাতে  না হলে তা দেখতে পায় না।  তখন স্বামীজী তাকে বললেন,"ভগবানও  হচ্ছেন ঠিক সেই রকম।  তিনি তোমার চোখের মতোই তোমার অতি কাছে আছে।  তিনি তোমার অতি আপনজন।  তাহলেও তুমি তাঁকে  দেখতে পাচ্ছ না। " 

   স্বামীজী প্রায় দিনই ধীরে সুস্থে বাগানে বেড়াতে পারতেন বা ডরোথি ও তার বন্ধুবান্ধবদের  সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারতেন।  তবে প্রায় দিনই তিনি বেলা দশটার সময় নিকটবর্তী পাসাডেনা  শহরে ক্লাস নিতেন। যেদিন ক্লাস থাকত ,সেদিন তিনি নটা সাড়ে নটা নাগাদ মিসেস হ্যান্স ব্রো কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে  পরতেন।  তিনি তাঁর ঢিলেঢালা  কালো কোটটি ও কালো টুপিটি পরতেন  ,আর সুটকেসে করে নিয়ে যেতেন তাঁর গেরুয়া পোশাক ও পাগড়ি -ক্লাসের আগে তা পরে নিতেন।  যে সেক্সপিয়ার ক্লাবে স্বামীজী অধিকাংশ ক্লাসগুলি নিয়েছিলেন  ,সেখান পৌঁছানো বেশ সহজ ছিল।  বাড়ি থেকে ক-পা বাড়ালেই তিনি এবং হ্যান্সব্রো  বিদ্যুত চালিত ট্রেনে চড়ে পাসাডেনা পৌঁছে যেতেন এবং সেখান থেকে অল্প  একটু দূরত্বে ফেয়ার ওক এভিনিউতে অবস্থিত  সোজা ক্লাবঘরে চলে যেতেন।   

      অন্যান্য সময় কিন্তু স্বামীজী শুধু ভ্রমণের আনন্দের জন্যই ভ্রমণ করতেন।  তিনি বেশ সুস্থ বোধ করছিলেন- না হলেও আগের চেয়ে অনেকটা ভালই।  জানুয়ারী  মাসের ১৭ তারিখে তিনি মিসেস বুলকে লিখেছেন-" স্বাস্থ্যের দিক থেকে নিশ্চিতই  আমি আগের চেয়ে অনেকটা ভালো।  মিসেস মেল্টন  মনে করে আমি এখন স্বাধীন ভাবে  ইচ্ছামত যত্রতত্র যেতে পারি- এভাবে আমার চলতে হবে, তাহলেই আমি অল্প কয়েক মাসে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠব। "
তবে একথা সত্য যে, স্বামীজী যতদিন মীডদের পরিবারে ছিলেন,ততদিন তিনি বাস্তবিকই  তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন নি।  মিসেস হ্যান্সব্রো-র স্মৃতি অনুসারে -"তাঁকে সবসময়ই বেশ হাসিখুশি দেখাত , বিশেষত  তিনি যখন কোনো বিশেষ একটা কাজে মগ্ন হয়ে থাকতেন।  তিনি যতদিন আমাদের বাড়িতে ছিলেন, তখন  কখনো তিনি তাঁর অসুস্থতার কথা আমাদের কাছে বলেননি।  সে সময় তিনি কোনও বেলা তাঁর খাবার বন্ধ করেন নি, অথবা কখনও  কোন প্রকারে এমন   ভাব দেখান নি যে তিনি অস্বুস্থ।"

 স্বামীজী যে শুধু প্রতি বেলায় তাঁর খাবার খেয়েছিলেন নয়,তিনি প্রায় সব রকম  খাবারই খেয়েছেন এবং এতে তাঁর শরীর খারাপ করেছিল বলে মনে হয় নি।  আগেই দেখা গেছে,তিনি প্রাতরাশে বেশ  ভালই খেতেন। দুপুরের আহারে সাধারণত  তিনি ভেড়ার মাংস খেতেন;তার সঙ্গে থাকত নানা   রকমের পছন্দমত শাক সবজি  -বিশেষত  কড়াই শুঁটি।  মিসেস হ্যান্সব্রো -র স্মৃতি অনুযায়ী -"আহারের শেষভাগে  মিষ্টি ইত্যাদি খাবারের স্থলে আমরা ফলই খেতাম। আঙুর  তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল। " কিন্তু কোন কোন প্রকারের ফল তিনি পছন্দ করতেন না।  একবার একটি ঘটনায় তাঁর ইঙ্গিতে বুঝে গেলাম তিনি পেয়ারা পছন্দ করেন না।  তারপর থেকে খাবার টেবিলে আমরা পেয়ারা রাখতাম না।  

