আমার ছোট ছেলে ২০০৯ সালে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের লস এঞ্জেলস কাউন্টির অন্তর্গত একটি ছোট শহর আর্কেডিয়াতে নিজ বাসগৃহ কিনে চলে এসেছিল। ওরা আগে এরই পাশের শহর প্রাচীন শহর পাসাদেনা তে একটি এপার্টমেনটে থাকত। আমরা দুজনে ওখানে ২০০১ সালে গিয়ে খুবই আমোদ প্রমোদ করে এসেছিলাম। এই আর্কেডিয়াতে আছে একটি সুন্দর মনোরম আর্বরেটাম। আর্বরেটামের অর্থ হলো বিশাল আয়তনের বোটানিক্যাল গার্ডেন যেখানে বিভিন্ন ধরনের নানা দেশের সুদৃশ্য ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। ২০০৬ সালে ওদের মেয়ে অবন্তী জন্মানোর পরে ও একটু বড় হলে ছেলে ও পুত্রবধূ কন্যাকে নিয়ে পাসাদেনা থেকে এই আর্কেডিয়ার আর্বরেটাম দেখাতে নিয়ে এসেছিল। সেটা নিছক বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখাতে নয় ,বরং এর বিশেষ আকর্ষণ ময়ূরের ঝাঁকের অবাধ ঘোরাফেরা দেখানোর জন্যে। খুব কাছে থেকে সেই ময়ূরের ঝাঁকের ঘোরাফেরার দৃশ্য ছবিতে দেখে খুব ভালো লেগেছিল এবং সুযোগ পেলে এগুলিকে দেখবার প্রচন্ড কৌতূহল ছিল।
দীর্ঘ নয় বছর বাদে ২০১০ সালে ছেলের নতুন শহর আর্কেডিয়াতে ছেলে ,বৌমা ও নাতনীর কাছে গিয়েছিলাম তখন ওদের বাড়িঘর দেখার পরেই একদিন পুত্রবধূ পিউ আমাদের সেই আর্বরেটাম ও ময়ূর মহল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। এই আর্বরেটাম এবং ময়ূর্ মহল ওদের বাড়ির খুব কাছেই। ওখানে যাওয়ার আগে যখনি ওই পথ ধরে সোজা সামনের হাই ওয়েতে গিয়েছি তখনি বাঁদিকে একটি ফোয়ারা থেকে অবিরত জল পড়তে দেখেছিলাম। পিউকে ওটির কথা জিজ্জাসা করাতেই ও বলেছিল যে ওটাই বিখ্যাত আর্বরেটামের প্রবেশ পথ। ২১শে জুলাই পুত্রবধূর সাথে আমি,গিন্নী এবং আমাদের অতি আদরের নাতনি অবন্তী আর্বরেটাম দেখতে বেরিয়ে পরলাম। ওদের বাড়ির প্রধান সড়ক ফেযার ভিউ এভেনিউ ধরে সোজা গিয়ে আমরা ডানদিকে বল্ডউইন এভেনিয়ু ধরে উত্তর দিকে একটু গিয়েই সেই অভীপ্সিত স্থানে পৌঁছে গেলাম। উত্তর বল্ডউইন এভেনিউয়ের উপর অবস্থিত এই আর্বরেটামের বিপরীতেই রয়েছে স্যান্টা এনিটা রেস ট্র্যাক ও বিশাল শপিং মল। আর্বারটামের প্রবেশ পথে সদা লাস্যময়ী ফোয়ারা পর্যটকদের সর্বদাই স্বাগত জানাচ্ছে। পার্কিং স্পেসে গাড়ি রেখে পুত্রবধূর সাথে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। পার্কিং লট থেকে নামতেই চারদিকের শ্যামল সবুজ গাছ গাছালির ইশারা এখানের বিরাট আকর্ষণ। ক্যামেরা হাতে আমি সব সময়ে উদগ্রীব। রিসেপসন সেন্টারে ঢোকবার মুখেই বিশাল ক্যানা ফুলের ঝাড়ের সামনে ওদের ছবি তুলতে দেরী করলাম না। ক্লিক ক্লিক ক্লিক!
