Sunday, June 15, 2014

রবীন্দ্রনাথের সংসার যাত্রার কিছু খুঁটিনাটি


ভূমিকা
রবীন্দ্রনাথের সংসারযাত্রার কথা বলতে গেলে তাঁর বিবাহপর্ব থেকে শুরু করা দরকার। এই প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক  বর্তমান পত্রিকায় ২৪সে মে তারিখ থেকে  শ্রী পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায় মহাশয় "কবির সংসার " শীর্ষক একটি কথিকা ধারাবাহিক ভাবে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে চারটি পর্ব প্রকাশিত হয়ে গেছে। এই চারটি পর্বের মধ্যে প্রথম তিনটি পর্ব রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের সংসার যাত্রা নিয়ে লিখিত।  চতুর্থ পর্বে তিনি রবীন্দ্রনাথের বিবাহ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। এই ক্রমবিন্যাস আমার মন:পুত হয় নি। এই কথিকার বেশির ভাগই আমার এবং অধিকাংশ রবীন্দ্রানুরাগীদের পরিচিত। সেজন্যে এই কথিকার বিশেষ অপরিচিত অংশগুলি  নিয়ে এখানে আলোচনা ও উল্লেখ করবার ইচ্ছেতেই এই ব্লগের অবতারণা  ।   

শিলাইদহের প্রথম পর্বেই  একটি তথ্যগত ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে।  পার্থসারথীবাবু বাবু প্রথম পর্বে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহে  প্রথম সবাইকে নিয়ে যাওয়ার সময় নিয়ে বলেছেন যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশ অনুসারে বিবাহের দুই মাস পরেই তিনি সেখানে যান।  এখানে আমার কিছু বক্তব্য আছে।  ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয় যশোরের ফুলতলী গ্রামের ভবতারিণীর সাথে। ১৮৮৮ সালেই রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী  দেবীর দাম্পত্য জীবন পূর্ণতা লাভ করে গাজীপুরের নিভৃত নিবাসে।  বিবাহের প্রায় চার বছর   পরে   রবীন্দ্রনাথ স্ত্রী ও শিশুকন্যা বেলা সঙ্গে দাসী ভজিয়াকে নিয়ে  সর্বপ্রথম সুবৃহত ঠাকুর পরিবারের এবং সুবিশাল জোড়াসাঁকোর বাড়ির বাইরে গাজীপুরের   নিভৃত  নিবাসে দাম্পত্যজীবনের আনন্দ অনুভব করার সুযোগ পান। গাজীপুর থেকে  ফিরে আসার পারে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে স্বামী ,পুত্র কন্যাসহ শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে ও পদ্মাবাক্ষে মৃণালিনী দেবী কিছুদিনের জন্যে বাস করেছিলেন। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহে প্রথমবার বিয়ের দুই মাস বাদে যাওয়ার উল্লেখ সঠিক  মনে হয় না ।  তা ছাড়া স্বল্পকাল বিলাস প্রবাসের পর স্বদেশে ফেরার পরই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে শিলাইদহে জমিদারী দেখাশোনার ভার গ্রহণ  করেন।  সেটি আরও পরের ঘটনা। সেটি ১৮৯১ সালের ঘটনা। সেজন্যে পার্থাসারাথীবাবুর এই শিলাইদহে প্রথম যাওয়ার সময়ের উল্লেখ সম্বন্ধে সন্দেহ থাকিয়া যায়। এটির রেফারেন্স জানা জরুরি।

শিলাইদহ পর্ব -প্রথম ভাগ 


এবারে  শিলাইদহ পর্বের কবির সংসার্ পর্বের কথা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।  পদ্মা ও গোড়াই নদীর সঙ্গমে বুনোপাড়ার  কাছে নীলকর সাহেবদের প্রাচীন কুঠিবাড়ি কিনেছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।  প্রাচীন কুঠিবাড়িটি   পদ্মায় বিলীন হয়ে গেলে নতুন কুঠি বাড়ি নির্মিত হয় ১৮৯২ সালে। নীলকরদের একজন ছিলেন বহুশ্রুত শেলি  সাহেব। তারই নামে শেলির  দহ - এই শেলির দহ থেকেই এলাকার নাম শিলাইদহ।  আদি নাম খোরশেদপুর।