      প্রায়ই স্বামীজী তাঁর সকালবেলার   ক্লাসের কোন না কোন ব্যক্তিকে মীডদের বাড়িতে  মধ্যাহ্নভোজের জন্যে নিমন্ত্রণ করে   নিয়ে আসতেন। উপরন্তু মিস ম্যাকলাউড  এবং মিসেস লেগেটও  লস এঞ্জেলস  থেকে সকালবেলা  স্বামীজীর ক্লাসে যোগ দিতে এসে প্রায়ই  মীড দের বাড়িতে দুপুরের   আহার করে যেতেন।  এইসব ভোজসভায় খুবই  অন্তর্দৃষ্টি উদ্দীপক এবং প্রাণপ্রদ  আলাপ আলোচনা হত। কোনো  কোনো দিন -সম্ভবত প্রায় দিনই আলোচনার প্রসঙ্গ চলে আসতো ভারতবর্ষ  সম্পর্কে।  ভারতের কথা তাঁর মন থেকে কখনও মুছে যেত না - তাঁর দেশবাসীর নানা সমস্যার কথা  ভেবে ভেবে তিনি কখনও কখনও হতাশায় নীরব ও স্তব্ধ  হয়ে যেতেন। কখনো কখনো তাঁর অন্তর থেকে প্রতিবাদের অসহনীয়  সুর উত্সারিত হয়ে উঠত।  মিসেস লেগেট স্বামীজীর সব কথাতেই  শ্রদ্ধার সঙ্গে সায়  দিতেন।  তিনি হিন্দুদের শান্তশিষ্ট প্রতিকারহীন ভাবকে  প্রশংসা করেই স্বামীজীকে কিছু বলেন। উত্তরে স্বামীজী বলেন ,'হিন্দুদের এরূপ মনোভাবকে  তুমি কিরূপে ভালো বলে প্রশংসা করতে চাও? তুমি কি মনে কর যে , যদি হিন্দুদের একটুও ক্ষাত্রবীর্য থাকত ,তাহলে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ইংরেজ  ভারতবর্ষকে শাসন করতে পারত ? আমি ভারতের সর্বত্র আমিষ আহারের উপকারিতার  কথা প্রচার করে থাকি, তাতে যদি আমরা ক্ষত্রিযচিত  পৌরুষ জাগিয়ে তুলতে পারি। '  

   মধ্যাহ্নভোজের মধ্যে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হতো নিকটবর্তী  পাহাড়ের উন্মুক্ত চূড়ার  ওপর অনুষ্ঠিত বনভোজন।  হ্যান্সব্রো   বলেন: "আমরা যারা নিয়মমত স্বামীজীর ক্লাসে যোগদান করতাম  ,তাদের কয়েকজন মিলে  একটা দল  গড়তাম। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কথাবার্তা হত আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে। পিকনিক করতে আসা  দলের সঙ্গে স্বামীজীর একটি ছবি বিবেকানন্দ হাউসের দেওয়ালে টাঙ্গানো  আছে।  ওই ছবিটি তোলা  হয় ওই পাহাড়ের চূড়ার উপরে।"  এই ফটোর মধ্যে স্বামীজী আসন করে বসে আছেন পিকনিকের চাদরের ওপর ; তাঁর বাঁদিকে বসে আছেন হ্যান্সব্রো,পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস ওয়াইকফ ;আর ডান দিকে আছেন মিসেস ব্রুস নাম্নী জনৈকা মহিলা।  দুপাশে দেখা যাচ্ছে দুই বা তিন জন মহিলা অতিথিকে।  তাঁরা সবাই পরে আছেন সে   যুগের লম্বা ঝুলানো  স্কার্ট ,টাইট অন্তর্বাস ,লম্বা হাতার জামা এবং খুব ভারী মাথার টুপি।  এই ফটোটি তলা হয়েছিল সকলের স্বাভাবিক যেমন তেমন অবস্থায়।  দুজন মহিলা পরস্পর কথাবার্তা বলছেন; মনে হচ্ছে স্বামীজী যেন খুব কৌতুকভরে চীনে তৈরি  মিষ্টি রুটি কিনলে কি রকম সম্পত্তি লাভ করা যায়, সে বিষয়ে এক টুকরো কাগজ থেকে কি যেন পড়ছেন  ,আর মিসেস ব্রুস স্বামীজীর কাঁধের ওপর দিয়ে তা পড়ার  চেষ্টা করছেন।  কারও গায়ে কোনো কোট ,শাল  অথবা  চাদর না থাকাতে অনুমান করা যায় যে সেদিন কার আবহাওযা ছিল খুবই আরামদায়ক।  সে বছর শীতকালের প্রায় প্রতিটি দিনই ছিল এরূপ আরামদায়ক।   