এবারে সবাই রিসেপসন সেন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম। সুদৃশ্য প্রবেশদ্বারের ভিতর দিয়ে ভিতরে ঢুকে ওখানের সুন্দর সাজানো গোছানো পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হলাম। দেশের কলকাতার বি বা দী বাগের সরকারী পর্যটন দপ্তরের ঘিঞ্জি অন্ধকার পরিবেশের কথা খুব মনে পড়ছিল। পিউ রিসেপসন কাউন্টারে কর্মরতা মহিলার সাথে কথাবার্তা বলে গেল আর আমি নাতনিকে নিয়ে ভিতরের সুদৃশ্য ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। দেওয়ালে আর্বরেটামের বিশাল মানচিত্র যাতে পুরো গার্ডেনের বিভিন্ন স্থানের বিশেষ উল্লেখ রয়েছে। যারা হেঁটে দেখতে চান তাদের জন্যে বিভিন্ন জায়গা দিয়ে পার্কের ভিতরের স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। কি কি করনীয় এবং কি কি করা নিষেধ তার স্পষ্ট নির্দেশিকাও সেখানে ছিল। এ ছাড়া অন্যত্র এই পার্কের ভিতরের বিভিন্ন জায়গার নানা প্রজাতির নানা বর্ণের গাছ গাছালি , ফুল ,ক্যাকটাস ও অর্কিডের ছবি সুন্দর ভাবে দৃশ্যমান ছিল। পিউ ইতিমধ্যে আমাদের জন্যে পার্কে ঢোকার টিকিট কেটে ফেললো। বড়দের টিকিট আট ডলার, ছোটদের কোনো টিকিট লাগে না। পিউ বার্ষিক সদস্য হওয়াতে তার কোনো টিকিট লাগলো না। যেহেতু এই বিশাল আয়তনের ১২৭ একরের পার্কে আমাদের তখনকার শারীরিক অবস্থায় হেঁটে ঘোরা সম্ভব নয় তাই আমাদের জন্যে ওখানের দুই কামরার ট্রামে ঘোরার ব্যবস্থা র জন্যে জনা প্রতি চার ডলারের টিকিট কেটে নেওয়া হলো। বেলা এগারটা থেকে বিকেল তিনটে পর্যন্ত এক ঘন্টা অন্তর অন্তর এই ট্রামে করে পুরো পার্ক ঘোরানো হয়। ধীর গতির এই ট্রাম পরিভ্রমণে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগে। বেলা বারোটার ট্রিপ নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।
হাতে কিছুক্ষণ সময় থাকাতে ট্রাম ছাড়ার জায়গার আশেপাশে একটু ঘুরতে গেলাম। তখনি ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা। আমাদের মাথার উপর দিয়ে সামনেই পাখা ছড়িয়ে নামল একটি বিশাল ময়ূর। এত সামনে থেকে এত বড় ময়ূর এত স্বাধীন ভাবে দেখাটা সত্যি বিস্ময়কর। আমার নাতনি অবন্তী তো আনন্দে হাততালি দিতে দিতে তার পিছনে ছুট দিল। আমরাও তাঁর পিছনে পা চালালাম।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা একটি বিশাল মাঠের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ওখানে চারপাশে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের এবং অন্যান রকমের গাছ পালা নজরে এলো। চারিদিক বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সামনেই একটি সুদৃশ্য কফিবার। সামনের ঢাকা দেওয়া চত্বরে অনেকেই বসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে আয়েশ করছেন। ওখানেই একপাশে আমাদের দুই কামরার ট্রাম গাড়ি দেখলাম। ওখানেই দাঁড়িয়ে আমাদের সফরের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
