Saturday, August 30, 2014

স্বামী বিবেকানন্দের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত আমেরিকার দক্ষিণ পাসাডেনার বিবেকানন্দ হাউস


ভূমিকা 

উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলবর্তী  ক্যালিফর্নিয়া রাজ্যের লস এঞ্জেলস কাউন্টির অন্তর্গত একটি প্রাচীন ঐতিয্যপূর্ণ শহরের নাম  পাসাডেনা।  এই পাসাডেনা শহরের দক্ষিণ প্রান্তের শান্ত মুক্ত  পরিবেশে তৎকালীন  ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের আদলে গড়া একটি বাড়ি ১৯০০ সালে স্বামী বিবেকানন্দের পাদস্পর্শে ধন্য হয়েছিল। ৩০৯ নম্বর মন্টেরী রোডে অবস্থিত এই বাড়িটি এখন বিবেকানন্দ হাউস নামে সুপরিচিত।

আমার কনিষ্ঠ পুত্র কার্যপলোক্ষে এই পাসাডেনা শহরের বাসিন্দা ছিল সেই সময়ে। স্বামী বিবেকানন্দের আমেরিকার পাসাডেনাতে গমন এবং সেখানে একটি বাড়িতে অবস্থানের কথা পূর্বেই বই পড়ে জানতে পেরে ওই পুণ্যস্থানটি  দেখার বাসনা ছিল মনে মনে।  ২০০১ সালের জুলাই মাসে ছেলের  কাছে যাবার যখন সুযোগ এলো তখনও এই বাসনা মনের মধ্যে রেখেই ওখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। 


বিবেকানন্দ হাউসের সামনে থেকে তোলা  ছবি
                           
বিবেকানন্দ হাউস পরিদর্শন
অবশেষে আগস্ট মাসের এক দিন আমরা সকলে মিলে ওখানে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। এক চৌমাথার কাছে অবস্থিত ছবির মত বাড়িটির চারিদিক শান্ত ও শুনসান।  বাড়ির দরজা সব সময় বন্ধ থাকে।  প্রথম দিন আমরা ওখানে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে  এমন কি দরজায় ধাক্কা মেরেও ঢুকতে পারি  নি।  অবশেষে টেলিফোনে ওখানের ভারপ্রাপ্ত স্বামীজীর সাথে যোগাযোগ করে আর একদিন ওখানে গিয়ে সবাই  হাজির হয়েছিলাম। সেদিন ওখানে অনেক ভক্তের সমাগম হয়েছিল।  আমরা সমস্ত বাড়ি ঘুরে ফিরে ওখানের অনেক ছবি  তুলে খুশি মনে বাড়ি ফিরেছিলাম।   ওখানে স্বামীজীর শয়ন কক্ষে যেটি এখন ধ্যান কক্ষ হিসেবে পরিচিত সেখানে একটি জাপানী মহিলা শিষ্য়াকে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয় গানগুলি সুললিত  কন্ঠে গাইতে শুনেছিলাম। কলকাতা থেকে আগত এক প্রাচীন স্বামীজীর সাথে দেখা হয়েছিল সেখানে এবং তাঁর কিছু মুখ নি:সৃত বাণী শোনবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেদিন এক বিশেষ আনন্দ উপভোগ করেছিলাম। এক পুণ্য তীর্থক্ষেত্র দেখে পবিত্র হয়ে গিয়েছিল সকলের মন প্রাণ।
বিবেকানন্দ হাউসের আর একটি চিত্র 

দ্বিতীয় বারের দর্শন
প্রায় নয় বছর বাদে ২০১০ সালে আবার ছেলের কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন ছেলে বাসা বদল করে পাশের শহর আর্কেডিয়াতে চলে এসেছে। এবারেও ওখানে গিয়ে দর্শনের তালিকায় স্বামীজীর ওই পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত বিবেকানন্দ হাউস অগ্রগণ্য  ছিল।  এবারেও ওখানে গিয়ে  প্রথম বারের পুনরাবৃত্তি ঘটল।  আগে কোনো খবর না দেওয়ার ফলে বাড়িতে ঢুকতে   পারি নি।  মন:ক্ষুন্ন হয়ে বাড়ির  সামনে  পিছনে ঘুরে কিছু ছবি তুলে ফেরত এসেছিলাম। বাড়ির পিছনে আগের বইতে পড়া  সুদৃশ্য বাগানের বেশ হতদশা দেখে খারাপ লেগেছিল ।
 
বিবেকানন্দ হাউসের পিছনের বাগানে আমার পুত্রবধূ 
                         
এর পরে ওখানে ফোন করে আগস্ট মাসের আট তারিখে একটি অনুষ্ঠানের কথা শুনে ঐদিন ওখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু যেতে দেরী হয়ে যাওয়াতে সেদিনও প্রায় প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছিলাম না।  অবশেষে ওখানের তত্ত্ববধায়ক স্বামীজী আমার পুত্রবধূর সানুনয় অনুরোধে আমাদের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে উপরে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। কোনো লোকজন না থাকাতে আমাদের সুবিধাই হয়ে  গেল।  আমরা মনের সুখে সমস্ত কিছু দেখে শুনে ছবি তুলে খুবই খুশি হলাম। দ্বিতল বাড়িটির  একটি সুদৃশ্য  কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটি ঢাকা দেওয়া অপ্রশস্ত রেলিং দেওয়া বারান্দা। প্রবেশ দ্বারের পাশে বড় বড় করে বাড়ির নম্বর ৩০৯ লেখা আছে।
বিবেকানন্দ হাউসের প্রবেশ দ্বার ,দ্বারের পাশেই বাড়ির নম্বর ৩০৯ 

                           

 বিবেকানন্দ হাউসের প্রবেশ সিঁড়িতে আমরা সবাই
                            
রজা দিয়ে বাড়িতে  ঢুকলেই একটি ছোট আলোকোজ্জ্বল হলঘর। এখান দিয়েই সোজা খাবার ঘরে চলে যাওয়া যায়।  হলঘরের  বাঁদিকে   স্বামীজীর বসবার ঘর। এই ঘরের সামনে গাড়ি বারান্দার দিকে আছে জানলা।    হলঘরে  ঢুকেই ডান  দিক দিয়ে দুভাজের ঘোরানো  সিঁড়ি  দ্বিতলে উঠে গেছে। ওখানেই দুটি কক্ষ আছে ,যার মধ্যে বড়টি স্বামীজীর শয়ন কক্ষ ছিল। বর্তমানে  সেটি ধ্যান কক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।  গতবারে আমরা উপরে যাবার অনুমতি পেয়ে ওগুলি দেখেছিলাম, কিন্তু এইবারে  কর্তব্যরত স্বামীজী বিশ্রাম নিচ্ছিলেন বলে ওখানে আর যাওয়া হয় নি।  স্বামীজীর বসবার ঘরের পাশেই বেশ বড়সড় একটি  দরজাহীন ঘর রয়েছে।এটি খাবার ঘর।   ওখানে স্বামীজীর লাইব্রেরী ও ডাইনিং টেবিল রয়েছে  দেখলাম।  এই খাবার  ঘরের সন্নিহিত আর একটি ঘরে রান্ধনের ব্যবস্থা ছিল।  আমরা নিরিবিলি  বসবার ঘর, খাবার  ঘর ও রান্না ঘর ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অনেক ছবি তোলা হলো।  সমস্ত ঘরেই আগের সমস্ত কিছু সব আগের মত করে রাখা রয়েছে। লাইব্রেরী ঘরে বিশাল আলমারিতে প্রচুর অমূল্য পুস্তকের  ভান্ডার রয়েছে। দেওয়ালে স্বামীজীর একটি বিশাল তৈলচিত্র রয়েছে। খাবার  ঘরের এক  কোণে স্বামীজীর ব্যবহৃত ডাইনিং টেবিল এখনো  একইভাবে রয়েছে।   এ ছাড়া দেওয়ালে তখনকার সময়ের বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি রয়েছে, যার মধ্যে তখনকার সময়ের খবরের কাগজে স্বামীজীর পাসাডেনাতে আগমনের ও বক্তৃতা দেবার খবর প্রকাশিত রয়েছে। এগুলি সম্বন্ধে পরে আরও অনেক কিছু লেখা  থাকবে। তবে অনেক ছবি পুরানো হওয়াতে সেগুলির ছবি ভালো ওঠে নি।   

বসবার ঘরের সমস্ত আসবাব এমনভাবে বিন্যস্ত অবস্থায় রয়েছে, মনে হয় যেন  এগুলি গতকালের ঘটনা। তবে সব মিলিয়ে সব কিছুতেই এক অভূতপূর্ব পরিষ্কার  পরিচ্ছন্নতার ছাপ।  সমস্ত কিছু দেখে শুনে মনে প্রাণে এক অনির্বচনীয় আনন্দের অনুভূতি হয়েছিল সেদিন আমাদের সকলের। নয় বছর আগের দেখা বাড়িটির সব কিছুই আগের মত রয়েছে দেখলাম। শুধু বাড়িটির পশ্চিম দিকে   ট্রেন চলাচলের জন্যে ট্রেন লাইন পাতা হয়েছে।  সেজন্যে ব্যস্ততা ও  কোলাহল বেড়েছে। একদিন এই  ট্রেনে করে যাবার সময় ট্রেন থেকে স্পষ্টভাবে বিবেকানন্দ হাউসকে দেখে খুশি হয়েছিলাম। 

