ভূমিকা
উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলবর্তী ক্যালিফর্নিয়া রাজ্যের লস এঞ্জেলস কাউন্টির অন্তর্গত একটি প্রাচীন ঐতিয্যপূর্ণ শহরের নাম পাসাডেনা। এই পাসাডেনা শহরের দক্ষিণ প্রান্তের শান্ত মুক্ত পরিবেশে তৎকালীন ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের আদলে গড়া একটি বাড়ি ১৯০০ সালে স্বামী বিবেকানন্দের পাদস্পর্শে ধন্য হয়েছিল। ৩০৯ নম্বর মন্টেরী রোডে অবস্থিত এই বাড়িটি এখন বিবেকানন্দ হাউস নামে সুপরিচিত।
আমার কনিষ্ঠ পুত্র কার্যপলোক্ষে এই পাসাডেনা শহরের বাসিন্দা ছিল সেই সময়ে। স্বামী বিবেকানন্দের আমেরিকার পাসাডেনাতে গমন এবং সেখানে একটি বাড়িতে অবস্থানের কথা পূর্বেই বই পড়ে জানতে পেরে ওই পুণ্যস্থানটি দেখার বাসনা ছিল মনে মনে। ২০০১ সালের জুলাই মাসে ছেলের কাছে যাবার যখন সুযোগ এলো তখনও এই বাসনা মনের মধ্যে রেখেই ওখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম।
বিবেকানন্দ হাউসের সামনে থেকে তোলা ছবি |
অবশেষে আগস্ট মাসের এক দিন আমরা সকলে মিলে ওখানে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। এক চৌমাথার কাছে অবস্থিত ছবির মত বাড়িটির চারিদিক শান্ত ও শুনসান। বাড়ির দরজা সব সময় বন্ধ থাকে। প্রথম দিন আমরা ওখানে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে এমন কি দরজায় ধাক্কা মেরেও ঢুকতে পারি নি। অবশেষে টেলিফোনে ওখানের ভারপ্রাপ্ত স্বামীজীর সাথে যোগাযোগ করে আর একদিন ওখানে গিয়ে সবাই হাজির হয়েছিলাম। সেদিন ওখানে অনেক ভক্তের সমাগম হয়েছিল। আমরা সমস্ত বাড়ি ঘুরে ফিরে ওখানের অনেক ছবি তুলে খুশি মনে বাড়ি ফিরেছিলাম। ওখানে স্বামীজীর শয়ন কক্ষে যেটি এখন ধ্যান কক্ষ হিসেবে পরিচিত সেখানে একটি জাপানী মহিলা শিষ্য়াকে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয় গানগুলি সুললিত কন্ঠে গাইতে শুনেছিলাম। কলকাতা থেকে আগত এক প্রাচীন স্বামীজীর সাথে দেখা হয়েছিল সেখানে এবং তাঁর কিছু মুখ নি:সৃত বাণী শোনবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেদিন এক বিশেষ আনন্দ উপভোগ করেছিলাম। এক পুণ্য তীর্থক্ষেত্র দেখে পবিত্র হয়ে গিয়েছিল সকলের মন প্রাণ।
বিবেকানন্দ হাউসের আর একটি চিত্র |
দ্বিতীয় বারের দর্শন
প্রায় নয় বছর বাদে ২০১০ সালে আবার ছেলের কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন ছেলে বাসা বদল করে পাশের শহর আর্কেডিয়াতে চলে এসেছে। এবারেও ওখানে গিয়ে দর্শনের তালিকায় স্বামীজীর ওই পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত বিবেকানন্দ হাউস অগ্রগণ্য ছিল। এবারেও ওখানে গিয়ে প্রথম বারের পুনরাবৃত্তি ঘটল। আগে কোনো খবর না দেওয়ার ফলে বাড়িতে ঢুকতে পারি নি। মন:ক্ষুন্ন হয়ে বাড়ির সামনে পিছনে ঘুরে কিছু ছবি তুলে ফেরত এসেছিলাম। বাড়ির পিছনে আগের বইতে পড়া সুদৃশ্য বাগানের বেশ হতদশা দেখে খারাপ লেগেছিল ।