এই সময়ে চারিদিক থেকে ময়ূরের সম্মিলিত কেকাধ্বনী শুনতে পেলাম। এই আওয়াজের কথা বইতে পড়েছি ,কিন্তু এত সামনে থেকে এত স্পষ্টভাবে এই আওয়াজ শোনার এই অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ধ্বনিটি মধুর না হলেও বিচিত্র অনুভূতি হলো। কেকা ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে ময়ূরের ঝাঁক নেমে আসতে লাগলো। মাঠের চার দিকে, কফি শপের চারধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। চারপাশের অগনিত লোকজন দেখে এদের কোনো ভয়ডর নেই। এখানের দর্শকেরা খুবই ভদ্র, এরা এদের কোনো রকম বিরক্তি উত্পাদন করে না। শুধু আমার নাতনি সমেত ছোট ছোট বাচ্চারা এদের পিছন পিছন ঘুরতে লাগলো। সবাইয়ের সঙ্গে আমিও নাতনির পিছন পিছন ক্যামেরা বাগিয়ে ময়ূরদের ঝাঁকে মিশে গেলাম। এ এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। এর পরে এই বাগানে ঘোরার সময় বিবিধ গাছপালা ও নানা রঙের পুষ্পরাজি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। অনেক ছবি তুলেছি। তবে এই ময়ূর মহলের স্মৃতি কোনদিন ভুলতে পারি নি।
শুনলাম ১৮৭৫ সালে এই আর্বরেটামের মালিকানা ইলিয়াস লাকি বল্ড উইন কিনে নেবার পরে ভারতের রাজস্থান থেকে একজোড়া ময়ূর কিনে এখানে নিয়ে আসেন। আজকে সেই ময়ূরের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। এই বোটানিক্যাল গার্ডেনের মূল আকর্ষণ এই ময়ূরের ঝাঁক। এখানে ময়ূরেরা অবাধে বিচরণ করে। এরা বাচ্চাদের পক্ষে খুবই সুরক্ষিত। যেহেতু এইসব ময়ূরদের কেউ বিরক্ত করে না, সেজন্যে এই ময়ূরের দল অবাধে সবার সাথে একাত্ম হয়ে যত্র তত্র ঘুরে বেড়ায়। পুরুষ ময়ূরদের পাখনার রং বিচিত্র ও খুবই সুন্দর। শোনা গেল যে সঙ্গম কালে পুরুষ ময়ূরেরা তাদের সঙ্গিনীদের তাদের উজ্জ্বল ও বিচিত্র রংয়ের পেখম নাচিয়ে আকর্ষণ করে। তবে দু:খের বিষয় ,আমাদের স্বল্পকালীন অবস্থানকালে পুরুষ ময়ূরদের পেখম তুলে ঘুরে বেড়াতে দেখি নি। ময়ূরদের সেই বিখ্যাত কেকাধ্বনী আগে বইতে পড়া থাকলেও এখানেই সর্বপ্রথম স্বকর্ণে শুনতে পেলাম। এই রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে বহুবার অতিক্রম করার সময়েও মাঝে মাঝে এই আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। এখানের সামাজিক জীবনের উপর ময়ূরদের বিশাল প্রভাব পড়েছে। সেজন্যে আর্কেডিয়ার সরকারী প্রতীক ময়ূর।
সকাল বারোটা বাজার একটু আগেই আমরা সফরের জন্যে নির্দিষ্ট ট্রাম গাড়িতে নিজেদের টিকিট দেখিয়ে উঠে পড়লাম। সামনের কামরাতে আমরা আয়েশ করে বসলাম। পিছনে একটি চীনা পরিবার ছিল। পিছনের কামরাতে আরও কয়েকটি পরিবার বসেছিল। ট্রাম ধীর গতিতে এগিয়ে চলল। চালক আগে থেকেই মাইক্রফোনে এখানের বিভিন্ন গাছ গাছালির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। গাড়ি যাওয়ার পথ আর্বরেটামের একদিক দিয়ে গিয়ে চক্রাকারে অন্য দিক দিয়ে ঘুরে এসেছে।