 বিবেকানন্দ হাউসে স্বামীজীর বসবার ঘর 
                                                     


বিবেকানন্দ হাউসে স্বামীজীর বসবার ঘরের আর একটি দৃশ্য
                                   
বিবেকানন্দ হাউসে স্বামীজীর খাবার ঘর ও   লাইব্রেরী
                              
 বিবেকানন্দ হাউসে লাইব্রেরী ঘরে পুস্তক সজ্জিত আলমারী ,উপরে বুদ্ধ মূর্তি ও পাশে  চেয়ার
                                     

লাইব্রেরী  ঘরে পুস্তকের আলমারীর আর  একটি বড়ো  দৃশ্য 
                                                  
বৈঠকখানা ঘরে বহু পুরানো ফটো এবং দরজার কাছে রাখা ভিজিটরস বুক
                      
বিবেকানন্দ হাউসে স্বামীজীর রন্ধনশালা 
                                      
বিবেকানন্দ হাউসে সামনের হল ঘরের ভিতর দিয়ে খাবার ঘরের দৃশ্য
                                

খাবার ঘরের ভিতরে স্বামীজীর বিশাল তৈলচিত্র
                                             
হলঘরে ঢুকেই ডানদিকে উপরে যাবার সিঁড়ি
                                                   
বিবেকানন্দ হাউসের পিছন দিকের বাগান থেকে বাড়িটির দৃশ্য
                            
বিবেকানন্দ হাউসের পিছনের বাগানের একটি দৃশ্য 
                                   
স্বামী বিবেকানন্দের বিবেকানন্দ হাউসে আগমনের ইতিহাস 

'দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়াতে স্বামীজী' পুস্তক থেকে জানা যায় যে ১৯০০ সালের জানুয়ারী মাসের শেষের সপ্তাহে সম্ভবত ২৪শে তারিখের পরে যে কোনো  এক দিন মীড ভগ্নিত্রয়দের  বাসভবনে গিয়ে হাজির হন।  কাহিনীতে আছে : " একদিন সকালবেলা -- একটি ভাড়া -করা ঘোড়ার গাড়ি হঠাত  মীডদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।  মীড ভগিনীগণ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে দেখলেন যে, স্বামীজী ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামছেন এবং তাঁর তল্পিতল্পাগুলো বাড়ির দরজার কাছে নামিয়ে বলছেন :'আমি তোমাদের কাছে থাকতে এলাম। ঐ  ভদ্রমহিলার কাছে থাকা হলো বটে। ' কার বাড়ি থেকে যে স্বামীজী এমন ভাবে চলে এসেছিলেন এবং কোন তারিখে যে এই ঘটনাটি ঘটেছিল ,তা নিশ্চিত করে জানা যায় নি।  তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে , জানুয়ারী মাসের কয়েকদিন এবং গোটা ফেব্রুয়ারী মাসটা -দক্ষিণ পাসাডেনাতে মীডদের বাড়িই ছিল স্বামীজীর ঠিকানা।  এখানে থাকাকালীন এই বাড়ির পিছনের পুষ্প শোভিত বাগানে বেড়াতে যেতেন ও বাচ্চাদের সঙ্গে  সানন্দে খেলা করতেন। দ্বিতল বাড়িটি ১৮৭৭ সালের আগে নির্মিত হয়েছিল। পিচবোর্ডে আচ্ছাদিত কাঠের বাড়িটি ছিল ত্রিকোণ ছাদ  বিশিষ্ট দুতলা এবং সামনে ছিল ছাদ দেওয়া গাড়ি বারান্দা। রোদে  পোড়া রং এবং ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন ছিল এই বাড়িটি। 

স্বামী বিবেকানন্দের দ্বিতীয়বার আমেরিকা ভ্রমণের সময় নিউইয়র্ক থেকে পশ্চিম উপকুলের লস এঞ্জেলস শহরে হাজির হন তাঁর কর্মকান্ড বিস্তারের জন্যে।  সময়টি ছিল ১৮৯৯ সালের ডিসেম্বর মাস।  স্বামীজীর ভক্ত শ্রীমতী জোসেফাইন  ম্যাকলাউড এবং লস এঞ্জেলসের অধিবাসী শ্রীমতী ব্লোজেট  স্বামীজীর ওখানের বক্তৃতার ব্যবস্থা করে  দেন।  লস এঞ্জেলসের ব্লানচার্ড হলে ৮ই ডিসেম্বরের প্রথম বক্তৃতায় তিন মীড ভগিনী শ্রীমতী এলিস হ্যান্সবোরো, শ্রীমতী ক্যারী ওয়াইকফ এবং শ্রীমতী হেলেন মীড উপস্থিত  ছিলেন।  ইউনিটি চার্চে ১২ই ডিসেম্বর পরবর্তী বক্তৃতার পরের দিন শ্রীমতী  হ্যান্স বোরো এবং শ্রীমতী হেলেন মীড  শ্রীমতী ব্লোজেটের বাড়িতে স্বামীজীর সাথে একান্তে দেখা করে তাঁদের বাড়িতে তাঁদের সঙ্গে বসবাসের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীজী এই প্রস্তাব ভদ্রভাষাতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে তিনি ঐ ভগিনীত্রয়কে তাঁর জন্যে কয়েকটি বক্তৃতার বন্দোবস্ত করতে অনুরোধ  করেন।  মীড ভগিনীরা সানন্দে ১৯শে  থেকে ২১শে  ডিসেম্বর তিনটি বক্তৃতার বন্দোবস্ত করেন। সেখানে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়েছিল। মিসেস হ্যান্সবোরো নিরাশ না হয়ে পরে পাসাডেনাতে বক্তৃতার সময়  স্বামীজীকে  এক রবিবারে নৈশ ভোজের আমন্ত্রণ জানালেন।  এই প্রস্তাবে স্বামীজী ততক্ষনাত রাজি হয়ে গেলেন এবং তাঁকে মিস ম্যাকলাউডকেও নিমন্ত্রণ জানাতে বললেন।

 বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা যায় যে স্বামীজী ও  শ্রীমতী ম্যাক লাউড  বড়দিনের আগের দিন ২৪ সেপ্টেম্বর মীড ভগিনীদের বাড়িতে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। এই নৈশভোজের ব্যাপারে মিসেস হ্যান্সব্রো বলেছেন: " ইলেকট্রিক ট্রেনে করে আমাদের বাড়িতে আসতে তাঁদের প্রায় একঘন্টা সময় লেগেছিল। ট্রেনটি বাড়ির কাছেই একটা মোড়ে এসে দাঁড়াল ; তারপর তাঁরা কয়েক পা   হেঁটেই আমাদের বাড়ির দরজার কাছে এসে হাজির হলেন।  আমি এখনো তাঁদের সেই ছবিটি দেখতে পাই -তাঁরা বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাই তাঁরা যখন এসে হাজির হয়েছিলেন তখনই  আমি তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলাম। বাড়িতে প্রবেশ করতে করতে তিনি আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন- স্বামীজী ঘুরে ঘুরে  বৈঠক খানা ঘরে গিয়ে হাজির হলেন। ঘরের উঁচু ও প্রশস্ত জানলাগুলির  ভিতর দিয়ে আমাদের বাগানের গাছগুলি দেখা যেত।  তিনি ঐ জানলার কাছে হাজির হয়ে কয়েক মিনিট কাল সেখানে দাঁড়িয়ে বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করলেন। চারিদিক থেকে সূর্যের কিরণ এসে যেন তাঁকে শুভ্র পর্দার আবেষ্টনীর মধ্যে চিত্রের ন্যায় আবদ্ধ করেছিল। তারপর তিনি আমাদের দিকে ঘুরে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। আমি মিসেস ব্লজেটের বাড়িতে তাঁকে যে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি তার জবাব দিলেন। শেষে তিনি বললেন -'হ্যা।, আমি তোমাদের বাড়িতে আবার দেখা করতে আসব !' তারপর তিনি একেবারে চলে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এবং শিগগির চলেও   এলেন।"
এরই ফলশ্রুতি মত স্বামীজী ১৯০০ সালের   জানুয়ারী মাসের শেষে মীড ভগিনীদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিলেন। এই বিষয়ে পূর্বেই বিশদ ভাবে লেখা   হয়েছে। 

৩০৯ নম্বর মন্টেরি রোডের উপর অবস্থিত মীড ভগিনীদের বাসভবনের কথা সংক্ষিপ্ত ভাবে আগেই বলা হয়েছে। স্বামীজী যখন ওই বাড়িতে থাকতে যান ,তখন ওপরের  গাড়ি বারান্দার পূর্বপ্রান্তে এবং ছাদের উপরে ছিল  ঝোপাবৃত গোলাপের বাগান -তখন প্রচুর রক্তাভ হলুদ রঙের গোলাপ ফুটেছিল -যে গোলাপের নাম " গোল্ড অফ অফির "-"বাইবেলোক্ত সুবর্ণদেশের সোনা।" 'বেদান্ত এন্ড দি ওয়েস্ট ' (নং ১৫৮) পত্রিকাতে একটি ফটোগ্রাফ ছাপানো আছে ; তাতে দেখা যাবে যে স্বামীজী বাড়িটির এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন ,আর তার পিছনে সেই গোলাপের বাগান। আর অন্যদিকে গাড়ি বারান্দার উপর একটি স্তম্ভের পেছন থেকে মিসেস ওযাইকোফ উঁকি দিয়ে দেখছেন। এই বিশেষ ফটো টিতে বাড়িটির শুধুমাত্র একটি অংশই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
  