 রথীন্দ্রনাথ তাঁর 'পিতৃ স্মৃতি' গ্রন্থে লিখেছেন, বাবা যখন আমাদের নিয়ে শিলাইদহে গেলেন তখন এই নীলকুঠি নেই -তার ধ্বংসাবশেষ আমরা দেখতুম নদীর ধারে বেড়াতে গেলে. বাংলাদেশে এসে পদ্মানদী খুব খামখেয়ালী স্বভাবের হয়ে গেছে. কখনো গা ঘেঁসে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংশ করেছে ,আর অন্য পাড়ে নতুন পলি-পড়া উর্বরা জমি তৈরী করে দিচ্ছে. --- নীলকুঠির প্রতি পদ্মার অনেকদিন পর্যন্ত নজর যায় নি,হঠাত খেয়াল হলো, সেইদিকের পাড় ভাঙতে শুরু করলো. বাড়িসুদ্ধ নদীগর্ভে যাবে ভয়ে  বাড়িটা আগে থেকেই ভেঙে ফেলা হল. তার মালমশলা নিয়ে নদী থেকে খানিকটা দূরে আর একটা কাছারি ও কুঠিবাড়ি তৈরী করা হয়. আমরা যখন শিলাইদহে গেলুম-এই নতুন বাড়িতে বাস করতে লাগলাম. (এই কুঠিবাড়িটা এখনো আছে. শুনতে পাই,  সে দেশের বর্তমান সরকার সেই বাড়িটা  মিউজিয়াম করে রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন.) কিন্তু আশ্চর্য, পুরানো কুঠিটা ভাঙা হল বটে, কিন্তু নদী বাগানের গেট পর্যন্ত এসে আবার ফিরে গেল. যতদিন আমরা শিলাইদহে ছিলুম সেই নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ  অটুট  ছিল. 

পিতার কাছ থেকে জমিদারির কাজে শিলাইদহে যাওয়ার  আভাস পান রবীন্দ্রনাথ বক্সার থেকে লেখা এক চিঠি মারফত। চিঠিতে মহর্ষি পুত্রকে নির্দেশ দেন , 'এইক্ষণে তুমি জমিদারির কার্য পর্যবেক্ষণ করিবার জন্যে প্রস্তুত হও ,প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিতরূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমাওয়াশীল বাকী ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি রপ্তানি পত্র সকল দেখিয়া তার সারমর্ম নোট্ করিয়া রাখো। প্রতি সপ্তাহে আমাকে রিপোর্ট দিলে উপযুক্ত মতে তোমাকে উপদেশ দিব এবং তোমার কার্যে  পারদর্শীতা  ও   বিচক্ষণতা আমার প্রতীতি হইলে আমি তোমাকে মফ:স্বলে থাকিয়া কার্য করিবার ভার অর্পণ করিব। '

পুত্রের বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেতে পিতার বেশি সময় লাগে নি। স্বল্পকালের মধ্যেই মফ:স্বলে থাকিয়া কার্য করিবার দায়িত্ব পেলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বভাব যাঁর আসমানাদারি -তিনি করতে চললেন জমিদারি।  যিনি আকাশে  ফেলে তারা ধরেন,তাঁর মনে দ্বিধা উপস্থিত হয়েছিল , 'হয়ত আমি একাজ পারব না,হয়ত আমার কর্তব্য আমার কাছে অপ্রিয় হাতে পারে।----১৮৯১ সালে পিতার ফরমান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ জমিদারির কাজ দেখতে গিয়েছিলেন  শিলাইদহ ,সাজাদপুর ও পতিসর। শিলাইদহের কাছেই তিনটি মহাল-কয়া ,জানিপুর ও কুমারখালি।  কিছু দূরে ডাকুয়াখালের পান্টি মহাল -সেখানে কবি একবার  সাক্ষাত ' যমরাজের সঙ্গে একরকম 'হাউ -ডু - ইউ  -ডু করে' আসেন। স্মরণ করেন ' মৃত্যু যে ঠিক  আমাদের নেক্সট ডোর নেবার তা  এরকম ঘটনা না হলে সহজে মনে হয় না. '