এই বোটানিক্যাল গার্ডেন বিশ্বের বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন নামী দামী প্রজাতির গাছের জন্যে বিখ্যাত। মূলত ভৌগলিক অঞ্চলের বিচারে প্রায় পাঁচ হাজার বিভিন্ন গাছ গাছালি দিয়ে এই আর্বরেটাম সুসজ্জিত। এই অঞ্চলগুলি হলো আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চল ,দক্ষিণ পশ্চিম ইউরোপ, দক্ষিন ও উত্তর আমেরিকা এবং এশিয়া। এ ছাড়া এখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নানা ইউক্যালিপ্টাস গাছের সমাবেশ আছে।
ট্রাম চলতে আরম্ভ করলে নিমেষের মধ্যে পট পরিবর্তন হতে শুরু করলো। ট্রামের এক পাশে বসে দুদিকের গাছ গাছালির দিকে নজর রাখা এবং ওই গতির মধ্যে ক্যামেরাতে তাক করে ছবি তোলা খুবই দুরূহ ব্যাপার। প্রথমেই নানা আকারের ও নানা ধরনের ক্যাকটাস ও সাকুলেনটের সুসজ্জিত সারি দেখা গেল চারিদিকে। এগুলো বেশ পরিকল্পনামাফিক লাগানো হয়েছে বলে মনে হলো।
বিভিন্ন রকমের বিশাল আয়তনের ও বিস্তৃত আকারের গাছ দেখা যাচ্ছিল দুই ধার ধরে. কোনটা ফেলে কোনটা দেখব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পার্কের মধ্যে অনেক দর্শককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছিল। এই বিশাল বাগানের মধ্যে হারিয়ে যাবার কোনো ভয় নেই। অনেক জায়গাতেই বাগানের লোকেশন ম্যাপ দেওয়া রয়েছে। সেখানে বাগানের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। ওই ম্যাপ দেখে দর্শকেরা নিজেরাই এই বাগান সহজেই দেখে নিতে পারেন। তবে যেটা সবচেয়ে নজর কাড়লো সেটা এখানের নিপুণ তত্ত্বাবধানের ছাপ। কোথাও অনাবশ্যক আবর্জনা জমে নেই এই বিশাল আয়তনের পার্কে।
অনেক গাছের তলায় ময়ূর ও ময়ূরীরা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এটা এদের অভয়ারণ্য বলা চলে। এখানে অনেক জলাশয় রয়েছে। এরকম এক বিশাল লেকের পাশ দিয়ে আমাদের ট্রাম চলছিল। জলের মধ্যে পাথরের উপর নানা প্রজাতির হাঁসেদের দেখতে পেলাম। ওখানে ট্রাম একটু থামলে কাছে গিয়ে ভালোভাবে ছবি তুলতে পারতাম, কিন্তু সে সুযোগ হলো না। এই বল্ডউইন লেকের একপাশে সুদৃশ্য গম্বুজাকৃতি এনের কটেজ দেখতে পেলাম। এটি নাকি লাকি বল্ডউইন ১৮৮৫ সালে এই ঘোড়ার খুরাকৃতি লেকের পারে বানিয়েছিলেন। লেকের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ঝরনার জল এই লেকে এসে পড়েছে। এখানে এই ধরনের জলের ব্যবস্থা ছাড়া আর্টেজিও কূপের ব্যবস্থা ছিল। এত সুন্দর পাতাওয়ালা ,নানা রঙিন ফুলের গাছে ঢাকা আর্বরেটামের সমস্ত দৃশ্য ক্যামেরাতে ধরে রাখা অসম্ভব। মনের স্মৃতিকোঠায় ওদের রেখে দেওয়াই ভালো। আর ছবি তোলা তো আরও দু:সাধ্য। গাড়ির গতির সাথে তাল মিলিয়ে ছবি তুলতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তাতে কিছু পাহাড়ী ঝরনার দেখা পেলাম। ওখানে নেমে পরে ছবি ইচ্ছার কথা চালক কে জানিয়েও লাভ হলো না।