উপরের বর্ণিত স্বামীজীর বাড়ির সামনে দন্ডায়মান  সেই ছবি 
                           
পরের অন্য ছবিতে এত পুষ্প শোভিত বাগানের দৃশ্য দেখা যায় নি।  তখন বাগানটি তেমন সাজানো নয় এবং গোলাপের কেয়ারীরও  তেমন জৌলুস নেই।  মিসেস হ্যান্সব্রোর মেয়ে মিসেস পল কোহন  তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন; তিনি এই বাড়িতে ছোটবেলায় বহু বত্সর কাটিয়ে ছিলেন; তখন এই বাড়ির সামনে থেকে রাস্তা পর্যন্ত খুব সাজানো একটি সবুজ ঘাসের মাঠ  ছিল-আর এই মাঠের মাঝখানে ছিল বিরাট দেবদারু জাতীয় পাইন গাছ।  পরবর্তীকালে যখন মীড পরিবার এই বাড়িটি ছেড়ে চলে যান ,তখন রাস্তাটিকে চওড়া করার জন্য মাঠটি একটু ছোট হয়ে যায়।  পরের ছবিগুলিতে বাগানের গাছগুলিতে তেমন ফুলের বাহার দেখা যায় না ।  আমরাও নিজেরা বাগানের হতশ্রী দশা দেখে দু :খিত হয়েছিলাম।  এই পাইন গাছকে   পিছনে রেখে স্বামীজীর একটি ছবি বসবার ঘরে দেখেছিলাম।
 পাইন গাছের সামনে দন্ডায়মান স্বামীজী
                                    
মীড ভগিনীগণ এই বাড়িটি পরিত্যাগ করার পরে এক ভক্ত ১৯৫৫ সালে ৩০৯ নম্বর মন্টেরি রোডের বাড়িটি কিনে নিয়ে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বেদান্ত সমিতির হস্তে অর্পণ করেন। বেদান্ত সোসাইটি  ১৯৫৬ সালে খুবই যত্নসহকারে বাড়িটিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন ।  এর পরেও বাড়িটির নানাবিধ সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে।  পাসাডেনা শহরের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের  সাথে তাল রেখে ১৯৮৯ সালে বিবেকানন্দ হাউসকে সরকারী ঐতিহ্যশালী স্মারক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।  

 বাড়িটি কিন্তু বেশ বিস্ময়করভাবে ছোট -ছবিতে যেরূপ দেখা যায় ,তার চেয়ে অনেক ছোট, তবে এখন আগের চেয়ে বেশি  সুন্দর দেখায়।  শতাব্দীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত শেষ ভিক্টোরিয়ান শৈলীতে এই বাড়িটিকে সাজানো হলেও এর মধ্যে সে যুগের ঘিঞ্জি বা বদ্ধভাব নেই।  এখন এটা বেশ খোলামেলা আলো হাওয়ায় ভরা এবং সুদৃশ্য।  আকারে ছোট হলেও মনে হয় যেন   প্রচুর জায়গা   আছে।  বাস্তবিকই যে কোনো ভক্ত যদি ওই বাড়িটি দেখেন ,তাহলে তাঁর উপলব্ধি করতে  অসুবিধা হবে না যে, স্বামীজী একদিন এইসব ঘরগুলোর ভিতর চলাফেরা করতেন এবং তাঁর উপস্থিতি দিয়ে এই বাড়ির প্রতিটি স্থান ভরে রাখতেন।  আজও এই বাড়িটি স্বামীজী ও মীড ভগিনীত্রয়ের স্মৃতিরক্ষা করে চলেছে।  

বিবেকানন্দ ভবনের ভিতরের বিশদ বিবরণ পূর্বেই আমাদের ওখানে পরিদর্শনের দ্বিতীয় পর্বে আলোচিত হয়েছে। এখানে প্রামাণ্য পুস্তক অনুযায়ী স্বামীজীর ওখানে অবস্থানের সময় আরও কিছু বিবরণ দেওয়া হলো।  বাড়িটির একতলার পূর্বদিকের শেষ প্রান্তে জানলাযুক্ত একটি চোর - কুঠুরি ছিল।  স্বামীজীর সময় সেখানে একটি কমলা বাগান ছিল।  খাবার ঘরটি সমগ্র বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে লম্বা ও বড় ঘর ছিল।  মিসেস হ্যান্সব্রোর স্মৃতি অনুসারে এই ঘরটি প্রায়ই বৈঠক খানা  হিসাবে ব্যবহৃত হত।  এই খাবার ঘরেই মীড বোনেদের বাবা মি: জেস মীডের পর্দা ঘেরা শয়ন কক্ষ ছিল।  আবার এই ঘরেই পরিবারের সকলে এবং তাঁদের অতিথিবর্গ সন্ধ্যার সময় ছোট চুল্লির আগুনে গা গরম করতেন ,কোনও কোনও সময় গল্প গুজব করতেন।  সেসব আসরে যে কোনভাবেই  হোক না কেন ,স্বামীজী উপস্থিত থাকতেন, কথা বলতে বলতে বেশ রাত হয়ে যেত।  স্বামীজীর আমলে রান্নাঘরের পেছনের দরজার দিকে ছিল আর একটি গাড়ি বারান্দা ,এরই পাশে ছিল স্নানের ঘর।  এই ছোট তিনটি ঘর এবং হলঘর -তাদের সেকোইয়া গাছের লালকাঠের দরজা - জানলা ,নানা কারুকার্যময় কাঠের কাজ এবং   উঁচু ছাদ ও বড় বড় জানলা (সামনের এবং পেছনের দুটি গাড়ি বারান্দা) -সব মিলিয়ে ছিল বাড়ির একতলা।
আমাদের বাড়িটি পরিদর্শনের দ্বিতীয় দিনে আমরা উপরের তলায় কিছু দেখতে পারি  নি।  প্রথমবারের দর্শনের সময় উপরের তলায় গেলেও অনেক লোকের ভিড়ে তেমন করে খুঁটিয়ে অনেক কিছু দেখা হয় নি এবং কাউকে ওখানের বিশদ বিবরণ  জিজ্ঞাসা করা যায় নি।  এবারে এখানে প্রামাণ্য পুস্তক থেকে দোতলার  বিবরণ জানাচ্ছি। 

বাড়িতে ঢুকেই যে হলঘর ,সেই ঘর থেকে সোজা উঠে গেছে দু-বার সমকোণে ঘেরা আর গরাদ-ওয়ালা জানলা দিয়ে আসা আলোয় আলোকিত সরু একটি সিঁড়ি পথ, যা দিয়ে দোতলার ছোট আকারের বারান্দায়  উঠে আসা যায়।  এর বাঁদিকে আছে দুখানা শোবার  ঘর - দ্বিতীয় ঘরখানা প্রথম ঘরের দ্বিগুণ বড়।  আর ডান দিকে ছিল স্নানের ঘর।  এই স্নানের ঘরের বিশেষ সুবিধা ও ব্যবস্থা নিয়ে মিসেস হ্যান্সব্রো  যে অহংকার ও গর্ব প্রকাশ করতেন ,তা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত।  হলঘরের শেষপ্রান্তে ডানদিকের কোণে একটি দরজা আছে ,যেটি দিয়ে স্বামীজীর শোয়ার ঘরে  প্রবেশ করতে হয়।  বর্তমানে এ ঘরটি হচ্ছে একটি প্রার্থনা ঘর -ঠাকুর ঘর।  এই ঘরটি আয়তনে প্রায় একাশি থেকে একশো  বর্গফুট।  ঘরে দুটি জানলা আছে -একটি পূর্বমুখী অপরটি দক্ষিণমুখী।   এই ঘরের একটি  ছবিতে পূর্ব দিকের জানলার কাছে একটি বিশাল আখরোট গাছ দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাওয়া যায়।  দক্ষিণের জানলা দিয়ে রান্নাঘরের ছাদ দেখা যায় ,আর দেখা যায় পিছনের বাগান এবং খাড়া  উঁচু  বৃক্ষাচ্ছাদিত একটি পর্বত চূড়া।  সত্যি সত্যি এই ছোট বাড়িটি ১৯০০ সালে এই দক্ষিণ পাহাড়ের প্রায় পাদদেশেই দাঁড়িয়েছিল -তখন এই অঞ্চল ছিল অনাবাদী, বন-জঙ্গল পরিবেষ্টিত এবং জনবসতিহীন অঞ্চল।  

তখনকার দিনে দক্ষিণ পাসাডেনা শহরটি সরকারী প্রশাসনের দিক থেকে মূল পাসাডেনা থেকে পৃথক ছিল।  তখনও এখানে ঘনবসতি গড়ে নি এবং তাই মীড পরিবারের বাড়ির চারদিকে প্রচুর খোলামেলা জায়গা ছিল।  বাড়ির পিছিনে ছিল বাগান -যেখানে মি: মীড তরিতরকারি ,বেরি এবং নানা ফলের চাষ করতেন। পূর্ব দিকে ছিল কমলালেবুর বাগান  ,পশ্চিমে ছিল এক প্রতিবেশীর বাড়ি-বাড়িটি ছিল  ঝোপঝাড়  এবং বিশাল এক ওক  গাছের আড়ালে। (ওক গাছের ডালে  মিসেস হ্যান্সব্রোর মেয়ের একটি দোলনা ঝোলানো থাকত। )  তখন কাঁচা  রাস্তার পাশে মোটেও কোনো বাড়িঘর ছিল না।  যদিও ট্রাম গাড়ি কখনো কখনো রাস্তার এক পাশ দিয়ে যাতায়াত করত ,তথাপি এই অঞ্চলটি  ছিল নিস্তব্ধ শহরের নি:শব্দ একটি অঞ্চল।  তাই স্বামীজী মিসেস হ্যান্সব্রো কে বলতেন যে, তিনি অনুভব করতেন সেখানকার পরিবেশ ছিল বিশ্রামের পক্ষে উপযুক্ত এবং ঠিক ভারতবর্ষের   পরিবেশের মত।  

 এখানেই শেষ করছি এই পবিত্র পুণ্য ভবনের স্মৃতিকথার প্রথম পর্ব।এর পরের পর্বে মিসেস হ্যান্সব্রোর স্মৃতিচারণ থেকে স্বামীজী মীড পরিবারে প্রায় ছয় সপ্তাহকাল ধরে বসবাসকালে  যা কিছু করতেন -তিনি কী খেতেন ,কেমন পোশাক-আশাক পরতেন- ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে  বিশদ আলোচনা করা হবে।  সেটি কিন্তু কম চিত্তাকর্ষক হবে না এবং স্বামীজীর  সম্বন্ধে আমাদের আরও একটি নতুন  ধারনার সৃষ্টি করবে।   

Tuesday, August 5, 2014

রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর বিবাহোত্তর প্রাথমিক পর্ব


রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয় এবং প্রেরণাদাত্রী নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী যখন অকস্মাত ধরাধাম থেকে বিদায় নিলেন ,তার মাত্র দুই মাস পূর্বেই রবীন্দ্রনাথের জীবনে এসে গেছেন ফুলতলি গ্রামের ভবতারিণী।  বালিকা ভবতারিণীকে 'স্বর্ণ মৃণালিনী ' হবার আশীর্বাদ করেছিলেন বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ। তারপর ভবতারিণী প্রায় উনিশ বছর  এই পরিবারের নানা স্রোতে হারিয়ে গেলেন মৃণালিনীর মধ্যে।  যদিও এই পরিবর্তন কোনও আলোড়ন আনলো না বহির্জগতে।  একটুও তরঙ্গ তুলল না প্রগতিশীলদের মনে।  তবু মৃণালিনীকে সামান্য বলতে পারা যায় না।  মাত্র দশ বছর বয়সে একহাত ঘোমটা টেনে যে ভবতারিণী ঠাকুর বাড়িতে ঢুকেছিলেন ,সেদিন তিনি বুঝতেও পারেন নি কোন বাড়িতে তাঁর বিয়ে হচ্ছে ,কাকে পেলেন তিনি। 
 শোনা যায় ,কথায় প্রচন্ড যশুরে টান থাকায় ভবতারিণী শশুর বাড়িতে এসে প্রথমদিকে  কিছুদিন কথা বলতেন না।  কবি কি এই অসম বিবাহকে খুশিমনে গ্রহণ করেছিলেন? তাই তো মনে হয়।  ছোট ছোট ঘটনায় রয়েছে সুখের আমেজ।  এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল ভবতারিণী র মৃণালিনী হয়ে ওঠার শিক্ষা।  প্রথমে তিনি মহর্ষির নির্দেশে ঠাকুর বাড়ির আদব- কায়দা -বাচন ভঙ্গীর ঘরোয়া তালিম নিলেন হেমেন্দ্রনাথের পত্নী নীপময়ীর কাছে। মতান্তরে তিনি আধুনিকা হবার তালিম নিয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে। তবে জ্ঞানদানন্দিনীদের  সার্কুলার রোডে অবস্থিত বির্জিতলাওয়ের বাড়ি জোড়া সাঁকো র বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে হওয়াতে এই মত সম্বন্ধে সন্দেহ থেকেই যায়, উপরন্তু  এতে মহর্ষির কোনো অনুমোদন ছিল না।  তারপরে নীপময়ীদের মেয়েদের সঙ্গে মৃণালিনী পড়তে গেলেন লরেটো হাউসে। লোরেটোতে তাঁকে অন্যান্য ছাত্রীদের সঙ্গে না পড়িয়ে স্বতন্ত্র শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করা হয়।  এই শিক্ষা দানের ব্যবস্থা যে মহর্ষির নির্দেশে হয়েছিল ,তা জানতে পারা যায় মহর্ষির  রবীন্দ্রনাথকে লিখিত চিঠি অনুসারে। বিবাহের দু  মাস পরে ৭ই ফাল্গুন ১২৯০ চুচুড়া থেকে দেবেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন -'প্রাণাধিক  রবি,ইংরাজি শিক্ষার জন্যে ছোট বৌকে লোরেটো  হৌসে পাঠাইযা দিবে। ক্লাসে অন্যান্য ছাত্রীদের সহিত একত্র না পড়িয়া তাহার স্বতন্ত্র শিক্ষা দেবার উত্তম বন্দোবস্ত হইয়াছে। তাহার স্কুলে যাবার কাপড় ও স্কুলের মাসিক বেতন ১৫ টাকা সরকারী খরচ হইতে পড়িবে।'  এই নির্দেশানুসারে মৃণালিনী দেবীর জন্য বিদ্যালয়ের পরিচ্ছদ তৈরী হয়েছে ,প্রায় এক বছর (১৮৮৪ খৃ :-১৮৮৫ খৃ :)তিনি লোরেটো স্কুলে ইংরাজি পড়েছেন।  কেবল ইংরাজি নয়-পত্নীকে সংস্কৃত শেখাবার জন্য আদি ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য পন্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নকে নিয়োগ করেন। বিদ্যা রত্নের কাছে মৃণালিনী দেবী রামায়ণের অনুবাদ করেছেন ,ভাসুর পুত্র বলেন্দ্রনাথের সাহায্যে ইংরাজি বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে সুপরিচিত হয়েছেন। হেমচন্দ্র বিদ্যা রত্ন ও বলেন্দ্রনাথের কাছে মৃণালিনী  দেবীর সংস্কৃত অধ্যয়নের পরিচয় পাওয়া যায় রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত একটি পাযনিয়ার্স একসারসাইজ বুক থেকে। ওই খাতায় কবিপত্নীর স্বহস্তে লিখিত রচনাগুলি তাঁর অনুবাদ চর্চার নিদর্শন। 

ফুলতলির ভবতারিণী হয়ত হারিয়ে গেলেন কিন্তু মৃণালিনী অতি আধুনিকা হয়েও ওঠেন নি কিংবা তার স্কুলের ইংরাজি শিক্ষা ,পিয়ানো শিক্ষা, সঙ্গীতের শিক্ষা, বাড়িতে হেমচন্দ্র বিদ্যা রত্নের কাছে সংস্কৃত শিক্ষা কোনও সৃষ্টিমূলক কাজেও লাগেনি।
অনুবাদ চর্চা , ভাষা শিক্ষা ও সাহিত্যরসের মাঝেই আবার মৃণালিনী দেবী পরিবারের অন্যান্য বধূদের সঙ্গে অভিনযে যোগ দিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরজিতলাও-এর বাড়িতে রাজা ও রানীর প্রথম অভিনয়ে নারায়ণীর ভূমিকায় নেমেছিলেন কবিপত্নী।  মৃণালিনী দেবীর এই প্রথম অভিনয়েই তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। অজিতকুমার ঘোষ লিখেছেন,'নারাযণীর ভূমিকায় মৃণালিনী দেবী নথ নেড়ে  ঝাঁটা ঘুরিয়ে যে অভিনয় করেছিলেন তা নাকি বেশ প্রাণবন্ত হয়েছিল।' তবু রবীন্দ্রনাথের নাটকে কিংবা অভিনয়ে যোগ দেবার আগ্রহ মৃণালিনীর ছিল না ,একথা স্বীকার করতেই হবে।  'সখিসমিতি' কিংবা 'মায়ার খেলা' র ছোটখাট চরিত্রাভিনয়ে যোগ দেওয়া ছাড়া আর কিছুতেই তাঁকে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায় নি।  আসলে গান-অভিনয়-সাহিত্যচর্চার মধ্যে মৃণালিনীর  প্রকৃত পরিচয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্বামীর মহত আদর্শকে পরিণত করবার জন্যে তিনি যখন রবীন্দ্রনাথের পাশে এসে দাঁড়ালেন ,শুধু তখনি তাঁর প্রকৃত পরিচয় আমরা পেলাম। সামান্যার  মধ্যে দেখা দিলেন অসামান্যা। দেখা দিল সনাতন ভারতবর্ষের শাশ্বত নারী।
 
      ঠিক সুগৃহিণী বলতে যা বোঝায় ,ঠাকুর বাড়ির মৃণালিনী ছিলেন তাই।  ব্যক্তিত্বময়ী এবং অভিমানিনী জোড়া সাঁকোতে সবার ছোট ,তবু সবাই তাঁর কথা শুনতেন। তিনিই ছিলেন জোড়াসাঁকো বাড়ির প্রকৃত গৃহিণী।  সকলের দিকে তাঁর  সমদৃষ্টি ছিল ,তিনি সকলের দু:খে দু:খী ,সকলের সুখে সুখী। তাঁকে কোনদিন কর্তৃত্ব করতে হয় নি ,ভালবাসা দিয়ে সকলের মন হরণ করেছিলেন। সেইজন্যে ছোটরা যেমন তাঁকে ভালবাসত , বড়রা তেমনি স্নেহ  করতেন। ঠিক একই কথা অমলা দাস ও প্রফুল্লময়ী দেবী লিখেছেন -'বলুর বিবাহে খুব ঘটা হয়েছিল। -- আমার ছোট জা মৃণালিনী দেবীও সঙ্গে যোগ দিয়ে নানারকম ভাবে সাহায্য করেন। তিনি আত্মীয়স্বজনকে লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করিতে ভালবাসিতেন।  মনটা খুব সরল ছিল ,সেজন্যে বাড়ির সকলে তাঁকে খুব ভালবাসিতেন।' ইন্দিরা দেবী লিখেছেন -'কাকীমা খুব মিশুকে ছিলেন এবং পরকে আপন করার ক্ষমতা ছিল।'  অমলা দাশ লিখেছেন-'সংসারে আমার বন্ধুর সংখ্যা খুবই কম।  কাকিমার মত বন্ধু আমার আর নাই, আর হবার সম্ভাবনাও নাই।  কোনো রকমে মনে কষ্ট হলে ,কোনো অশান্তি হলে দৌড়ে যাবার আর দ্বিতীয় স্থান নাই।'  এমনকি রবীন্দ্রনাথের কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী জোড়াসাঁকো বাড়িতে জলগ্রহণ করতেন না-তাঁর ধারণা ছিল মাসোহারা এক হাজার টাকা দেবার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে মহর্ষি তাঁর প্রাণ নাশ করতে পারেন। তাই জল গ্রহণে তাঁর অনীহা। কিন্তু মৃণালিনী দেবী তাঁর প্রিয় পাত্রী হওয়াতে তাঁর হাতের তৈরী  মিষ্টি খাবার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেন  নি।

আগেই বলা হয়েছে মৃণালিনী দেবী সবাইকে নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করতেন ,বউ দের সাজাতেন কিন্তু নিজে সাজতেন না। কবিপত্নী স্বভাবত অতিরিক্ত সাজ সজ্জার অনুরাগী ছিলেন না, গয়না পরতেন নিতান্ত সামান্য।  বড় ঘরের বউ তার তুলনায় তিনি সাধারণ বেশেই থাকতে ভালবাসতেন।  উপরন্তু কবির রুচির প্রভাব তাঁকে আরও সাধাসিধা করে তুলেছিল।  বিলাস বর্জন উপকরণ বর্জন একমাত্র বুলি ছিল সে সময় কবির, মুখে মেয়েদের কৃত্রিম উপায় অবলম্বনে রূপসৃষ্টি ,চোখ ধাঁধানো রঙ বেরঙের প্রজাপতি প্যাটার্নে সাজ সজ্জা ও অলংকার বহুলতার আড়ম্বরের প্রতি ধিক্কার দিতেন।  কবি প্রতি কথায় বলতেন -অসভ্য দেশের মানুষরাই মুখ 'চিত্তির' করে।  মুখে রঙ মেখে মেয়েরা কি অসভ্য দেশের মানুষ সাজতে চায়?

সমবয়সীরা অনুযোগ করলে বলতেন, 'বড় বড় ভাসুর-পো  ভাগ্নেরা চারদিকে ঘুরছে -আমি আবার সাজব কি?'একদিন কানে দুটি দুল ঝোলানো বীর বৌলি পরেছিলেন সবার উপরোধে।  সেইসময়ে হঠাত কবি সেখানে উপস্থিত হলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুই কানে দুহাত চাপা দিয়ে বীর বৌলি লুকিয়ে ফেলেছিলেন। গয়না পড়ায় এতই ছিল তাঁর লজ্জা। এই সাজগোজের ব্যাপারে মৃণালিনী দেবীর অনীহার আর একটি মজার ঘটনা না উল্লেখ করে পারছি না।
মৃণালিনী দেবী ছিলেন হেমলতা ঠাকুরের সমবয়সী।  তাই মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বেশ ভাব জমেছিল পরে।  রবীন্দ্রনাথের বিবাহের তিন মাস পরের একটি ঘটনার কথা তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন।  রবীন্দ্রনাথের বিবাহের তিন মাস পরে স্বর্ণকুমারী দেবীর বড় মেয়ে হিরন্ময়ী দেবীর বিবাহ হয়।  হেমলতা দেবী বিবাহে নিমন্ত্রিত হয়ে জোড়াসাঁকোতে গিয়েছিলেন।  সেই সময়ে কলকাতা মিউজিয়ামে প্রদর্শনী খুলেছে নতুন।  সেই প্রথম কলকাতায় প্রদর্শনীর প্রচলন।  সেই প্রদর্শনীতে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সঙ্গে মৃণালিনী দেবীও যাবেন।  বাসন্তী রঙের জমিতে লাল ফিতের উপর জরির কাজ করা পাড় বসানো শাড়ী পড়েছেন কাকিমা। তাঁকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।  কথায় বলে বিয়ের জল গায়ে পড়লে মেয়েরা সুন্দর হয়ে বেড়ে ওঠে।  সেই রোগা কাকিমা দিব্যি দোহারা হয়ে উঠেছেন তখন।  রবীন্দ্রনাথ কোথা থেকে এসে পড়লেন সেই সময় সেইখানে হাতে প্লেটে কয়েকটা মিষ্টি নিয়ে খেতে খেতে।  কাকিমাকে ঐভাবে সুসজ্জিত বেশে দেখে দুষ্টুমি করে গান জুড়ে দিলেন তাঁকে অপ্রস্তুত করার জন্য -'হৃদয় কাননে ফুল ফোটাও ,/ আধো  নয়নে  সখী, চাও চাও।'  এগার বছরের বালিকা বধূ মৃণালিনী দেবীর এই বাসন্তী রং -এর বসন খানি রবীন্দ্র স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।  তাই কবি শেষ যৌবনের অকাল বসন্তের আষাড়ে ক্ষণিকায় 'সোজাসুজি ' লিখলেন -'বাসন্তী রং বসন খানি/ নেশার মতো চক্ষে ধরে।' বৃদ্ধ বয়সে পত্রপুট বারো  সংখ্যাতে লিখলেন -'বুকে উঠল জাফরাণি রঙের আঁচল /তখন ঝিকিমিকি বেলা ' .

        তিনি আরও ভালবাসতেন রান্না করতে, আর পাঁচ জনকে ভালোমন্দ রেঁধে খাওয়াতে।পলীবালিকা ভবতারিণী যখন ঠাকুর পরিবারের বধূ হয়ে এলেন , মনে হয় তখন  থেকেই তাঁর রান্নার প্রতি সহজাত অনুরাগ ছিল।  ঠাকুরবাড়ির এই বনেদী পরিবেশে এবং স্বামীর সস্নেহ সান্নিধ্য এবং অনুপ্রেরণাতে  মৃণালিনী দেবীর রন্ধন কার্যে দিন দিন নৈপুণ্য বৃদ্ধি পেতে  থাকে।  হেমলতা দেবী লিখেছেন-কবিপত্নীর রান্নার হাত ছিল চমত্কার।  নোনতা খাবার ও ব্যঞ্জনাদি স্বাদে গন্ধে তাঁর হাতে বেশ উতরে যেত।  আর তাঁর  বিভিন্ন মিষ্টান্ন যারা খেয়েছেন ,তারা সেগুলির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কবির জন্যে প্রায়ই  ঘরে নানানতরো মিষ্টান্ন তৈরী করতেন নিজের হাতে।  তাঁর তৈরি মানকচুর জিলিপি , দইয়ের মালপো ,পাকা আমের মিঠাই, চিড়ের পুলি যাঁরা একবার খেয়েছেন তাঁরা আর ভোলেন নি।  হাতের কাছে কোনো সরঞ্জাম না পেয়ে একবার সুন্দর গাজরের হালুয়া তৈরি করে নাটোরের মহারাজাকে খাইয়ে খুব প্রশংসা লাভ করেছিলেন। মৃণালিনী দেবীর রন্ধন নৈপুণ্যের কথা রবীন্দ্রনাথ খোলা মনে হেমন্তবালা দেবীকে পত্রে উল্লেখ করেছেন।
নতুন নতুন রান্না  আবিষ্কারের সখ কম ছিল না কবিরও। বোধ হয় পত্নীর রন্ধন কুশলতা এ সম্বন্ধে তাঁর সখ বাড়িয়ে দিত বেশি।  রন্ধনরতা পত্নীর পাশে মোড়া নিয়ে  বসে  নতুন রান্নার  ফরমাশ করতে দেখা গেছে অনেক সময় কবিকে।  শুধু ফরমাশ দিয়ে ক্ষান্ত হতেন না, নূতন মালমশলা দিয়ে নূতন প্রণালীতে পত্নীকে নূতন রান্না শিখিয়ে কবি সখ মেটাতেন।  শেষে তাঁকে রাগাবার জন্যে গৌরব করে বলতেন,'দেখলে তোমাদের কাজ তোমাদেরই কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম। ' তিনি চটে গিয়ে বলতেন,'তোমাদের সঙ্গে পারবে কে? জিতেই আছ সকল বিষয়ে।' এই সব ছোটখাট ব্যাপারে লক্ষ্য করা যায় তাঁদের দুজনের ভিতরের গভীর সম্পর্ক।

বন্ধুবান্ধব নিয়ে খাওযাদাওযা গান সাহিত্য আলোচনার আসর বসাতে কবি খুবই ভালবাসতেন। এই সব আসরে বন্ধু সমাগম কম  হত না। প্রায়ই বন্ধুবান্ধবকে মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ করে বেমালুম ভুলে যেতেন। এই ভ্রান্তিমূলক নিমন্ত্রণ বিভ্রাটের জন্যে মৃণালিনী দেবী নানা রকম মিষ্টান্ন তৈরী করে রাখতেন যাতে এরূপ বন্ধু সমাগমে খাদ্য বিভ্রাট না ঘটে।  কবিপত্নীর প্রিয় বান্ধবী অমলা দাশের ভগ্নী উর্মিলা দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন- ' মৃণালিনী দেবী রান্না করে মানুষ খাইয়ে বড় তৃপ্তি পেতেন।  তাঁর দাদা চিত্তরঞ্জন দাস যখন রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যেতেন তখন সিঁড়ি থেকেই বলতে বলতে উঠতেন ,সেদিন কী কী খাবেন।  মৃণালিনী দেবীও তক্ষুনি  রানাঘরে সেটা তৈরি করতে বসতেন।' তিনি আরও লিখেছেন-'কবির একটা অভ্যাস ছিল ,সিঁড়ি থেকে সুউচ্চ কন্ঠে ছোট বউ ছোট বউ করে ডাকতে ডাকতে উঠতেন।  আমার ভারি মজা লাগত শুনে, তাই বোধহয় আজও মনে আছে। ' ( রবীন্দ্রনাথ যে সুর করে মৃণালিনী দেবীকে ডাকতেন সেটা পূরবী কাব্যের 'আশা' কবিতায় লিখে গেছেন।) রথীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন- 'জোড়াসাঁকো  বাড়িতে যেদিন খামখেয়ালি সভার অধিবেশন বসত সেদিন রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবীকে নতুন ধরনের রান্নার নির্দেশ দিতেন।  ফরমাশ করতেন  যেন প্রতিটি পদের বৈশিষ্ট্য থাকে -মামুলি কিছু চলবে না। ' বলা বাহুল্য কবিপত্নী অভিনব আহারের আয়োজন করাতে সমর্থ হয়েছিলেন সেবারে।

ঠাকুর বাড়িতে নতুন বউ দের গৃহকর্মে নানারকম তালিম দেওয়া হত।  তাদের শিক্ষা শুরু হতো পান সাজা দিয়ে। তারপর তাঁরা শিখতেন বড়ি  দিতে, কাসুন্দি- আচার প্রভৃতি তৈরী করতে।  ধনী পরিবারের বউ হলেও এসব শিক্ষায় ত্রুটি ছিল না।  বলা বাহুল্য মৃণালিনী  এসব কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন।  তবে এ সময় দিন বদলাচ্ছে। পালাবদল চলছে বাড়ির বাইরে,বাড়ির ভিতরেও।  না বদলালে কি জ্যোতিরিন্দ্র - কাদম্বরী তিনতলার ছাদে 'নন্দন কানন' তৈরী করতে পারতেন? সে সভায় অনাত্মীয় পুরুষেরাও অবাধে আসতেন ,অথচ সত্যেন্দ্র -বন্ধু মনমোহনকে অন্ত:পুরে আনতে কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি।  যুগ বদলাচ্ছে।  মৃণালিনী যখন লোরেটো স্কুলে পড়তে গেলেন তখন আর কেউ ধিক্কার দিতে এলো না।  অবশ্য অন্দর মহলের ব্যবস্থা বদলাতে বড় দেরী হয়।  যাই যাই করেও গ্রীষ্মকালের শেষ-সূর্যের আলোর মতো মেয়েদের চিরকালের অভ্যেস যেন যেতে চায় না।  তাই বাইরের জগতে কয়েকটি মেয়ে পরিবর্তন আনলেও ঠাকুরবাড়ির মেয়ে- বউ রা তখনও শিখতেন ঝুনি-রাইয়ের ঝাল কাসুন্দি, আমসত্ত্ব ,নারকেল চিঁড়ে তৈরি  করতে।

     রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের সাংসারিক জীবনের সুখের ছবি বন্ধুবর প্রিয়নাথ সেনকে লেখা চিঠিপত্রে ধরা আছে।  বিবাহের পরেই কবি প্রিয়নাথ সেনকে চিঠিতে লিখেছেন-প্রিয় বাবু,  Honey moon কি কোনকালে একেবারে শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে -তবে কিনা Moon-এর হ্রাস বৃদ্ধি পূর্ণিমা অমাবস্যা আছে বটে।  অতএব আপনি Honey moon -এর কোনো খাতির না রেখে হঠাত এসে উপস্থিত হবেন।  আর এক চিঠিতে লিখেছেন -আমার নূতন গৃহ প্রতিষ্ঠা হয়েছে,আজ নানা কারণে আপনার দর্শন প্রার্থনীয়-নিরাশ করবেন না।  ১৪ নং চিঠিতে রয়েছে-আমরা যশোর বেড়াতে গিয়েছিলাম।  সম্প্রতি যশোর থেকে এসেছি - আপনি ও নগেন্দ্রবাবুকে সঙ্গে করে একদিন এখানে আসতে চেয়েছিলেন তার কি হলো? কবে আসবেন ? আর এক চিঠিতে লিখেছেন-আজ বিকালে আপনি একবার এদিকে আসবেন?নগেন্দ্রবাবু আজ এখানে আসবেন। আজ আপনার যদি কোনো বাধা না থাকে তবে আমাদের এখানে সন্ধ্যাবেলায় আহারের নিমন্ত্রণ রইলো।  শুভ উত্তরের অপেক্ষায় রইলুম।  এই রকমই ছিল দুজনের প্রথম দিকের বন্ধু বান্ধব পরিবৃত আপন সাংসারিক সুখের ছবি।

ফুলতলী গ্রামের পল্লীবালিকা ভবতারিণীর সাথে রবীন্দ্রনাথের  বিবাহের পর থেকেই দুজনের দাম্পত্য জীবন সুখের সাথেই শুরু হয়েছিল বলে  অনুমান করা যায়।  ভবতারিণী মৃণালিনীতে পরিবর্তিত হইবার পরে রবীন্দ্রনাথের স্নেহ সান্নিধ্যে এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শীঘ্রই ঠাকুরবাড়ির যোগ্য হয়ে উঠেছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।  বিভিন্ন ঘটনার ভিতর দিয়ে তাদের ছোট ছোট সুখের পরিচয় পাওয়া যায়।  বিবাহের পরে প্রথমবার রবীন্দ্রনাথের যশোরের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা বন্ধুবর প্রিয়নাথ সেন মহাশয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন।  নববধূকে নিয়ে কবি যখন ফুলতলির গ্রামের পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই বহুদিন পূর্বের দেখা গ্রাম্য পথের বর্ণনা দিয়েছেন এই ভাবে -'যেন অনেকদিনের দেখা একটা রুদ্র রঞ্জিত মাঠ ,শীতলস্নিগ্ধ বাতাস পুষ্করিণীর ধার দিয়ে বাঁকা গ্রামের পথ, ঘট কক্ষ অবগুন্ঠিত বধূ এবং সেই সঙ্গে ওই সর্ষে খেতের মৃদু সুগন্ধে অনুপ্রবিষ্ট একটি উদার নির্মল আকাশ মনে পড়ে -যেন কোনো এক সময়ের পরিতৃপ্ত প্রেম এবং পরিপূর্ণ শান্তির সুখস্মৃতি ওই সর্ষেফুলের গন্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ' আবার ক্ষণিকায় ওই সর্ষে খেতের মৃদু সুগন্ধের সঙ্গে নববধূকে নিয়ে যশোর যাত্রার সুখস্মৃতি বিলম্বে মনে পড়েছে বলে 'বিলম্বিত ' কবিতায় লিখেছেন-'তখন ছিল সর্ষে-খেতে /ফুলের আগুন লাগা ,/ তখন আমি মালা গেঁথে /পদ্মপাতায় ঢেকে /পথে বাহির হয়েছিলাম /রুদ্ধ কুটির থেকে।' রবীন্দ্রনাথ প্রথম যৌবনে নব কৈশোরের অক্লিষ্ট অমলিন প্রেমমালা নিয়ে যখন নববধূর সঙ্গে গ্রামে যান ,সেই সময় মাঠে মাঠে সর্ষে ফুল ফুটে সমস্ত মাঠ গুলিতে যেন ফুলের আগুন লেগে পাকা সোনার রং ধারণ করেছিল।  তাই রবীন্দ্র জীবনীতে নবযৌবনের দেখা এই অবহেলিত সর্ষে ফুল ও সর্ষে খেতের সুগন্ধি ই কবির পরিতৃপ্ত প্রেমের সঙ্গে নববধূকে নিয়ে যশোর যাত্রার পরিপূর্ণ সুখ ও শান্তির স্মৃতি জড়িয়ে আছে যা ক্ষণিকার 'বিলম্বিত' কবিতায়, প্রান্তিক ৭সংখ্যক ,ও ছিন্নপত্র ২৪৯ সংখ্যাকে লিখে গেছেন।

    পারিবারিক ভাবে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করেছেন কবির অন্তরঙ্গ দুই রমণী।  প্রথম জন  হলেন রবীন্দ্রনাথের পরম স্নেহের ভাগ্নী সরলা দেবী।  সরলা দেবী লিখেছেন-' মামার জন্মোত্সব প্রথম আমি করাই।'  এই   উত্সবে ধূতি চাদর ও ফুলের মালা দিয়ে একান্ত ঘরোয়াভাবে সরলা দেবীর উদ্যোগে  ৪৯ নং পার্ক স্ট্রীটে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে জন্মোত্সব পালন করা হয়।  শ্রীশ মজুমদারকে কবি লিখেছেন-'আজ আমার জন্মদিন- পঁচিশ বত্সর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখ আমি ধরণীকে বাধিত করে অবতীর্ণ হয়েছিলুম।' তখন মৃণালিনী দেবীর  বয়স মাত্র  বার বছর।  কবি জীবনের এই আনন্দ উচ্ছ্বাস মুখরিত সংসার পর্বের প্রথম ভাগে চতুর্দশী মৃণালিনী দেবী খুব আড়ম্বরের সঙ্গে সাতাশের কবির দ্বিতীয় জন্মোত্সব পালন করেন। তারপর থেকে প্রতি বছর আমৃত্যু পর্যন্ত নিয়মিত ভাবে এই জন্মদিন  পালন করতেন। বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের যে উত্সব দেশে বিদেশে পালিত হয় ,তার প্রথম সূত্রপাত করে গিয়েছিলেন মৃণালিনী দেবী।  এই জন্মদিনে কবিপত্নী কবিকে সোনার বোতাম উপহার দেন।  রবীন্দ্রনাথ পুরুষের সোনা পরাটাকে লজ্জাজনক বলে আপত্তি করায় কবিপত্নী সে বোতাম ভেঙে ওপেল বসানো বোতাম গড়িয়ে দিলেন।  সে বোতামও দু-চার বার পরেছিলেন যেন দায়ে পড়ে।  জন্মদিনের এই হঠাত উপহার পেয়ে কবি মুখে আপত্তি করলেও মনে মনে কিন্তু দারুণ  খুশী হয়েছিলেন  যা সেজুতির জন্মদিন কবিতায় ও শ্রীশ মজুমদারকে চিঠিতে লিখে গেছেন।  তাই দেখা যায় লাজুক রবীন্দ্রনাথের মুখের কথাও সব সময়ে সত্য হয় না।  সত্য ভাষণ সব লিখে গেছেন কবিতায় (ছিন্নপত্র ৯৪ নং) 'ছুটির যজ্ঞে পুষ্প হোম জাগলো বকুল শাখা /ছুটির শূন্যে ফাগুন বেলা মেলল সোনার পাখা।/ ছুটির কোণে গোপনে তার নাম /আচমকা সেই পেয়েছিল মিষ্টি সুরের দাম ,/(উপহার) কানে কানে সে নাম ডাকার ব্যথা উদাস করে / চৈত্র  দিনের স্তব্ধ দুই প্রহরে। ' (জন্মদিন- সেজুতি ) এই জন্মদিন কবিতায় কবি প্রচ্ছন্নভাবে 'ছুটি' অর্থাত ছোট বউ -এর পত্র পুষ্প উপহার দিয়ে খুব জাঁক জমকের সঙ্গে বন্ধু- বান্ধব আত্মীয় স্বজন নিয়ে জন্মদিনের উত্সব পালনের কথা স্মরণ করেছেন যা বৃদ্ধ বয়সেও ভোলেন নি।  এই আনন্দ মুখরিত জীবনের আরম্ভ-বেলাকার সাতাশে কবি পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরিতে একটু অন্যভাবে লিখলেন -এখন ভাবনা ধরিয়ে দিলে আমার আসল  পরিচয়  কোন  দিকটায় সেই আরম্ভ -বেলাকার সাতাশের দিকে,না, শেষ বেলাকার? এই আরম্ভ বেলাকার সাতাশের জন্মদিনের উত্সব কবির জীবনের একটি স্মরনীয় দিন।  কারণ চতুর্দশী মৃণালিনী দেবী সাতাশের কবির জন্মদিনের উত্সব পত্রপুষ্প আলোক ও সমীরণের মধ্যে আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে খুব জাঁক জমকের সঙ্গে উদযাপিত করে কবিকে প্রথম অর্ঘ্য দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে তুমি আজ সাতাশে পড়েছ !! এই সাতাশের কবির কাছে দেশবাসীর অনেক প্রত্যাশা ! তাই ২৭সে জুলাই ১৮৮৭ খ্রি : শ্রীশ মজুমদারকে লিখলেন -'হঠাত একদিন বৈশাখের প্রভাতে নববর্ষের নূতন পত্রপুষ্প আলোক ও  সমীরণের মধ্যে জেগে উঠে  যখন শুনলুম -আমার বয়স সাতাশ তখন আমার মনে এই সকল কথার উদয় হল।'  এই হলো কবির প্রথম সাতাশের জন্মদিনের কাহিনী।  আর শেষ সাতাশের (১৮৯৭খ্রি:-১৯২৪ খ্রি:) ঋণগ্রস্ত কবি যখন কল্যাণ কর্মের উদ্বোধন করলেন ,(১৩০৭ শিলাইদহ) তখন একমাত্র মৃণালিনী দেবী তাঁর কল্যাণ কর্মের প্রেরণাদাত্রী  হয়ে কবিকে 'একটুখানি টিপ ' পরিয়ে  দিয়ে কবির নবজীবনের উদবোধন করলেন। (১৯০০ খ্রি: -১৯০২ খ্রি:) অনাদৃত কবিকে আরম্ভ বেলাকার সাতাশে এবং শেষ বেলাকার সাতাশে এই দুই সাতাশে প্রথম অর্ঘ্য দিলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী ,এবং সেই সময় মৃণালিনী দেবী ই ছিলেন কবির কল্যাণ কর্মের একমাত্র উত্সাহদাত্রী এবং নিজেও সেই কর্মযজ্ঞে যোগ দিয়েছিলেন।
এই   প্রসঙ্গে কবি মংপুতে মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছিলেন- 'মেয়েদের প্রধান কাজ Inspire করা।  পুরুষ বা মেয়ে উভয়েই অসম্পূর্ণ ,উভয়ে মিলিত হলে একটা সম্পূর্ণতা আসে ,জীবনে তার গভীর প্রয়োজনীয়তা।  --পুরুষ তার কর্মক্ষেত্রে সবল দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে   পারে না, যদি না নারী তার অমৃত দিয়ে পূর্ণ করে তাকে। দু 'জনের মিলনে যে একটা circle সম্পূর্ণ হলো ,যদি তা না হত তাহলে যে একটা বিশেষ ক্ষতি তা হয়ত নয় ,কিন্তু সেই হওয়ার দ্বারা একটা বিশেষ পূর্ণতা জীবনের।  মেয়েদের সেই কাজ, পুরুষের যথার্থ সঙ্গিনী হওয়া জীবনের মুক্তক্ষেত্রে ।  -- সেই শিখা না হলে আলো যে জ্বলত না ,তাই হৃদয়ের সেই শিখা জ্বালানো চাই।  -- কিন্তু সে মিলন তখনি যথার্থ বড় মিলন হয়, যখন সে একটা মহত্তর জীবনের মধ্যে প্রেরণা  আনে।  গন্ডীবদ্ধ আঁচল চাপা দেওয়া জীবনে সে যেন ব্যর্থ না হয়।  যেখানে পুরুষ মহত ,যেখানে সে কর্মের দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছে ,সেখানে তাকে নিয়ত জাগ্রত রাখা কম কাজ নয়।

 উপরিল্লিখিত তথ্যগুলির ভিত্তিতে এটি সহজেই প্রতীয়মান হয় যে রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী  বিবাহের পরের প্রাথমিক পর্বগুলি বেশ সুখ শান্তি ও উভয়ের প্রতি ভালবাসা ও নির্ভরতার মাধ্যে অতিবাহিত হয়েছিল।  ব্যতিক্রম শুধু একটি ঘটনা ,যেটি আকস্মিক ভাবে ঘটে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক শূন্যতা ও শোকের আবহ তৈরি করে তাঁকে শোকাকুল ও দিশাহার করে দিয়েছিল। বিবাহের মাত্র দুই মাসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয় ও অন্তরঙ্গ নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। কাদম্বরী দেবীর এই আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যু কবিকে বেশ কিছুদিনের জন্যে উদ্ভ্রান্ত করে রেখেছিল।  এই স্নেহময়ী নারীই কবির শৈশবে নিজের স্নেহ মমতা ও ভালবাসা দিয়ে কবির জীবনকে অভিষিক্ত করে রেখেছিলেন, কৈশোর জীবনের কাব্যতরণীকে ঠেলে দিয়েছিলেন পূর্ণতার লক্ষ্যে।  তিনিই ছিলেন কবির কাব্যের প্রেরনাদাত্রী নারী। শৈশবে মাতৃহীন  বালককে স্নেহ মমতা দিয়ে মানুষ করেছিলেন বলে রবীন্দ্র নাথ তাঁর উপর খুবই নির্ভর করতেন ,এবং কবি তাঁকে সমাদরের আসনে বসিয়েছিলেন। নতুন বৌঠানের এই মর্মান্তিক মৃত্যুই কবির সুকুমার ও অনুভূতিপ্রবণ মনকে বেশ কিছুদিনের জন্যে দিশেহারা ও উন্মনা করে দিয়েছিল।  শেষ সপ্তক ত্রিশ সংখ্যক কবিতায় কবি লিখেছেন, কবির অসংখ্যের মধ্যে একটি মাত্র নারী কাদম্বরী দেবীর সাথে তাঁর স্বভাবের ও মনের মিল ছিল।  দুজনেই কবি প্রকৃতির,পরিহাস প্রিয় চঞ্চল ও কৌতুক প্রিয় ছিলেন। কাদম্বরী ছিলেন স্নেহময়ী,করুণাময়ী,অনুভূতিপ্রবণ ও আবেগ প্রবণ।  এই আবেগ প্রবণতার জন্যেই সন্তানহীনা এবং স্বামী সোহাগে বঞ্চিতা ,মনে মনে একাকিনী মুহুর্তের আবেগে নিজের সীমারেখা লঙ্ঘন করে দিশেহারা হয়ে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন।  এই সময় মৃণালিনী দেবীর বয়স মাত্র দশ বছর দুই মাস এবং রবীন্দ্রনাথের চব্বিশ।  তাই কবি শেষ সপ্তক ত্রিশ সংখ্যায়  লিখে গেছেন- 'চোখে ছিল /একটা দিশাহারা ভয়ের চমক/ পাছে কেউ পালায় তাকে না বলে / তার দুটি পায়ে ছিল দ্বিধা  /ঠাহর পায়নি / কোনখানে সীমা / তার আঙিনাতে।  '
রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন আবেগপ্রবণ ,সেজন্যে নতুন বৌঠানের আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি শোকে পাগলপারা হয়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর অব্যবহিত পরে রাত্রে বাড়ি ফিরে  সারা রাত ধরে তিনতলার ছাদে পায়চারি করেছেন আর নতুন বৌঠানকে চারিদিকে খুঁজে বেরিয়েছেন, আকুল স্বরে তাঁকে একবারের জন্যে দেখা দিতে বলেছেন। সাথে সাথে তাঁর প্রিয় গান গেয়ে গেছেন সারা রজনী। কাদম্বরী দেবীর প্রতি তরুণ হৃদয়ানুরাগই তাঁর জীবনের গভীরতম উপলব্ধি এবং কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুই রবীন্দ্র জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তিনতলার ছাদ , তিনতলার জ্যোতি দাদা  ও নতুন বৌঠানের  থাকবার ঘর ও সারা বাড়ির আনাচে কানাচে নতুন বৌঠানের খোঁজে পাগলের মত ঘুরে বেরিয়েছেন। এমন কি মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরেও চলে যেতেন এবং আবার অবসন্ন হযে  বাড়িতে ফিরে এসে সেই অনুসন্ধান। এর ফলশ্রুতি কিছুদিনের মধ্যে বন্যার স্রোতের মত বিভিন্ন কথিকা, গান ও কবিতা কাদম্বরীর উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখ যোগ্য জীবন স্মৃতিতে প্রকাশিত 'মৃত্যু শোক ' কথিকা এবং পুষ্পাঞ্জলী প্রবন্ধ সংগ্রহ। 'জীবনস্মৃতি' তে "মৃত্যুশোক" অধ্যায়ে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু কবিমানসে কী সুগভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তার আলোচনা প্রসঙ্গে কবি বলেছেন ,"জগতকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্যে যে দূরত্বের প্রয়োজন মৃত্যু সেই দূরত্ব ঘটাইয়া   দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার উপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম তাহা বড় মনোহর। " 
    এই চব্বিশ থেকে কবির শেষ জীবন আশী বছর পর্যন্ত অজস্র কবিতায় ও গানে শুধু নতুন বৌঠানের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। তবে কবির নাতজামাই কৃষ্ণ কৃপালনী কবি মানসে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে বক্তব্যে বলেছিলেন, "It did not break him ,it made him "
কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুই রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথকে মহাকবি রবীন্দ্রনাথে রূপান্তরিত করেছে। এই মরণের বৃহৎ  পটভূমিকাতেই কবি জীবন ও জগতের সত্যরূপকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখার মহাকবি - দৃষ্টি লাভ করলেন।

   কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যাজনিত রবীন্দ্র জীবনের এই এই বিপর্যয় ও দিশাহারা অবস্থায়  নবপরিণীতা গ্রাম্য পল্লীবালিকা মৃণালিনী দেবী ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন।  তাঁর এই সময়ের মনের অবস্থাও রবীন্দ্রনাথ কিছুটা অনুধাবন করেই লিখে গেছেন -'তোমারে সবলে আঁকড়িয়া  ,-হিয়া কাঁপে থর থরে/ দু:খদিনের  ঝড়ে।' অর্থাত   কাদম্বরী দেবীর এই অকস্মাত মৃত্যুর বিপর্যয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যেমন দিশাহারা হয়েছিলেন তেমনি ভীত গ্রাম্য 'বালিকা  বধূ' মৃণালিনী দেবীও এই 'দু:খ দিনের ঝড়ের ' মধ্যে ভয়ে দিশাহার হয়ে রবীন্দ্রনাথকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন।

     কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'কড়ি ও কোমল।'এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি মোটামুটি ১২৯০ সালের ফাল্গুন-চৈত্র  থেকে ১২৯৩ সালের আশ্বিন-কার্তিক পর্যন্ত কাল সীমার মধ্যে রচিত হয়ে সংকলিত হয়েছে। অর্থাত 'মৃত্যুশোক' -এর প্রথম আড়াই বত্সরের কাব্যফসল 'কড়ি ও কোমল। '
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "কড়ি ও কোমলে  যৌবনের রসোচ্ছ্বাসের সঙ্গে আর একটি প্রবল প্রবর্তনা প্রথম আমার কাব্যকে অধিকার করেছে, সে জীবনের পথে মৃত্যুর আবির্ভাব।  যাঁরা আমার কাব্য মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন এই মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি আমার কাব্যের এমন একটি  বিশেষ ধারা নানা বাণীতে যার প্রকাশ।  'কড়ি ও কোমল' -এই তার প্রথম উদ্ভব।  সেজন্যে কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের প্রথম অংশে রয়েছে কাদম্বরী দেবীর (পুরাতন) মৃত্যুশোকের  কবিতা আর শেষ অংশে রয়েছে 'পঞ্চদশী '(তনু) নিরুপমা 'নতুন' -এর (মৃণালিনী দেবী) উদ্দেশ্যে নববসন্তের গান।
তাই এর কিছুদিনের মধ্যেই কবি মৃত্যুকে পশ্চাতে রেখে জীবনের দিকে মুখ ফিরয়ে নেন, এবং
নূতন'র উদ্দেশ্যে (মৃণালিনী  দেবী) রচনা করেন 'তুমি' যা পরিশেষে দেখা দেয় 'তুমি' আর 'আমি' রূপে।  কবির এই নব যৌবনের শরৎ কালের প্রচ্ছন্ন প্রেরণায় 'দেহে'র আকর্ষণের 'মোহ'  নানা বর্ণে ও রূপে কড়ি ও কোমলের আদিরসাত্মক কবিতায় প্রথম ফুটে উঠেছিল 'পূর্ণ মিলন'  'দেহের মিলন' কবিতায়।  কবি কড়ি ও কোমল সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন -'যৌবন হচ্ছে জীবনে ঋতুপরিবর্তনের সময় যখন ফুল ও ফসলের প্রচ্ছন্ন প্রেরণা  নানা বর্ণে ও রূপে অকস্মাত বাহিরে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে, কড়ি ও কোমল আমার সেই নবযৌবনের রচনা।'

 এবারে  বাস্তব সংসারের সংস্পর্শে আসার দরুণ কবির  ভাষা ও ছন্দ  নাপ্রকার রূপ ধরে উঠবার চেষ্টা করছে। কবির যৌবনে মৃণালিনী দেবীর আবির্ভাবে কবির কাব্যের ও সাহিত্যের যেমন শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছিল তেমনি কবির জীবনের শ্রেষ্ঠ বিকাশও হয়েছিল।  এই সময়টা অর্থাত ১৮৮৪ সাল থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত কবির কাব্যের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা  যায় , এবং এই সময়  বহু গান গল্প কবিতা নাটক ও উপন্যাসের উত্স স্থান।  কবির এই নবযৌবনের রসোচ্ছ্বাস  কেবল যে মানব জীবনের বিচিত্র রসলীলা কবির মনকে আকৃষ্ট করেছিল তা নয়, সেই সঙ্গে কবির চিত্রকলা গান গল্প কবিতা সবই যেন একসঙ্গে কবির অন্ত:স্থলের উত্স থেকে আপনি উত্সারিত হচ্ছিল।  তাই নবযৌবনের শরৎ কালে অথবা সংসার পর্বের প্রথম অধ্যায়ের বর্ণনায় কবি লিখেছেন- 'মনে পড়ে দুপুর বেলায় জাজিম বিছানো কোণের ঘরে একটা ছবি আঁকার খাতা লইয়া ছবি আঁকিতেছি।  সে-যে চিত্রকলার কঠোর সাধনা তাহা নহে-সে কেবল ছবি আঁকার ইচ্ছাটাকে লইয়া আপন মনে খেলা করা।  যেটুকু মনের মধ্যে থাকিয়া গেল ,কিছুমাত্র আঁকা গেল না  সেইটুকুই ছিল তাহার প্রধান অংশ। ' নব যৌবনের শরৎ কালের আর একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কবির গান ও ছবি আঁকা।  এই প্রথমে তিনি ছবি আঁকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।  কবির মনের এই ছবি আঁকার গোপন ইচ্ছাটির  প্রধান অংশ হচ্ছে মৃণালিনী দেবীর ছবি আঁকা।  সেই সময় স্বল্প কয়েকটি মৃণালিনী দেবীর ছবি এঁকেছিলেন।, কিন্তু লজ্জা ও সংকোচের জন্যে মৃণালিনী দেবীর আরও বেশি ছবির রূপ দিতে পারেন নি, মনের ইচ্ছা মনেই রয়ে গেল।  কিন্তু পরবর্তীকালে বৃদ্ধ কবি অতীতের  সেই গোপন ইচ্ছাটির প্রধান অংশটির রূপ দিলেন - ঘোমটা ঢাকা অশরীরী বিষন্ন নারীমূর্তিরূপে এবং তারই  সঙ্গে আঁকলেন নিজের বেদনার্ত মুখ।  আর, দুজনের মুখের উপরে ফেললেন অতীতের সেই দুর্লভ সন্ধ্যার লোহিত সাগরের সূর্যাস্তের রং ,যে রঙ কবির ভালোবাসামুগ্ধ হৃদয়ের মধ্যে মধ্যে চিরদিনের জন্য অঙ্কিত হয়ে রয়ে গেছে। এরই বিশদ বিবরণ রয়েছে ৩০ আগস্ট ১৮৯০ সালের য়ুরোপ -যাত্রীর ডায়ারিতে।  

এখানেই শেষ হলো এই পর্ব