সেদিন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে   ফিরে শিলাইদহ থেকে দুখানা চিঠি লেখেন-একটি ভ্রাতুষ্পুত্রী   ইন্দিরা দেবীকে ,অপরটি পত্নী মৃণালিনী  দেনীকে।

১৮৯২ সালের ২০ জুলাই তিনি ইন্দিরাকে জানান,' আজ এইমাত্র প্রাণটা যাবার জো  হয়েছিল।পান্টি থেকে শিলাইদহে যাচ্ছিলুম ,বেশ পাল পেয়েছিলুম ,খুব হু হু শব্দে চলে আসছিলুম।  বর্ষার নদী চারিদিকে থৈ থৈ করছে এবং হই হই শব্দে ঢেউ উঠছে, আমি মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছি এবং মাঝে মাঝে লেখাপড়া করছি। বেলা সাড়ে সময় গড়ুই  নদীর ব্রিজ দেখা গেল।  বোটের মাস্তুল ব্রিজে বাধবে কিনা   তাই নিয়ে মাঝিদের  মধ্যে  তর্ক  লেগে  গেল -ইতিমধ্যে বোট  ব্রিজের অভিমুখে  চলেছে।  তখন বোঝা গেল সামনে  একটি বিপদ উপস্থিত।  কিন্তু বেশিক্ষণ চিন্তা করবার সময় ছিল না ,দেখতে দেখতে বোট ব্রিজের উপর গিয়ে পড়ল।  মাস্তুল মুড় মুড় করে ক্রমেই কাত  হতে লাগলো  ,আমি হতবুদ্ধি মাল্লাদের ক্রমাগত বলছি -তোরা  এখান থেকে সর ,মাথায় মাস্তুল ভেঙ্গে মরবি নাকি ! এমন সময় আর একটি নৌকা  তাড়াতাড়ি এসে  আমাকে তুলে নিলে এবং রশি ধরে   আমাদের বোটটিকে টানতে লাগলো।  তপসি এবং আর একজন মাল্লা রশি দাঁতে কামড়ে সাতারে ডাঙায় উঠে টানতে লাগল; সেখানে আরও অনেক লোক জড়ো হয়ে বোট টেনে তুলল। সকলে ডাঙায় ভিড় করে এসে বলল ,'আল্লা বাঁচিয়ে দিয়েছেন,নইলে  বাঁচবার কোনো কথা ছিল না। '

সেদিন এই বিপদের কথা জানিয়ে পত্নী মৃণালিনী  দেবীকে তিনি লেখেন, ' ভাই ছুটি -আজ আর একটু হলেই আমার দফানিকেশ হয়েছিল। তরীর সঙ্গে দেহতরী আর একটু হলেই ডুবেছিল।  আজ সকালে পান্টি থেকে পাল তুলে আসছিলুম -গোড়াই  নদীর ব্রিজের নিচে এসে আমাদের বোটের মাস্তুল ব্রিজে আটকে গেল -সে ভয়ানক ব্যাপার -একদিকে স্রোতে বোটকে ঠেলছে আর একদিকে মাস্তুল ব্রিজে আটকে গেছে - মড়মড়  শব্দে মাস্তুল হেলতে লাগলো এবং একটা মহা সর্বনাশ হবার উপক্রম হলো।  এমন সময় একটা খেয়া নৌকা এসে আমাকে তুলে নিয়ে গেল এবং বোটের কাছি নিয়ে দুজন মাল্লা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে ডাঙায় গিয়ে টানতে লাগলো -ভাগ্যি সেই নৌকা এবং ডাঙায় অনেক লোক সেই সময় উপস্থিত ছিল তাই আমরা উদ্ধার পেলুম ,নইলে আমাদের বাঁচবার কোনও উপায় ছিল না- ব্রিজের নীচে জলের তোড় খুব ভয়ানক -জানিনে ,আমি সাঁতরে উঠতে পারতুম কিনা কিন্তু বোট নিশ্চয় ডুবত। '