পার্কের এক পাশে ধুম্রজালের ভিতর দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার সেই বিস্তৃত সান গাব্রিয়েল পর্বত শ্রেণী দেখতে পেযেছিলাম। এই পাহাড় আর্কেডিয়ার সমস্ত জায়গা থেকে দেখতে পাওয়া যায়। এই পটভূমিকাতে বাগানের ভিতর দিয়ে যেতে বেশ রোমাঞ্চকর লাগছিল। বাগানের মধ্যে স্প্রিন্ক্লার দিয়ে বহু জায়গাতে বড় বড় গাছগুলিকে ধুয়ে দিতে দেখছিলাম। বাগানের এত বড় কর্ম যজ্ঞ বেশ সুশৃঙ্খলভাবে হতে দেখলাম। এইভাবে নানা সুদৃশ্য গাছপালার মধ্যে দিয়ে আমাদের চক্রাকার পরিভ্রমণের সমাপ্তি ঘটল।
মিনিট চল্লিশ ধরে ট্রামে এই উদ্যান পরিভ্রমণ শেষ করে আমরা এখানের বিখ্যাত গ্রীন হাউসের দিকে চললাম। এখানে বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য অর্কিড ও অন্যান্য উদ্ভিদের সমারোহ আছে শুনেছিলাম। পথে যেতে ঝাউগাছ দিয়ে ঘেরা একটি প্রান্তর অতিক্রম করলাম। শুনলাম ওখানে নাকি নানা ধরনের অনুষ্ঠান ও কিশোর কিশোরীদের সামার ক্যাম্প কর্মসূচী পালন করা হয়।
এই প্রান্তর অতিক্রম করে গ্রীন হাউসে ঢোকবার মুখে বেশ কয়েকটি অপরূপ ক্যাকটাস দেখতে পেলাম। এত সুন্দর এবং বড়সড় জাতের ক্যাকটাস সচরাচর আমাদের কলকাতার সমতলভূমিতে চোখে পড়ে নি। জানি না উত্তর বঙ্গের কালিম্পঙ এর বড় বড় নার্সারিতে এধরনের প্রজাতির ক্যাকটাস পাওয়া যায় কি না!
গ্রীন হাউসে ঢোকার মুখেই বেশ চমক. একটি মোচা জাতীয় ফুলের শোভা দেখে মুগ্ধ হলাম। ওটির ছবি তুলে গ্রীন হাউসের ভিতরে প্রবেশ করলাম। সেখানে সুন্দর বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে এই সব দুষ্প্রাপ্য রকমের অর্কিড ও অন্যান্য এখানের উপযোগী উদ্ভিদের উত্পাদন ও সংরক্ষণের জন্যে। এখানেই জীবনে প্রথম পতঙ্গভুক উদ্ভিদের দেখা পেলাম। এদের কথা বইতে পড়েছি ও সেখানেই ছবি দেখেছি। স্বচক্ষে এই প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ। ছোট কলসির আকারের উদ্ভিদগুলো এমনভাবে উপর থেকে ঝুলছে যে সামনে থেকেও ওদের পতঙ্গ ধরার কার্যকারিতা বোঝা মুস্কিল।
ভিতরে কৃত্রিম ছোট ছোট প্রস্রবণ বানিয়ে তার চারপাশে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। নানা রকম কলাকৌশল প্রয়োগ করে এই সমস্ত দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদ্গুলির প্রজননের সুন্দর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানেও ভিতরে এত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে সব কিছু সুবিন্যস্ত করে রাখা হয়েছে যে চোখ ফেরানো মুস্কিল। এখানের এই মুগ্ধকর স্মৃতিগুলোকে মনে ধরে রাখবার জন্যে কিছু ছবি নিচে সন্নিবিষ্ট করলাম। আশা করি পাঠকদের ভালো লাগবে।