বিবেকানন্দ হাউসের পিছনের বাগানে আমার পুত্রবধূ |
এর পরে ওখানে ফোন করে আগস্ট মাসের আট তারিখে একটি অনুষ্ঠানের কথা শুনে ঐদিন ওখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু যেতে দেরী হয়ে যাওয়াতে সেদিনও প্রায় প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছিলাম না। অবশেষে ওখানের তত্ত্ববধায়ক স্বামীজী আমার পুত্রবধূর সানুনয় অনুরোধে আমাদের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে উপরে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। কোনো লোকজন না থাকাতে আমাদের সুবিধাই হয়ে গেল। আমরা মনের সুখে সমস্ত কিছু দেখে শুনে ছবি তুলে খুবই খুশি হলাম। দ্বিতল বাড়িটির একটি সুদৃশ্য কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটি ঢাকা দেওয়া অপ্রশস্ত রেলিং দেওয়া বারান্দা। প্রবেশ দ্বারের পাশে বড় বড় করে বাড়ির নম্বর ৩০৯ লেখা আছে।
বিবেকানন্দ হাউসের প্রবেশ দ্বার ,দ্বারের পাশেই বাড়ির নম্বর ৩০৯ |
বিবেকানন্দ হাউসের প্রবেশ সিঁড়িতে আমরা সবাই |
দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলেই একটি ছোট আলোকোজ্জ্বল হলঘর। এখান দিয়েই সোজা খাবার ঘরে চলে যাওয়া যায়। হলঘরের বাঁদিকে স্বামীজীর বসবার ঘর। এই ঘরের সামনে গাড়ি বারান্দার দিকে আছে জানলা। হলঘরে ঢুকেই ডান দিক দিয়ে দুভাজের ঘোরানো সিঁড়ি দ্বিতলে উঠে গেছে। ওখানেই দুটি কক্ষ আছে ,যার মধ্যে বড়টি স্বামীজীর শয়ন কক্ষ ছিল। বর্তমানে সেটি ধ্যান কক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। গতবারে আমরা উপরে যাবার অনুমতি পেয়ে ওগুলি দেখেছিলাম, কিন্তু এইবারে কর্তব্যরত স্বামীজী বিশ্রাম নিচ্ছিলেন বলে ওখানে আর যাওয়া হয় নি। স্বামীজীর বসবার ঘরের পাশেই বেশ বড়সড় একটি দরজাহীন ঘর রয়েছে।এটি খাবার ঘর। ওখানে স্বামীজীর লাইব্রেরী ও ডাইনিং টেবিল রয়েছে দেখলাম। এই খাবার ঘরের সন্নিহিত আর একটি ঘরে রান্ধনের ব্যবস্থা ছিল। আমরা নিরিবিলি বসবার ঘর, খাবার ঘর ও রান্না ঘর ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অনেক ছবি তোলা হলো। সমস্ত ঘরেই আগের সমস্ত কিছু সব আগের মত করে রাখা রয়েছে। লাইব্রেরী ঘরে বিশাল আলমারিতে প্রচুর অমূল্য পুস্তকের ভান্ডার রয়েছে। দেওয়ালে স্বামীজীর একটি বিশাল তৈলচিত্র রয়েছে। খাবার ঘরের এক কোণে স্বামীজীর ব্যবহৃত ডাইনিং টেবিল এখনো একইভাবে রয়েছে। এ ছাড়া দেওয়ালে তখনকার সময়ের বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি রয়েছে, যার মধ্যে তখনকার সময়ের খবরের কাগজে স্বামীজীর পাসাডেনাতে আগমনের ও বক্তৃতা দেবার খবর প্রকাশিত রয়েছে। এগুলি সম্বন্ধে পরে আরও অনেক কিছু লেখা থাকবে। তবে অনেক ছবি পুরানো হওয়াতে সেগুলির ছবি ভালো ওঠে নি।
বসবার ঘরের সমস্ত আসবাব এমনভাবে বিন্যস্ত অবস্থায় রয়েছে, মনে হয় যেন এগুলি গতকালের ঘটনা। তবে সব মিলিয়ে সব কিছুতেই এক অভূতপূর্ব পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ছাপ। সমস্ত কিছু দেখে শুনে মনে প্রাণে এক অনির্বচনীয় আনন্দের অনুভূতি হয়েছিল সেদিন আমাদের সকলের। নয় বছর আগের দেখা বাড়িটির সব কিছুই আগের মত রয়েছে দেখলাম। শুধু বাড়িটির পশ্চিম দিকে ট্রেন চলাচলের জন্যে ট্রেন লাইন পাতা হয়েছে। সেজন্যে ব্যস্ততা ও কোলাহল বেড়েছে। একদিন এই ট্রেনে করে যাবার সময় ট্রেন থেকে স্পষ্টভাবে বিবেকানন্দ হাউসকে দেখে খুশি হয়েছিলাম।
বিবেকানন্দ হাউসে স্বামীজীর বসবার ঘর |
বিবেকানন্দ হাউসে স্বামীজীর বসবার ঘরের আর একটি দৃশ্য |
বিবেকানন্দ হাউসে স্বামীজীর খাবার ঘর ও লাইব্রেরী |
বিবেকানন্দ হাউসে লাইব্রেরী ঘরে পুস্তক সজ্জিত আলমারী ,উপরে বুদ্ধ মূর্তি ও পাশে চেয়ার |
লাইব্রেরী ঘরে পুস্তকের আলমারীর আর একটি বড়ো দৃশ্য |
বৈঠকখানা ঘরে বহু পুরানো ফটো এবং দরজার কাছে রাখা ভিজিটরস বুক |
বিবেকানন্দ হাউসে স্বামীজীর রন্ধনশালা |
বিবেকানন্দ হাউসে সামনের হল ঘরের ভিতর দিয়ে খাবার ঘরের দৃশ্য |
খাবার ঘরের ভিতরে স্বামীজীর বিশাল তৈলচিত্র |
হলঘরে ঢুকেই ডানদিকে উপরে যাবার সিঁড়ি |
বিবেকানন্দ হাউসের পিছন দিকের বাগান থেকে বাড়িটির দৃশ্য |
বিবেকানন্দ হাউসের পিছনের বাগানের একটি দৃশ্য |
স্বামী বিবেকানন্দের বিবেকানন্দ হাউসে আগমনের ইতিহাস
'দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়াতে স্বামীজী' পুস্তক থেকে জানা যায় যে ১৯০০ সালের জানুয়ারী মাসের শেষের সপ্তাহে সম্ভবত ২৪শে তারিখের পরে যে কোনো এক দিন মীড ভগ্নিত্রয়দের বাসভবনে গিয়ে হাজির হন। কাহিনীতে আছে : " একদিন সকালবেলা -- একটি ভাড়া -করা ঘোড়ার গাড়ি হঠাত মীডদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। মীড ভগিনীগণ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে দেখলেন যে, স্বামীজী ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামছেন এবং তাঁর তল্পিতল্পাগুলো বাড়ির দরজার কাছে নামিয়ে বলছেন :'আমি তোমাদের কাছে থাকতে এলাম। ঐ ভদ্রমহিলার কাছে থাকা হলো বটে। ' কার বাড়ি থেকে যে স্বামীজী এমন ভাবে চলে এসেছিলেন এবং কোন তারিখে যে এই ঘটনাটি ঘটেছিল ,তা নিশ্চিত করে জানা যায় নি। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে , জানুয়ারী মাসের কয়েকদিন এবং গোটা ফেব্রুয়ারী মাসটা -দক্ষিণ পাসাডেনাতে মীডদের বাড়িই ছিল স্বামীজীর ঠিকানা। এখানে থাকাকালীন এই বাড়ির পিছনের পুষ্প শোভিত বাগানে বেড়াতে যেতেন ও বাচ্চাদের সঙ্গে সানন্দে খেলা করতেন। দ্বিতল বাড়িটি ১৮৭৭ সালের আগে নির্মিত হয়েছিল। পিচবোর্ডে আচ্ছাদিত কাঠের বাড়িটি ছিল ত্রিকোণ ছাদ বিশিষ্ট দুতলা এবং সামনে ছিল ছাদ দেওয়া গাড়ি বারান্দা। রোদে পোড়া রং এবং ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন ছিল এই বাড়িটি।
স্বামী বিবেকানন্দের দ্বিতীয়বার আমেরিকা ভ্রমণের সময় নিউইয়র্ক থেকে পশ্চিম উপকুলের লস এঞ্জেলস শহরে হাজির হন তাঁর কর্মকান্ড বিস্তারের জন্যে। সময়টি ছিল ১৮৯৯ সালের ডিসেম্বর মাস। স্বামীজীর ভক্ত শ্রীমতী জোসেফাইন ম্যাকলাউড এবং লস এঞ্জেলসের অধিবাসী শ্রীমতী ব্লোজেট স্বামীজীর ওখানের বক্তৃতার ব্যবস্থা করে দেন। লস এঞ্জেলসের ব্লানচার্ড হলে ৮ই ডিসেম্বরের প্রথম বক্তৃতায় তিন মীড ভগিনী শ্রীমতী এলিস হ্যান্সবোরো, শ্রীমতী ক্যারী ওয়াইকফ এবং শ্রীমতী হেলেন মীড উপস্থিত ছিলেন। ইউনিটি চার্চে ১২ই ডিসেম্বর পরবর্তী বক্তৃতার পরের দিন শ্রীমতী হ্যান্স বোরো এবং শ্রীমতী হেলেন মীড শ্রীমতী ব্লোজেটের বাড়িতে স্বামীজীর সাথে একান্তে দেখা করে তাঁদের বাড়িতে তাঁদের সঙ্গে বসবাসের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীজী এই প্রস্তাব ভদ্রভাষাতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে তিনি ঐ ভগিনীত্রয়কে তাঁর জন্যে কয়েকটি বক্তৃতার বন্দোবস্ত করতে অনুরোধ করেন। মীড ভগিনীরা সানন্দে ১৯শে থেকে ২১শে ডিসেম্বর তিনটি বক্তৃতার বন্দোবস্ত করেন। সেখানে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়েছিল। মিসেস হ্যান্সবোরো নিরাশ না হয়ে পরে পাসাডেনাতে বক্তৃতার সময় স্বামীজীকে এক রবিবারে নৈশ ভোজের আমন্ত্রণ জানালেন। এই প্রস্তাবে স্বামীজী ততক্ষনাত রাজি হয়ে গেলেন এবং তাঁকে মিস ম্যাকলাউডকেও নিমন্ত্রণ জানাতে বললেন।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা যায় যে স্বামীজী ও শ্রীমতী ম্যাক লাউড বড়দিনের আগের দিন ২৪ সেপ্টেম্বর মীড ভগিনীদের বাড়িতে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। এই নৈশভোজের ব্যাপারে মিসেস হ্যান্সব্রো বলেছেন: " ইলেকট্রিক ট্রেনে করে আমাদের বাড়িতে আসতে তাঁদের প্রায় একঘন্টা সময় লেগেছিল। ট্রেনটি বাড়ির কাছেই একটা মোড়ে এসে দাঁড়াল ; তারপর তাঁরা কয়েক পা হেঁটেই আমাদের বাড়ির দরজার কাছে এসে হাজির হলেন। আমি এখনো তাঁদের সেই ছবিটি দেখতে পাই -তাঁরা বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাই তাঁরা যখন এসে হাজির হয়েছিলেন তখনই আমি তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলাম। বাড়িতে প্রবেশ করতে করতে তিনি আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন- স্বামীজী ঘুরে ঘুরে বৈঠক খানা ঘরে গিয়ে হাজির হলেন। ঘরের উঁচু ও প্রশস্ত জানলাগুলির ভিতর দিয়ে আমাদের বাগানের গাছগুলি দেখা যেত। তিনি ঐ জানলার কাছে হাজির হয়ে কয়েক মিনিট কাল সেখানে দাঁড়িয়ে বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করলেন। চারিদিক থেকে সূর্যের কিরণ এসে যেন তাঁকে শুভ্র পর্দার আবেষ্টনীর মধ্যে চিত্রের ন্যায় আবদ্ধ করেছিল। তারপর তিনি আমাদের দিকে ঘুরে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। আমি মিসেস ব্লজেটের বাড়িতে তাঁকে যে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি তার জবাব দিলেন। শেষে তিনি বললেন -'হ্যা।, আমি তোমাদের বাড়িতে আবার দেখা করতে আসব !' তারপর তিনি একেবারে চলে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এবং শিগগির চলেও এলেন।"
এরই ফলশ্রুতি মত স্বামীজী ১৯০০ সালের জানুয়ারী মাসের শেষে মীড ভগিনীদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিলেন। এই বিষয়ে পূর্বেই বিশদ ভাবে লেখা হয়েছে।
৩০৯ নম্বর মন্টেরি রোডের উপর অবস্থিত মীড ভগিনীদের বাসভবনের কথা সংক্ষিপ্ত ভাবে আগেই বলা হয়েছে। স্বামীজী যখন ওই বাড়িতে থাকতে যান ,তখন ওপরের গাড়ি বারান্দার পূর্বপ্রান্তে এবং ছাদের উপরে ছিল ঝোপাবৃত গোলাপের বাগান -তখন প্রচুর রক্তাভ হলুদ রঙের গোলাপ ফুটেছিল -যে গোলাপের নাম " গোল্ড অফ অফির "-"বাইবেলোক্ত সুবর্ণদেশের সোনা।" 'বেদান্ত এন্ড দি ওয়েস্ট ' (নং ১৫৮) পত্রিকাতে একটি ফটোগ্রাফ ছাপানো আছে ; তাতে দেখা যাবে যে স্বামীজী বাড়িটির এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন ,আর তার পিছনে সেই গোলাপের বাগান। আর অন্যদিকে গাড়ি বারান্দার উপর একটি স্তম্ভের পেছন থেকে মিসেস ওযাইকোফ উঁকি দিয়ে দেখছেন। এই বিশেষ ফটো টিতে বাড়িটির শুধুমাত্র একটি অংশই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
উপরের বর্ণিত স্বামীজীর বাড়ির সামনে দন্ডায়মান সেই ছবি |
পরের অন্য ছবিতে এত পুষ্প শোভিত বাগানের দৃশ্য দেখা যায় নি। তখন বাগানটি তেমন সাজানো নয় এবং গোলাপের কেয়ারীরও তেমন জৌলুস নেই। মিসেস হ্যান্সব্রোর মেয়ে মিসেস পল কোহন তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন; তিনি এই বাড়িতে ছোটবেলায় বহু বত্সর কাটিয়ে ছিলেন; তখন এই বাড়ির সামনে থেকে রাস্তা পর্যন্ত খুব সাজানো একটি সবুজ ঘাসের মাঠ ছিল-আর এই মাঠের মাঝখানে ছিল বিরাট দেবদারু জাতীয় পাইন গাছ। পরবর্তীকালে যখন মীড পরিবার এই বাড়িটি ছেড়ে চলে যান ,তখন রাস্তাটিকে চওড়া করার জন্য মাঠটি একটু ছোট হয়ে যায়। পরের ছবিগুলিতে বাগানের গাছগুলিতে তেমন ফুলের বাহার দেখা যায় না । আমরাও নিজেরা বাগানের হতশ্রী দশা দেখে দু :খিত হয়েছিলাম। এই পাইন গাছকে পিছনে রেখে স্বামীজীর একটি ছবি বসবার ঘরে দেখেছিলাম।
পাইন গাছের সামনে দন্ডায়মান স্বামীজী |
মীড ভগিনীগণ এই বাড়িটি পরিত্যাগ করার পরে এক ভক্ত ১৯৫৫ সালে ৩০৯ নম্বর মন্টেরি রোডের বাড়িটি কিনে নিয়ে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বেদান্ত সমিতির হস্তে অর্পণ করেন। বেদান্ত সোসাইটি ১৯৫৬ সালে খুবই যত্নসহকারে বাড়িটিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন । এর পরেও বাড়িটির নানাবিধ সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। পাসাডেনা শহরের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে তাল রেখে ১৯৮৯ সালে বিবেকানন্দ হাউসকে সরকারী ঐতিহ্যশালী স্মারক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
বাড়িটি কিন্তু বেশ বিস্ময়করভাবে ছোট -ছবিতে যেরূপ দেখা যায় ,তার চেয়ে অনেক ছোট, তবে এখন আগের চেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়। শতাব্দীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত শেষ ভিক্টোরিয়ান শৈলীতে এই বাড়িটিকে সাজানো হলেও এর মধ্যে সে যুগের ঘিঞ্জি বা বদ্ধভাব নেই। এখন এটা বেশ খোলামেলা আলো হাওয়ায় ভরা এবং সুদৃশ্য। আকারে ছোট হলেও মনে হয় যেন প্রচুর জায়গা আছে। বাস্তবিকই যে কোনো ভক্ত যদি ওই বাড়িটি দেখেন ,তাহলে তাঁর উপলব্ধি করতে অসুবিধা হবে না যে, স্বামীজী একদিন এইসব ঘরগুলোর ভিতর চলাফেরা করতেন এবং তাঁর উপস্থিতি দিয়ে এই বাড়ির প্রতিটি স্থান ভরে রাখতেন। আজও এই বাড়িটি স্বামীজী ও মীড ভগিনীত্রয়ের স্মৃতিরক্ষা করে চলেছে।
বিবেকানন্দ ভবনের ভিতরের বিশদ বিবরণ পূর্বেই আমাদের ওখানে পরিদর্শনের দ্বিতীয় পর্বে আলোচিত হয়েছে। এখানে প্রামাণ্য পুস্তক অনুযায়ী স্বামীজীর ওখানে অবস্থানের সময় আরও কিছু বিবরণ দেওয়া হলো। বাড়িটির একতলার পূর্বদিকের শেষ প্রান্তে জানলাযুক্ত একটি চোর - কুঠুরি ছিল। স্বামীজীর সময় সেখানে একটি কমলা বাগান ছিল। খাবার ঘরটি সমগ্র বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে লম্বা ও বড় ঘর ছিল। মিসেস হ্যান্সব্রোর স্মৃতি অনুসারে এই ঘরটি প্রায়ই বৈঠক খানা হিসাবে ব্যবহৃত হত। এই খাবার ঘরেই মীড বোনেদের বাবা মি: জেস মীডের পর্দা ঘেরা শয়ন কক্ষ ছিল। আবার এই ঘরেই পরিবারের সকলে এবং তাঁদের অতিথিবর্গ সন্ধ্যার সময় ছোট চুল্লির আগুনে গা গরম করতেন ,কোনও কোনও সময় গল্প গুজব করতেন। সেসব আসরে যে কোনভাবেই হোক না কেন ,স্বামীজী উপস্থিত থাকতেন, কথা বলতে বলতে বেশ রাত হয়ে যেত। স্বামীজীর আমলে রান্নাঘরের পেছনের দরজার দিকে ছিল আর একটি গাড়ি বারান্দা ,এরই পাশে ছিল স্নানের ঘর। এই ছোট তিনটি ঘর এবং হলঘর -তাদের সেকোইয়া গাছের লালকাঠের দরজা - জানলা ,নানা কারুকার্যময় কাঠের কাজ এবং উঁচু ছাদ ও বড় বড় জানলা (সামনের এবং পেছনের দুটি গাড়ি বারান্দা) -সব মিলিয়ে ছিল বাড়ির একতলা।
আমাদের বাড়িটি পরিদর্শনের দ্বিতীয় দিনে আমরা উপরের তলায় কিছু দেখতে পারি নি। প্রথমবারের দর্শনের সময় উপরের তলায় গেলেও অনেক লোকের ভিড়ে তেমন করে খুঁটিয়ে অনেক কিছু দেখা হয় নি এবং কাউকে ওখানের বিশদ বিবরণ জিজ্ঞাসা করা যায় নি। এবারে এখানে প্রামাণ্য পুস্তক থেকে দোতলার বিবরণ জানাচ্ছি।
বাড়িতে ঢুকেই যে হলঘর ,সেই ঘর থেকে সোজা উঠে গেছে দু-বার সমকোণে ঘেরা আর গরাদ-ওয়ালা জানলা দিয়ে আসা আলোয় আলোকিত সরু একটি সিঁড়ি পথ, যা দিয়ে দোতলার ছোট আকারের বারান্দায় উঠে আসা যায়। এর বাঁদিকে আছে দুখানা শোবার ঘর - দ্বিতীয় ঘরখানা প্রথম ঘরের দ্বিগুণ বড়। আর ডান দিকে ছিল স্নানের ঘর। এই স্নানের ঘরের বিশেষ সুবিধা ও ব্যবস্থা নিয়ে মিসেস হ্যান্সব্রো যে অহংকার ও গর্ব প্রকাশ করতেন ,তা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। হলঘরের শেষপ্রান্তে ডানদিকের কোণে একটি দরজা আছে ,যেটি দিয়ে স্বামীজীর শোয়ার ঘরে প্রবেশ করতে হয়। বর্তমানে এ ঘরটি হচ্ছে একটি প্রার্থনা ঘর -ঠাকুর ঘর। এই ঘরটি আয়তনে প্রায় একাশি থেকে একশো বর্গফুট। ঘরে দুটি জানলা আছে -একটি পূর্বমুখী অপরটি দক্ষিণমুখী। এই ঘরের একটি ছবিতে পূর্ব দিকের জানলার কাছে একটি বিশাল আখরোট গাছ দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাওয়া যায়। দক্ষিণের জানলা দিয়ে রান্নাঘরের ছাদ দেখা যায় ,আর দেখা যায় পিছনের বাগান এবং খাড়া উঁচু বৃক্ষাচ্ছাদিত একটি পর্বত চূড়া। সত্যি সত্যি এই ছোট বাড়িটি ১৯০০ সালে এই দক্ষিণ পাহাড়ের প্রায় পাদদেশেই দাঁড়িয়েছিল -তখন এই অঞ্চল ছিল অনাবাদী, বন-জঙ্গল পরিবেষ্টিত এবং জনবসতিহীন অঞ্চল।
তখনকার দিনে দক্ষিণ পাসাডেনা শহরটি সরকারী প্রশাসনের দিক থেকে মূল পাসাডেনা থেকে পৃথক ছিল। তখনও এখানে ঘনবসতি গড়ে নি এবং তাই মীড পরিবারের বাড়ির চারদিকে প্রচুর খোলামেলা জায়গা ছিল। বাড়ির পিছিনে ছিল বাগান -যেখানে মি: মীড তরিতরকারি ,বেরি এবং নানা ফলের চাষ করতেন। পূর্ব দিকে ছিল কমলালেবুর বাগান ,পশ্চিমে ছিল এক প্রতিবেশীর বাড়ি-বাড়িটি ছিল ঝোপঝাড় এবং বিশাল এক ওক গাছের আড়ালে। (ওক গাছের ডালে মিসেস হ্যান্সব্রোর মেয়ের একটি দোলনা ঝোলানো থাকত। ) তখন কাঁচা রাস্তার পাশে মোটেও কোনো বাড়িঘর ছিল না। যদিও ট্রাম গাড়ি কখনো কখনো রাস্তার এক পাশ দিয়ে যাতায়াত করত ,তথাপি এই অঞ্চলটি ছিল নিস্তব্ধ শহরের নি:শব্দ একটি অঞ্চল। তাই স্বামীজী মিসেস হ্যান্সব্রো কে বলতেন যে, তিনি অনুভব করতেন সেখানকার পরিবেশ ছিল বিশ্রামের পক্ষে উপযুক্ত এবং ঠিক ভারতবর্ষের পরিবেশের মত।
এখানেই শেষ করছি এই পবিত্র পুণ্য ভবনের স্মৃতিকথার প্রথম পর্ব।এর পরের পর্বে মিসেস হ্যান্সব্রোর স্মৃতিচারণ থেকে স্বামীজী মীড পরিবারে প্রায় ছয় সপ্তাহকাল ধরে বসবাসকালে যা কিছু করতেন -তিনি কী খেতেন ,কেমন পোশাক-আশাক পরতেন- ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হবে। সেটি কিন্তু কম চিত্তাকর্ষক হবে না এবং স্বামীজীর সম্বন্ধে আমাদের আরও একটি নতুন ধারনার সৃষ্টি করবে।