কিন্তু এত  বড়  ঘটনার পারে কেউ কি সেই খেয়া নৌকার সামান্য মাঝিকে মনে রেখেছে যার অসামান্য প্রত্যুত্পন্নমতিত্বে  ও প্রচেষ্টায় রক্ষা পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জীবন। সেদিন সম্ভবত সঙ্গে ছিল না কবির জলে-স্থলে বহু অভিযানের সঙ্গী গফুর মিঞা বা গফুর  বাবুর্চি।  এই গফুর বাবুর্চির কথা রয়েছে কবির পত্নীকে লেখা চিঠিতে। পদ্মা হাউসবোট থেকে ১৮৯৩ সালের ৭ই জুলাই তিনি মৃণালিনী দেবীকে লিখছেন ' কবিত্ব এবং সংসার এই দুটোর মধ্যে বনিবনাও আর হয়ে উঠলো না দেখছি. কবিত্বে এক পয়সা খরচা নেই (যদি না বই ছাপাতে যাই)আর সংসারটাতে পদে পদে ব্যয়বাহুল্য এবং তর্কবিতর্ক। এইরকম নানা চিন্তা করছি এবং খালের মধ্যে দিয়ে বোট টেনে নিয়ে যাচ্ছে -আকাশে ঘননীল মেঘ করেছে - ভিজে বাদলার বাতাস দিয়েছে ,সুরজ প্রায় অস্তমিত -পিঠে একখানি শাল চাপিয়ে জোড়া সাঁকোর  ছাত আমার সেই দুটো লম্বা কেদারা এবং সাতলা ভাজার কথা এক একবার মনে করছি। সাতলা ভাজা চুলোয় যাক রাত্রে রীতিমত আহার জুটলে বাঁচি। গফুর মিঞা নৌকার পিছন দিকে একটা ছোট উনুন জ্বালিয়ে কি একটা রন্ধন কার্যে নিযুক্ত আছে  মাঝে  মাঝে ঘিয়ে ভাজার চিড় বিড়  চিড় বিড়  শব্দ হচ্ছে -এবং নাসারন্ধ্রে একটা সুগন্ধ আসছে কিন্তু এক পশলা বৃষ্টি এলেই সমস্ত মাটি।'
কবিপত্নী জানতেন ,গফুর মিঞা শুধু একজন সামান্য বাবুর্চি  নন,কবির নদীপথে যাতায়াতে বহু বিপদের দু:সাহসী সঙ্গী। প্রয়োজনে তাঁর জন্যে জীবন বিসর্জন  করতেও কুন্ঠিত নন।

রথীন্দ্রনাথের পিতৃস্মৃতি গ্রন্থ থেকে শিলাইদহের একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা জানা যায়।   রথীন্দ্রনাথের কথায়, ' ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে আমি একবার একলা শিলাইদহে গিয়েছিলুম।  সেবারকার একটি ঘটনা বেশ মনে আছে-ঘটনাটি বেশ গল্প লেখার মত।  পুজোর পরেই বাবা শিলাইদহে গেলেন বোটে ,নদীর  থাকবেন বলে. কিন্তু  নদীর জল তেমন নামে নি ,বালির চর জাগে নি।  শুকনো চর খুঁজে বের করার জন্যে নদীর এপার অপার ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে -এমন সময় ঝড়ের লক্ষণ দেখা গেল। বাবা মাঝিদের বললেন একটি দহের মধ্যে বোট নিয়ে রাখতে।  কি ভাগ্যি সময় মত দহের মধ্যে আশ্রয় নেওয়া  হয়েছিল ,না হলে বিপদ ঘটত। দড়াদড়ি   দিয়ে ভালো করে নৌকা বাঁধার  পরেই ঝড় এল।  তিনদিন তিন রাত সাইক্লোনের ঝড়বৃষ্টি সমানে চলেছিল। আমরা যে দহের মধ্যে ঢুকেছিলাম ,দেখতে দেখতে চারিদিক  ছোট বড় নানারকম নৌকা এসে তার মধ্যে আশ্রয় নিল।  দহের মধ্যে ঢেউ আসতে পারে না -আমরা বেশ নিরাপদে আটঘাট বেঁধে সেখানে রইলুম।  বোটের জানলা দিয়ে দেখতাম নদীর খরস্রোতে রাশি রাশি ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ ,ভাঙা নৌকার কাঠকুটো  জলের উপর দিয়ে  ভেসে চলেছে। বুঝতে পারলাম নদীর ধারের বহু গ্রামের সর্বনাশ হয়েছে ,খোলা নদীতে যত নৌকা ছিল ডুবে গেছে। তৃতীয় দিনের বিকেলবেলায় ঝড়ের প্রকোপ কমে গেল , বাবা আমাকে নিয়ে ডেকের  উপরে এসে বসলেন। হটাত তিনি মাঝিকে ডেকে বললেন ,'দেখো তো ,মাঝ নদীর জলে কী যেন ভেসে যাচ্ছে? চুলের মত মনে হচ্ছে ,মেয়েমানুষের চুলের গোছাই হবে . যা, শীঘ্র জলিবোটটা নিয়ে যা।'  তুফান দেখে মাঝি সাহস করে নাম  না. বাবা তখন নিজেই নামার উদ্যোগ করছেন -এমন সময় পিছন থেকে ছুটে এসে বাবাকে সরিয়ে দিয়ে গফুর বাবুর্চি ছোট বোটটাতে লাফিয়ে পড়ল এবং উত্তম মধ্যম গালাগালি দিতে দিতে  মাঝিদের  টেনে নামিয়ে বোট ভাসিয়ে দিল।  আমরা শংকিত ভাবে দেখতে লাগলাম ,বোটটা সময়মত মজ্জমান  স্ত্রীলোকটির কাছে পৌঁছতে পারে  কিনা।  মাঝিরা ঘন ঘন দাঁড় ফেলছে ঢেউয়ের উপর-আছাড় খেতে খেতে বোট ছুটে চলেছে ,তবু যেন তাঁর কাছে পৌঁছতে পারছে না. অন্ধকার হয়ে  এল -আর কিছু দেখা যায় না ,কেবল গফুর মিঞার হাঁক ডাক মাঝে মাঝে কানে আসে।  অনেকক্ষণ পর বোট ফিরে এলো ,বাবুর্চির তখন কী উল্লাস -'মিল গিয়া, বাবুজি ,মিল গিয়া!' শোনা গেল মেয়েটি কিছুতেই বোটে উঠতে চায় নি,চুল ধরে কোনরকমে তাকে বোটে তোলা হয়েছিল। বাবা দেখলেন -একটি যুবতী স্ত্রীলোক্ সুন্দর তার চেহারা ,বোটের এক কোণে জড় সড় হয়ে বসে আছে. অনেক কষ্টে তার কাছ থেকে তার পরিচয় বার করতে পারলেন। শিলাইদহের কাছেই তার বাড়ি ,স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ,কিন্তু  সাঁতার জানত বলে ডুবতে পারে নি.
বাবা তার শ্বশুরকে চিনতেন,তাকে ডেকে পাঠিয়ে বৌকে   নিয়ে যেতে বললেন।  ছেলেকে শাসন করে দিতেও বললেন ,যাতে এরকম ঘটনা আর না হয়।  শুনতে পাই পরে স্বামী -স্ত্রীর মধ্যে আর ঝগড়া হয় নি-পরম সুখে তারা সংসার করেছে। 

 এই গফুর বাবুর্চির অসম সাহসিকতার কথা আর একবার শোনা গেছে রবীন্দ্রনাথের সপরিবারে ১৮৮৯ খ্রীস্টাব্দের নভেম্বর -ডিসেম্বর মাসের শিলাইদহে বাস করার সময়ে। সেবারে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, পুত্র কন্যা সহ ছিলেন ভাইপ বলেন্দ্রনাথ ও বান্ধবী আমলা দাশ।  এখানে থাকাকালীন মৃণালিনী দেবী বান্ধবী আমলা দাশ ও ভাসুর পুত্র বলেন্দ্রনাথ বলেন্দ্রনাথ পদ্মার চরে বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে যান. এই হারিয়ে যাওয়ার একাধারে উপভোগ্য ও অন্যদিকে উদ্বেগজনক বিবরণ রবীন্দ্রনাথ তার ছিন্নপত্রাবলীর তিন নম্বর পত্রে ও বলেন্দ্রনাথের 'পারিবারিক খাতা'য় সুন্দর ভাবে ধরে রাখা আছে।
শীতের পদ্মার বিস্তীর্ণ চরে বেলাশেষে  কুয়াশা নামে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে মৃণালিনী দেবীরা দিগভ্রান্ত হন।  পথ হারিয়ে  গভীর বিপদের মুখোমুখি।পদ্মার চরে ঝুপ করে নেমে আসা অন্ধকারে বলেন্দ্রনাথ দ্রুত পা চালাতে গিয়ে পাঁকের মধ্যে পড়েন।  কোনোমতে জুতো শুদ্ধ পা তুলে হাঁটবার চেষ্টা করে কাকিমাকে পরামর্শ দেন ছোটবার। সে সব কথায় কান না দেওয়াতে মতবিরোধ  শুরু হলো। সবাই তখন বালি   সমুদ্রের মধ্যে। চারিদিকে শুধু ধু ধু করছে বালি। প্রথমটা পথ হারানো বুঝতে পেরেও কেউ নিরাশ হয়ে পড়েন ভেবে কাউকে কিছু স্বীকার করলেন না বলেন্দ্রনাথ। শেষকালে  সব  বলে কাকিমাকে বোঝানো হলো যে, একটা উঁচু জমিতে   উঠলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কাকিমা মন্দ হাঁটতে পারেন না , তিনি রাজী হলেও তাঁর সহচরী খুব গোলযোগ তুললেন। শোনা গেল তাঁর নাকি গা হাত পা হিম হয়ে আসছে ,চলবার সামর্থ্য নেই ইত্যাদি। এরকম বিপদের মধ্যেও মাথা ঠিক রেখে পাঁক  ভর্তি ডোবা থেকে জল সংগ্রহ করে কাকিমার হাত দিয়ে সহচরীকে খাওয়ানো হলো, সহচরীর মূর্চ্ছা বাঁচানো গেল।  তারপরে বলেন্দ্রনাথ গফুর , আলো ,আলো করে চিত্কার শুরু করে দিলেন। মানুষ থাকলে তবে তো লোকে সারা দেবে। কেবল  প্রতিধ্ব্বনি শোনা যেতে লাগলো।  অনেক বলার পরে সবাই মিলে একটি উঁচু জায়গাতে উঠে লোকের আওয়াজ শোনা গেল।  হেঁকে ডেকে অনেক করে শেষে  একদল মেছোদের  কল্যাণে   পথ পাওয়া গেল।