সকাল থেকে আবহাওযা বেশ ভালো ছিল। রোদের তেজ তেমন চড়া ছিল না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তাপ বাড়তে থাকায় আমরা সকলেই বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সাময়িক বিশ্রামের জন্যে আমরা কফি কর্নারের দিকে পা চালালাম। কাফেতে যখন কিছু খাবার ও ঠান্ডা পানীয়ের জন্যে অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম তখন কাফের ঢাকা বারান্দাতে আবার ময়ূরের ঝাঁকের আবির্ভাব। চারিদিকে নির্ভয়ে ওদের বিচরণ। আমার নাতনী অবন্তী তো ওদের দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওদের কাছে ছুটে গেল। ওরাও নাতনীকে দেখে যেন ভাবখানা " দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।" ওদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একই সঙ্গে বসে রইল। ওদের সাথে কত কথা বললো আমার নাতনী। ওরাও ওদের বন্ধুকে ভালো ভাবে চিনে নিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগলো।
কিছুক্ষণ বাদে আমরা সবাই ময়ূরদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আর্বরেটামের গিফট সেন্টারের দিকে চললাম। ওখানে ঢোকার আগেই গিফট সেন্টারের সামনে সুসজ্জিত ভাবে এখানের নানা প্রকার ক্যাকটাস, সাকুলেনটের কিছু সাজি দেখতে পেলাম। বেশ সুন্দর সংগ্রহ।
গিফট সেন্টারে নানা ধরনের উপহার সামগ্রী, আর্বরেটামের উপরে লেখা নানা রকমের বই, পিকচার পোস্ট কার্ড ও অন্যান্য আকর্ষনীয় সম্ভার দেখা গেল। আর্বরেটামের স্মৃতি হিসাবে কিছু জিনিসপত্র কিনে এবারে বাড়ি ফেরার পালা । অবিস্মরণীয় আর্বরেটাম এবং ততোধিক মনোরম ময়ূরের ঝাঁকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরে চললাম এক মধুর আবেশের মধ্যে দিয়ে।
আর্বরেটামের এই কাহিনী শেষ করার আগে পাঠক সাধারণের কৌতূহল নিরসনের জন্যে এই বাগানের কিছু পূর্বতন ইতিহাস বলে যেতে চাই। প্রায় তিন হাজার বছর আগে এই আর্বরেটাম ও বোটানিক্যাল গার্ডেন আলাউপকিনা ( Aleupigna) অর্থাত অনেক জলের উত্স হিসাবে পরিচিত ছিল। দুশো বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়াতে স্প্যানিশ অধিবাসীদের আগমনের পরে এই আলাউপকিনার অধিবাসীরা গ্যাব্রিযেলিনো নামে পরিচিত ছিলেন। এই জায়গাটা নামের পরিবর্তন ঘটিয়ে স্যান্টা আনিটা হয়ে গেল। এই জায়গাটা সান গ্যাব্রিয়েল মিশনের কৃষিভিত্তিক কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত হলো। মেক্সিকোর অধিবাসী কিন্তু জাতিতে স্কটিশ হুগো রিড নামে এক ভদ্রলোক এক গ্যাব্রিলিয়েনো মহিলাকে বিবাহ করে এই স্যান্টা আনিটা র স্বত্তাধিকার পেলেন এবং ১৮৪০ সালে এই লেকের ধারে এক সুন্দর বাড়ি তৈরী করেন।
ইলিয়াস লাকি বল্ড উইন ১৮৭৫ সালে এই রাঞ্চ স্যান্টা আনিটা কিনে নিলেন। এর ফলে তিনি এখানকার সম্পত্তির অন্তর্গত লেক ও অন্যান্য জলাশয়ের অধিকারী হলেন। এ ছাড়া তাঁর বাসস্থানের উত্তরের বড় ছোট স্যান্টা আনিটা ক্যানিয়নের অধিকার নিয়ে নিলেন। বল্ডউইন রানচ ২০০০ একর বিস্তৃত এক আর্টেজীও বেল্টের উপর অধিষ্ঠিত ছিল। রেমন্ড পাহাড়ের ফল্টের উপরের অবস্থিতির কারণেই এই আর্টেজীয় উত্সের উতপত্তি। বল্ড উইন রান্চের সেচের জন্যে শতকরা ৬০ ভাগ আর্টেজীয় উত্স থেকে এবং বাকি ৪০ ভাগ ক্যানিয়নের জল থেকে পাওয়া যেত। এই বল্ডউইন লেক ১৮৮০ সালের শেষ দিকে আরও ১২-১৫ ফুট গভীর করে কাটানো হয়। চারিধারে গ্রানাইট পাথরের পাচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়।