জানুয়ারী মাসের সেই সব শান্ত নীরব উষ্ণ দিনগুলোতে বনভোজনে অংশগ্রহণকারী সকলে যেখানে ওপর   থেকে নিচের  দিকে তুষারাচ্ছন্ন পর্বতের ঢালে বিস্তীর্ণ  শস্যসমৃদ্ধ  উপত্যকাগুলি দেখতে পাওয়া যেত সেরকম স্থানে বসে  কথাগুলো  শুনতো আর তা শুনতে শুনতে তারা যেন তাদের অস্তিত্বের  উচ্চতর স্থানে উন্নীত হয়ে তাদের মাঝে প্রজ্জ্বলিত  দিব্যবহ্নির আমেজে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ত।  মিসেস হ্যান্সব্রো   বলেন-"যখন স্বামীজী কোথাও কিছুক্ষণের জন্য  কথাবার্তা বলতেন ,তখন সেই সমগ্র পরিবেশটি  যেন এক আধ্যাত্মিকভাবে  ভরপুর  হয়ে যেত। " মিসেস হ্যান্সব্রো একটি বিশেষ ঘটনার কথা বলেছেন ,যেখানে স্বামীজী একটি বিষয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একেবারে তন্ময়  হয়ে গিয়েছিলেন।  তিনি বলেছেন - "স্বামীজী অবিরতভাবে একটানা না থেমে  সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টে পর্যন্ত  ছ ঘন্টা বিষয়টি আলোচনা করলেন।  যখন তাঁর আলোচনা শেষ হলো তখন স্থানটি এক আধ্যাত্মিক ভাবে একেবারে ভরপুর হয়ে গিয়েছিল। "

   তাহলে মীড দের বাড়ির পরিবেশটি না জানি কিরূপ হয়ে উঠেছিল।   বোনদের অনুভব সম্পর্কে পরে এক    বোন বলেছিলেন-"স্বয়ং যিশুখ্রিস্টই  যেন তাঁদের মধ্যে বিরাজিত ছিলেন।" তিনি তাঁর সম্পূর্ণ অবসর সময়ে বা চরম কর্মব্যস্ততার মধ্যে যা কিছুই  করুন না কেন ,তাঁর মন সর্বদা সচেতনভাবেই এক উচ্চস্তরের ঈশ্বরীয় ভাবে নিমজ্জিত হয়ে থাকত। কারণ এটাই ছিল তাঁর স্বাভাবিক  অবস্থা।   কিন্তু  দেখলে কখনো মনে হত না যে ,তিনি একজন অতিমানব অথবা নাগালের বাইরের  কোনো এক সত্তা ,পরন্তু তাঁকে মনে হতো অতি আপনজন।  মিসেস হ্যান্সব্রো   তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন - "আমাদের সকলের ক্ষেত্রেই স্বামীজীর ধৈর্য ছিল অপরিসীম। তিনি যে আমাদের চেয়ে বড় -এ ভাবটি আমাদের মন থেকে দূর করে দিয়েছিলেন। যদিও তাঁর মধ্যে কেউ কেউ উদাসীনতার ভাব   দেখতে পেয়েছেন, আমি কিন্তু কখনও তা দেখিনি।  আমি মনে করতাম যে সর্বদাই তাঁর সঙ্গে আমার একটা ঘনিষ্ঠ  সম্বন্ধ আছে।  যেন তিনি আমার এমন এক আপনজন  ,যাঁকে দীর্ঘকাল দেখিনি এবং যিনি দীর্ঘকাল যাবত  আমার কাছে আসছেন।  আমার মনে হত আমার কোথাও যেন একটা বেদনার ভার আছে-সে ভার আমার পিঠে নয়,আমার হৃদয়ে।  স্বামীজীর সঙ্গে  সাক্ষাত হবার পর আমি অনুভব করলাম যে , আমার হৃদয়ের সে বেদনার ভার কে যেন তুলে নিচ্ছে  ,ক্রমে ক্রমে আমার সে বেদনার অনুভবটি দূর হয়ে গেল।  

     এর চেয়েও স্থুল এবং বহুজনবিদিত একটি কাহিনী আছে -যাতে মিসেস ওয়াইকফ  তাঁর এক মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি লাভ করেছিলেন  -স্বামীজীর ব্যবহৃত তামাক খাবার পাইপটি স্পর্শ করে।  মিসেস হ্যান্সব্রো কাহিনীটিকে এভাবে বিবৃত করেছেন  :"দক্ষিণ পাসাডেনা ছেড়ে যাবার কিছু দিন পূর্বে  স্বামীজী আমাকে বললেন -'আমি যেখানেই যাই না কেন ,সেখান থেকে চলে যাবার সময় আমি কিছু একটা জিনিস  ফেলে রেখে যাই।  এবার সানফ্রানসিসকো  যাবার সময় আমি আমার এ পাইপটা এখানে রেখে যাব। ' তিনি খাবার ঘরের উনুনের  পাশের তাকের উপরে পাইপটি রেখে গেলেন।  আমরাও সেখানে এই পাইপটাকে অলংকারের মতো অনেকদিন ধরে সাজিয়ে রেখেছিলাম।  তারপর একদিন মিসেস ওয়াইকফ এসে ওটাকে হাতে তুলে নিলেন। তিনি বহুদিন যাবত কোন স্নায়বিক অসুখে ভুগছিলেন এবং তাঁর জীবনে আরও  নানা ব্যক্তিগত সমস্যাদি ছিল।  কিছু দিন যাবত তাঁর অসুখ প্রায় অসহনীয়  হয়ে উঠেছিল এবং সঙ্গে আরও সব নানা গোলমাল এসে জুটল।  সব মিলে  তিনি একেবারে মনমরা হয়ে পড়লেন।  তিনি উনুনের পাশের তাকের কাছে  গিয়ে স্বামীজীর সেই পাইপটি হাতে তুলে নিলেন।  সেই পাইপটা  হাতে তুলে নিতে না নিতেই তিনি একটি দিব্যবাণী শুনতে পেলেন -'ম্যাডাম  ,এ কাজটা কি খুব কঠিন ?' যে কোনো কারণেই হোক তিনি সেই পাইপটাকে তাঁর কপালের উপর ঘসলেন।   সঙ্গে সঙ্গেই  তাঁর যন্ত্রণা কমে গেল।  তিনি যেন একটা স্বস্তির ভাব  অনুভব  করতে থাকলেন।  তারপর আমাদের মনে হলো  এই পাইপটা  তাঁর কাছে থাকাই ভালো এবং বহুদিন পর্যন্ত সেটা তাঁর কাছেই ছিল। " (বর্তমানে এই পাইপটি দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বেদান্ত সোসাইটির অধিকারে আছে।  )  

   তবে স্বামীজীর সবচেয়ে তাতপর্যপূর্ণ  দৈব  শক্তির খেলা হলো ,তিনি যেখানেই থাকতেন,সেখানেই তাঁর চারপাশে  একটি অনির্বাণ  জ্যোতির  বেষ্টনী রচনা করত। যাঁরা  তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে  ছিলেন, তাঁদের স্মৃতিতে স্বামীজীর সামান্য,ছোট -আপাত তুচ্ছ  ব্যাপার বা তাঁর কথাবার্তাও স্পষ্ট  বিরাজিত আছে।  তাঁরা এতই  শ্রদ্ধার সঙ্গে এগুলিকে স্মরণে রেখেছেন ,কারণ তাঁরা স্পষ্টই জানতেন যে এসবই ছিল স্বামীজীর অতীন্দ্রীয় অনুভূতিপ্রসন্ন বিষয়। তাঁর   প্রতিটি   চালচলন ছিল দিব্য করুণা  ও মহিমার প্রকাশ।  স্বামীজীর এই চিরন্তন দৈবশক্তির মহিমা, উপরন্তু  তাঁর অকস্মাত জ্যোতির্ময় এবং উজ্জ্বল শক্তির বিস্ফুরণের জন্যই মীড  ভগিনীগণ প্রতিটি মুহুর্তেই মনে করতেন যে  যিশুখ্রিস্ট  স্বয়ং তাঁদের মধ্যে বিরাজিত আছেন। সে সময়কার পূর্বাপর ঘটনাবলীর প্রতিটিই যে খুব উল্লেখযোগ্য  ছিল,তা নয়।  বরং একটি প্রদীপ যেমন প্রজ্জ্বলিত অবস্থায় থাকে -তেমনি প্রতিটি  দিন,প্রতিটি ঘন্টা স্বমহিমায় মূর্ত থাকত।  

       দৈনন্দিন কার্যসূচি ছিল খুবই সহজ সরল।  দুপুরে আহারের পর স্বামীজী সাধারণত  শোবার ঘরে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে বই পড়তেন বা কথাবার্তা বলতেন  আর তখন মিসেস ওয়াইকফ ব্যস্ততার সঙ্গে তাঁর গৃহস্থালির যতসব কাজকর্ম  সেরে  নিতেন।  একদিন স্বামীজী তাঁকে বললেন ,"ম্যাডাম ,আপনি এত পরিশ্রম  করে সব কাজকর্ম করেন ,তাতে আমিই যেন ক্লান্তিবোধ করি।  আচ্ছা ক্ষেত্রবিশেষে  মার্থারও প্রয়োজন হয় ,আর আপনি হচ্ছেন একজন মার্থারই মতো। "  

   আবার কখনও কখনো তিনি তাঁকে তাঁর কাজকর্ম রেখে তাঁর সঙ্গে বাগানে বেড়াতে যেতে বলতেন।  বাগানে বেড়াতে বেড়াতে তিনি বাংলা গান গাইতেন অথবা সংস্কৃত  মন্ত্র আবৃত্তি করতেন।  মিসেস হ্যান্সব্রো আমাদের বলেছেন: " তিনি আমাদের কাছে ঐসব ব্যাখ্যা করতেন তাঁর ব্যক্তিগত ভাব ভঙ্গিতে -মঞ্চে ভাষণ দেবার সময় যেভাবে ব্যাখ্যা করতেন তার চেয়েও অনেক   নিবিড়  আন্তরিকতায়।"   আবার কখনো কখনো হয়ত তিনি খ্রিস্টীয় প্রার্থনা সঙ্গীত গাইতেন: "পৌত্তলিকেরা অন্ধভাবে   গাছ পাথরকে  প্রণাম  করে।"  মিসেস হ্যান্সব্রো স্বামীজীকে এসব কথা শিখিয়েছিলেন এবং স্বামীজীও এসব শুনে বেশ কৌতুক অনুভব করেছিলেন।  তিনি হেসে জবাব দিতেন -"আমি হচ্ছি সে 'হিদেন' -মূর্তিপূজক।"  

 খুব সম্ভব বিকালবেলাতে  স্বামীজী কিছু লেখার কাজ করতেন। মিসেস বুলকে ও নিবেদিতাকে অনেক গল্প লিখে পাঠাতেন। তাঁর ক্যালিফর্নিয়া থাকাকালে নিবেদিতাকে  একটি সুন্দর কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। কবিতাটির নাম 'কে জানে মায়ের খেলা।' কবিতাটির প্রথম আরম্ভ হচ্ছে -
 "কে জানে -হয়তো তুমি ক্রান্তদর্শী ঋষি !
সাধ্য কার স্পর্শে সে অতল গভীর গহন ,
যেখানে লুকানো রয়  হাতে অমোঘ অশনি। "

আর এই কবিতাটির সমাপ্তি হচ্ছে:

" হয়তো শিশুর চোখে দিব্যদৃষ্টি জাগে,
 স্বপ্নেও ভাবেনি যাহা  পিতার হৃদয় ,
  হয়তো সহস্র শক্তি কন্যার অন্তরে 
রেখেছেন বিশ্বমাতা সযত্ন সঞ্চয়। "
এই কবিতাটি  'জন্মদিন' উপলক্ষে লেখা।  উত্তরে নিবেদিতা ১৩ই জানুয়ারী লিখলেন," জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখা আপনার আশীর্বাদী কবিতাটি গতকাল রাতে পেয়েছি।  এর উত্তরে আমি আর কি লিখব,বলুন ? কি-ই বা আমি লিখতে পারি? যা লিখব,তাই অতি সাধারণ শোনাবে।  শুধু বলতে পারি, আপনার সুন্দর ইচ্ছাটি যদি বাস্তবে ঘটেও ,তা আমার পক্ষে হৃদয়বিদারক হবে।  আমি শান্তি পাব না,যদি নিশ্চিতভাবে আমি একথা না বুঝি আমার গুরু (যে আনন্দের অধিকারী হয়েছেন,তা ) মহত্তর।   

   এটা খুবই সম্ভব যে,বিকালবেলাগুলিতে স্বামীজী কখনো কখনো ব্যক্তিগতভাবে  কাউকে দর্শন দিতেন অথবা যাঁরা  মীড ভগিনীদের বাড়িতে আসতেন, তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা  বলতেন। তাহলেও তিনি সবসময়ে কথাবার্তা বলার মেজাজে  থাকতেন না।  
বিকালবেলার শেষ দিকে স্বামীজী নৈশ ভোজ তৈরী করার ব্যাপারে কখনো কখনো  মিসেস ওয়াই কফকে সাহায্য করতেন এবং প্রায়শই তিনি নিজেই সব কটি  পদ রান্না করতেন।  মিসেস হ্যান্সব্রো বলেছেন-"যখন লিঙ্কন পার্কে আমাদের বাড়িতে থাকতেন, তখন তিনি নিজেই সকলের জন্যে পুরো রান্নাটাই  সেরে ফেলতেন।  তিনি প্রায়ই তরকারি ও চাপাটি তৈরি করতেন, যা রাল্ফ ও  ডরোথির খুব প্রিয় হয়ে   উঠেছিল।  তিনি যেসব মশলাপাতি দিয়ে রান্না করতেন ,তার অধিকাংশকেই বাটতে হতো (গুড়ো  করতে হতো ) . যেহেতু তিনি  টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করা পছন্দ করতেন না ,সেজন্য তিনি একটি মাখন রাখার  বাটি  তাঁর সামনে রেখে আসনপিড়ি করে রান্নাঘরের মেজেতে বসে পড়তেন।" স্বামীজী মশলাগুলো গুড়ো করে নেবার পর ঐগুলো দিয়ে ভাজার জন্য- তরকারি  সাঁতলাবার জন্য উনুনের কাছে যেতেন।  মশলা 
সাঁতলানোর সময় মশলার যে চোখ -জ্বালা করা ধোঁয়া বের হতো তাতে বোনেদের  নাস্তানুবুদ হতে হতো -তার এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ব্রহ্মচারিণী  ঊষা  তাঁর লেখা এক প্রবন্ধে যা 'বেদান্ত এন্ড দি ওয়েস্ট 'পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে।  স্বামীজী সবাইকে সাবধান করার জন্য আগে থেকেই  উঁচু গলায় ঘোষণা  করতেন -'ঐ  ঠাকুরদাদা আসছেন, মহিলাদের বেরিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। ' 

  হ্যান্সব্রোর উক্তি   অনুসারে স্বামীজী খুব একটা হাসতেন না বা ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেন না।  স্বামীজী  সবচেয়ে হাসিখুশির মেজাজে থাকতেন যখন তিনি রান্নাঘরে স্বাধীনভাবে  ছোটাছুটি করে সমগ্র পরিবারের জন্য হরেক রকমের ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর  পদের রান্না করার অনুমতি পেতেন।  কিন্তু স্বামীজীর হাসিখুশির হালকা মেজাজের  সময়ও তাঁর সান্নিধ্যে থাকতে পারলে বহু কিছু শিক্ষা করা যেতো।  তিনি কখনো মৌখিক নীতি উপদেশ দিতেন না। তিনি শুধুমাত্র চোখ খুলে দিতেন আর তাঁর এই সময়ে অসময়ে দেওয়া শিক্ষাগুলি  কেউ  ভুলতে পারত না।  

      মীড দের পরিবারে নৈশভোজ হত সাধারণত সাড়ে ছটায় এবং যেসব রাত্রে আটটার  সময় স্বামীজীর ভাষণ দানের কর্মসূচী থাকত ,সেসব দিনে হয়তো আরও আগেই রাত্রির আহার হয়ে যেত।  মিসেস হ্যান্সব্রো-র স্মৃতি অনুসারে ভোজ্যপদগুলি  বেশ পুষ্টিকরই ছিল :" আমরা সাধারণত সুপ এবং হয় মাছ না হয় মাংস  ,শাকসব্জি এবং শেষে মিষ্টি ইত্যাদি -যেমন মাংস ও ফলের পিঠে যাকে পাই বলা হয়  তাই খেতাম।  স্বামীজী অন্য যেসব মিষ্টি ভালবাসতেন ,তাও খেতাম।  সাধারণত তিনি রাত্রে কফি খেতেন না।" তবে প্রায়ই অবশ্য স্বামীজীর তৈরি  তরকারি ,চাপাটি এবং অন্যান্য খাবারও  থাকত।  রাত্রির আহারের পর টেবিলটি  পরিস্কার করা হতো ; চুল্লির খোলা ঝাঁঝরির সামনে   আগুন জ্বালা হতো এবং পরিবারের সকলে ও অতিথিবর্গ এই গরম ঘরে অনেকক্ষণ  পর্যন্ত থেকে যেতেন।  কেউ বসতেন টেবিলের পাশে,কেউবা ইজিচেয়ারে।  স্বামীজীর বসার জন্য এমন একটা বড় ইজিচেয়ার বানানো হয়েছিল যার উপর তিনি আসন করেও বসতে পারতেন।  তিনি সাধারণত পরতেন, যাকে বলা যায় ,একটা 'ডিনার  জ্যাকেট ' বা 'ধূমপানের জ্যাকেট।'  ঘরভর্তি  লোক,আগুনের উত্তাপ এবং গ্যাসের আলো মিলে  কখনো কখনো ঘরটি  স্বামীজীর কাছে বেশি গরম বলে মনে হতো।  একদিন যখন সকলের অলক্ষ্যে  আগুনের শিখাগুলি নিভে গিয়েছিল ,তখন স্বামীজী হঠাত ঈশ্বরের নামে জয়ধ্বনি  দিয়ে উঠলেন -"জয়, প্রভুর জয়-আগুন নিভে গেছে। "   

    স্বামীজী রাত্রির আহারের পর তাঁর খুব অন্তরঙ্গ ব্যক্তিদের সঙ্গে যেসব আলোচনা করতেন  ,তা যদি তাঁদের কেউ লিপিবদ্ধ করে রাখতে পারতেন,তাহলে তা দিয়ে একটা বই হয়ে যেত  -কিন্তু কেউই তা  করেন নি।  তবে যাই হোক ,চল্লিশ বত্সর পরে মিসেস হ্যান্সব্রো তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, "স্বামীজী   বহুবিধ বিষযে আলাপ আলোচনা করতেন ;দর্শন,বিজ্ঞান ,যুক্তরাষ্ট্রের  উন্নতি -ইত্যাদি নানা বিষয়ে।  তিনি আমাদের জাতীয় জীবনের সকল বিষয়েই খুব উত্সাহী  ছিলেন। তিনি আমাদের বৈষয়িক জীবনে এতটা মনোযোগ দেওয়া পছন্দ করতেন না।  ঘরোয়া কথাবার্তার সময় তিনি একদিন আমাদের বলেছিলেন যে, যদি আমরা সব কিছুকে আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিতে গ্রহণ  না করি ,তাহলে আমাদের সভ্যতা আগামী পঞ্চাশ বত্সরের মধ্যেই   ভেঙে পড়বে। তিনি বলেছিলেন যে আমরা বৈষয়িক মূল্যবোধের ওপরই দেবত্ব আরোপ করছি, তাই আমরা এই ভোগবাদের ভিত্তির ওপর কিছুই চিরস্থায়ীরূপে  গড়ে তুলতে পারব না। "

         কখনো কখনো এসব রাত্রে স্বামীজী উচ্চকন্ঠে শাস্ত্রাদি পাঠ করতেন।  
হ্যান্সব্রো র স্মৃতি অনুসারে তিনি ছিলেন একজন সুললিত পাঠক ও আবৃত্তিকার -তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ ছিল চমত্কার।  তিনি নানা গ্রন্থ থেকে পাঠ করতেন।  একবার তিনি যখন অদ্বৈতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন ,তখন তিনি তাঁর 'সন্ন্যাসীর গীতি' কবিতাটি আনতে বলেন এবং উহা পাঠ করে শোনান।  অন্য একদিন বেশি রাত্রে তিনি 'গুরুর প্রয়োজনীয়তা' লেখাটা (তাঁর ভক্তিযোগ গ্রন্থের অন্তর্গত) আনতে বলেন। তখন তিনি আমাদের বোনঝি হেলেনের সঙ্গে কথাবার্তা  বলার সময় তাকে শুনিয়েই লেখাটা পড়লেন।  তিনি কিছুক্ষণ পড়েই  চললেন;তখন যে কোনো কারণেই হোক ,হেলেন তার আসন ছেড়ে উঠে একটি শোয়ার  ঘরের মোমবাতি  জ্বেলে তা স্বামীজীর হাতে তুলে    দিল।  স্বামীজী তাকে জিজ্ঞাসা  করলেন-"এর দ্বারা কি তুমি বুঝাতে চাইছ যে,এখন আমার ঘুমোতে যাওয়া প্রয়োজন ?" উত্তরে হেলেন বলল -"হ্যা ,তাই। এখন রাত্রি ১১টা  বেজে গেছে। " তারপর সব কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল।  'বোনঝি
 হেলেন ' -এর এরকম অগ্রপশ্চাত না ভেবে ঝপ  করে করে  ফেলা এই কাজটি তিন  বোনই দীর্ঘকাল মনে রেখেছিলেন। মিসেস হ্যান্সব্রো তাঁর স্মৃতিকথাতে লিখেছেন,  " বহুদিন পরও আমরা এই ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা করছিলাম  এবং আমাদের তিন বোনই তখন বুজতে পেরেছিলাম যে, পরোক্ষভাবে স্বামীজী হেলেনকে তাঁর কাছে দীক্ষাপ্রার্থী  হতে আহ্বান জানাচ্ছিলেন।  হেলেন বলল যে সে জানে না ,কেন সে দীক্ষা নেয়নি।  তখন তার মনে দীক্ষা  গ্রহণের কোনো প্রেরণা জাগে নি। "  তার এই কথাটি প্রকৃত অবস্থাকে লঘু করে দেখানোর একটা প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়।  

      বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, মীড ভগিনীদের কেউই স্বামীজীর কাছ থেকে  আনুষ্ঠানিক  কোন দীক্ষা গ্রহণ করেনি অথবা তারা নিজেদের কখনও স্বামীজীর অদীক্ষিত  শিষ্য বলেও মনে করেন নি। পরবর্তীকালে মিসেস
 ওয়াইকফ এবং হেলেন স্বামী তুরীয়ানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।  তিনি ওয়াই কফকে দীক্ষান্ত নাম দেন 'ললিতা।' মিসেস হ্যান্স ব্রো সম্পর্কে আর  একটি  ঘটনা -স্বামীজী তাঁকে একবার প্রশ্ন করে বসলেন -"আপনি কেন আমাদের সংঘে  যোগ দিতে পারছেন না ?" তাঁর উত্তর ছিল এই যে, তাঁর ছিল একটা নিজস্ব ক্ষুদ্র  জগত ,যাঁর জন্য তাঁকে সর্বদা ভাবতে হত।  পরবর্তীকালে মিসেস হ্যান্সব্রো বেদান্ত সমিতির সভ্যা হন এবং স্বামী তাঁকে নাম দিয়েছিলেন 'শান্তি'-কিন্তু শান্তি তাঁর কাছ থেকে কোনো দীক্ষা  গ্রহণ করেন নি।  

   তাহলেও ঠিক বলতে গেলে মীড ভগিনীগণ স্বামীজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ না করলেও -তাঁরা সবাই তাঁকে ভালবাসতেন এবং খুব ভক্তিভরে তাঁর সেবা করেছেন।  তাঁরা সবাই ছিলেন তাঁর একান্ত আপনজন।  স্বামীজীও  মীড ভগিনীদের বিশেষ  স্নেহ করতেন।  তিনি একসময় তাঁদের বলেছিলেন ," আগে থেকেই তোমাদের তিন বোনকে  জানতাম। " বিভিন্ন পত্রে নানা সময়ে তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা  করেছেন স্বামীজী।  বেটি লেগেটকে তিনি লিখেছিলেন ,
"ঈশ্বর তাঁদের মঙ্গল করুন ; ভগিনী তিনটি দেবদূতী নয় কি ? এখানে সেখানে এই ধরনের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত্কার সকল নিরর্থকতাকে সার্থক করে তোলে।"  স্বামী তুরীয়ানন্দকে লিখিয়াছিলেন," অকৃত্রিম, পবিত্র ও সম্পূর্ণ নি:স্বার্থ বন্ধু এরা। " 
মীড দের গৃহত্যাগকালে স্বামীজী বলিয়াছিলেন,"তোমরা তিন বোন চিরতরে আমার মনের অংশবিশেষ  হয়ে গেছ। "

    ১৯০০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যখন স্বামীজী মীড দের বাড়ি ছেড়ে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার  সানফ্রান্সিসকো  শহরে যান ,তিনি তাঁর পাইপটি ফায়ারপ্লেসের  ম্যান্টেলের উপর রেখে উঠে বলে ওঠেন ," এই বাড়িটি আর আগের মত থাকবে না। " তাঁর এই সরল উক্তি পরে সত্যি হয়েছিল।  বর্তমানে এই বাড়িটি এক পুণ্যসৌধে  পরিণত  হয়েছে এবং স্বামীজীর ভক্তদের কাছে এক তীর্থক্ষেত্রের  রূপ নিয়েছে। 

     স্বামীজীর পাসাডেনা ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে মীড দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়
নি।  স্বামীজীর বিশেষ অনুরোধে শান্তি সানফ্রান্সিসকোতে   স্বামীজীর সঙ্গে যান।   ওখানে তিনি স্বামীজীর সর্বকার্যে নিযুক্ত থাকতেন এবং তাঁর সেক্রেটারির কাজ করতেন। এই প্রসঙ্গে স্বামীজী এক পত্রে লিখেছিলেন,"মিসেস হ্যান্সব্রো এখানে আছে, আর আমাকে সাহায্য করতে সে শুধু কাজই করে চলেছে। " এখানকার ক্যাম্পে স্বামীজী একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে  শান্তি নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য  ছেড়ে তাঁর সেবা করেছেন।  স্বামীজী তাই মিস ম্যাকলাউড কে লিখেছিলেন,"ভগিনীটি  এত দরদ দিয়ে আমার সেবা করেছে যে তুমি অনুমান করতে পারবে না। " 
এখানেই স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি   গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর পাসাডেনাতে অবস্থিত মীডদের বাড়িতে থাকালীন জীবনযাত্রার একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ  করা সমাপ্ত করলাম ।