এবারে এই ঘটনাতে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলীতে তাঁর উদ্বেগের বিশেষ উল্লেখ করে তার বিবরণ শোনা যাক।
গতকল্য এই মায়াউপকূলে অনেক ক্ষণ বিচরণ করে বোটে ফিরে গিয়ে দেখি -ছেলেরা ছাড়া আমাদের দলের কেউ ফিরেন নি. একবার ভাবলাম ডেকে পাঠাই ,কিন্তু স্বার্থ এবং দয়া উভয়ে একত্রে মিলে  আমাকে নিরস্ত করলে। অর্থাত , কতকটা নিজের  সুখ এবং কতকটা তাদের সুখের প্রতি দৃষ্টি করে আমি একখানি আরাম কেদারাতে স্থির হয়ে বসলাম -Animal Magnetism-নামক একখানা অত্যন্ত ঝাপসা বিষয়ের বই একখানি বাতির ঝাপসা আলোতে বসে পড়তে আরম্ভ করলুম।  কিন্তু কেউ আর ফেরেন না।
  --- বই খানাকে খাটের উপুড় করে রেখে বেরোলাম।  উপরে উঠে চার দিকে চেয়ে কালো মাথার কোনো চিহ্ন দেখতে পেলুম না- সমস্ত ফ্যাকাশে ধু ধু করছে। একবার বলু বলু পুরো জোরে চীত্কার করলুম -কন্ঠস্বর হু হু করতে করতে দশ দিক ছুটে গেল,কিন্তু কারও সাড়া পেলুম না ,তখন বুকটা হটাত সব  দিক থেকে দমে গেল, একখানা বড় খোলা ছাতা হটাত বন্ধ করে দিলে যেমনতর  হয়।  গফুর আলো নিয়ে বেরোলো ,প্রসন্ন বেরোলো ,বোটের মাঝিগুলো বেরোলো , সবাই ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন দিকে চললুম -আমি এক দিকে বলু বলু করে চীত্কার করছি-প্রসন্ন আর এক দিকে ডাক দিচ্ছে 'ছোটো মা'- মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে মাঝিরা 'বাবু বাবু' করে ফুকরে উঠছে।  সেই মরুভূমির মধ্যে নিস্তব্ধ রাত্রে অনেকগুলো আর্তস্বর উঠতে লাগলো। কারও সাড়াশব্দ নেই।  গফুর দুই এক বার দূর থেকে হেঁকে বললে 'দেখতে পেয়েছি' ,তার পরেই আবার সংশোধন করে বললে 'না' ' না' -আমার মানসিক অবস্থা একবার কল্পনা করে দেখ।  কল্পনা করতে গেলে নি:শব্দ রাত্রি ,ক্ষীণ চন্দ্রালোক,নির্জন নিস্তব্ধ শূন্য চর ,দূরে গফুরের চলনশীল লন্ঠনের আলো- মাঝে মাঝে এক দিক থেকে  কাতর  কন্ঠের আহবান  এবং চতুর্দিকে তার উদাস প্রতিধ্বনি- মাঝে মাঝে আশার  উন্মেষ এবং পরমুহুর্তেই সুগভীর নৈরাশ্য -এই সমস্তটা মনে আনতে হবে।    অসম্ভব রকমের আশঙ্কা সকল মনে জাগতে থাকলো। কখনও মনে হলো চোরাবালিতে পড়েছে ,কখনও মনে হলো বলুর হয়ত হটাত মূর্ছা কিংবা কিছু একটা হয়েছে ,কখনও বা নানাবিধ শ্বাপদ জন্তুর বিভীষিকা কল্পনায় উদয় হতে লাগলো। মনে মনে হতে লাগলো -'আত্মরক্ষা -অসমর্থ  যারা , নিশ্চিন্তে ঘটায়  বিপদ।' স্ত্রী- স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলাম -বেশ বুঝতে পারলুম বলু বেচারা ভালোমানুষ ,দুই বন্ধনমুক্ত রমনীর পাল্লায় পড়ে বিপদে পড়েছে।  এমন সময় ঘন্টাখানেক পরে রব উঠলো এঁরা চর বেয়ে বেয়ে ওপারে গিয়ে পড়েছেন, আর ফিরতে পারছেন না. তখন ছুটে বোট অভিমুখে চললুম -বোটে গিয়ে পৌঁছতে অনেক ক্ষণ লাগলো। বোট ওপারে গেলে বোট লক্ষ্মী বোটে ফিরলেন -বলু বলতে লাগলো ,'তোমাদের নিয়ে আমি আর কখনও বেরোব না'। 'সকলেই অনুতপ্ত ,শ্রান্ত, কাতর ,সুতরাং আমার ভালো ভালো উপাদেয় ভর্ত্সনাবাক্য হৃদয়েই রয়ে গেল- পরদিন প্রাত:কালে উঠেও কোনমতেই রাগাতে পারলুম না।  সুতরাং এত বড় একটা ব্যাপার পরস্পর হেসেই উড়িয়ে দিলে ,যেন ভারী একটা তামাশা হচ্ছিল।     এই বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে এই ঘটনা রবীন্দ্রনাথকে কতটা বিচলিত করে তাঁর দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মানুষ  রবীন্দ্রনাথের এ এক  উপভোগ্য চিত্র। এই ঘটনার স্মৃতি নিয়েই মূলত 'নৌকাডুবি ' উপন্যাসের পটভূমি তৈরী  হয়েছিল মনে।
 পরবর্তীকালে এই শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে বাস ও বাগানের পুকুর ঘাট ও স্নানরতা ও ষোলো বছরের রন্ধন পটিয়সী সুগৃহিণী মৃণালিনী দেবী ও উনত্রিশ বছরের রোম্যান্টিক কবি স্মৃতিচারণা করে বৃদ্ধ বয়সে চিঠির মারফত অতীতকে ধরে রেখেছেন বীথিকা কাব্যের  'নিমন্ত্রণ ' কবিতাতে। যেখানে কবি পূর্বের মত মৃণালিনী দেবীকে নানারকম মিষ্টির ফরমাশ দিচ্ছেন।  আর মৃণালিনী দেবীর হিসাবের খাতা ও ফেলে যাওয়া আধুলির প্রতি নির্দেশ করে কালের ও মৃনালিনী দেবীর আর্থিক সঙ্গতি ও হিসাবী মনোভাবের ছবি এঁকেছেন। কবি বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর প্রিয় স্থান শিলাইদহে কিছুদিনের জন্যে বাস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বার্ধক্য হেতু তিনি শিলাইদহের কুঠিবাড়ির পরিবর্তে গঙ্গার ধারে 'পদ্মা' বোটে চন্দন নগরে বাস করে চিঠির মারফত অতীতের শিলাইদহের কুঠিবাড়ি ও বাগানের পুকুর ঘাটের স্মৃতিচারণা করেছেন। রবীন্দ্রজীবনে মৃণালিনী দেবীকে চিঠি   লেখার এক বিশেষ ভূমিকা আছে,  বিশেষভাবে  যৌবনের প্রথম দিকের মানসী পর্বের চিঠিগুলিতে (১৮৮৮-১৮৯০)  . তাই কবি এই কালের অর্থাত ১৮৯৯ সালের শিলাইদহের কুঠিবাড়ি,বাগানের পুকুরঘাট ও ১৬ বছরের মৃণালিনী দেবী ও  উনত্রিশ বছরের কবিকে স্মরণ করে বৃদ্ধ বয়সে এই চিঠির অবতারণা।

শিলাইদহের প্রথম পর্ব এখানেই সমাপ্ত।