বল্ড উইনের বেলভেডিয়ার যা আজকে কুইন এনের কটেজ নামে পরিচিত, ১৮৮৫ সালে ঘোড়ার খুরের লেকের থেকে বেরিয়ে আসা এক খন্ড জমির উপর প্রস্তুত করা হয়েছিল। লেকে জল সরবরাহকারী ঝর্নাগুলির উত্স ছিল উত্তর ও দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথে। লাকি বল্ড উইন আর্কেডিয়ার অধিবাসীদের উচ্চ মানের ক্যানিয়ন ও আর্টেজীয জলের সরবরাহ করতে শুরু করলেন। লাকি বল্ড উইন কিন্তু কোনও দিন ওই সুদৃশ্য এন কটেজে থাকেন নি। আর্বরেটামের অবাধ বনভূমি ক্রমাগত জঙ্গলের রূপ নিতে শুরু করলো। ১৯৩০ সালের পর থেকে হলিউড এখানের ঘন জঙ্গলের পটভূমিকায় আকৃষ্ট হয়। ফলে বেশ কয়েকটি টিভি শো ,সিনেমা ও কমার্শিয়াল চিত্রগ্রহণ শুরু হয়ে যায়। এর প্রথমটি হচ্ছে জনপ্রিয় টারজান সিরিজ। টিভি সিরিজ ফ্যানটাসী আইল্যান্ডের চিত্রগ্রহণ আর্কেডিয়ার এই আর্বরেটামেই সম্পন্ন হয়। আজ এই বোটানিক্যাল গার্ডেন এই ব্যবসার সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িত।
আর্বরেটামের বিভিন্ন প্রকারের সুদৃশ্য গাছপালা ও ময়ূরের আকর্ষণ ছাড়াও এখানে সব বয়সের লোকেদের জন্যে বিভিন্ন ধরনের মনোরঞ্জক অনুষ্ঠান বছরব্যাপী লেগেই থাকে। মাসের তৃতীয় রবিবার পারিবারিক পিকনিকের জন্যে ব্যবস্থা করা হয়। এখানে গ্রীষ্মকালে বাচ্চাদের জন্যে বনসৃজন ও জঙ্গল সংরক্ষণের উপর সামার ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সময়ে এখানে নানা ধরনের বিশেষ গাছের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে । ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাস নিয়ে ট্যুরের ব্যবস্থাও করা হয়। এখানের সবচেয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান হয় ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। এখানে লস এঞ্জেলস ফিলাহার্মনিক মুক্তাঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের কনসার্টের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। সমস্ত ক্যালিফোর্নিয়ার অধিবাসীরা এইসব কনসার্টের জন্যে উত্সুক হয়ে অপেক্ষা করে।
এখানেই ইতি টানলাম আর্কেডিয়ার বিখ্যাত আর্বরেটাম ও তার ময়ূর্ মহল নিয়ে বিশদ বিবরণের কাহিনী।
তবে অপ্রাসঙ্গিক হবে কি না জানি না, তবুও ময়ূরের পেখম তোলা এবং বর্ষার কোনো চিহ্ন না থাকা সত্ত্বেও ময়ূরদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই গানের কয়েকটি কলি মনের মধ্যে গুন গুন করতে করতে বাড়ি ফিরে চললাম।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।
শত বরনের ভাব- উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ ,
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে।