Thursday, May 30, 2019

আমার চোখে পুরানো কলকাতার ফেরিওয়ালা





আমার চোখে  পুরানো কলকাতার ফেরিওয়ালা

পুরানো উত্তর কলকাতার এক গলিতে প্রায় ৮০ বছরের উপর কাটিয়ে দিলাম । এই গলিতে বসবাসের কারণে কত ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছি তার লেখাজোকা নেই । স্মৃতিচারণ করতে বসে অনেক কথাই মনে পড়ে যায় । আজ হঠাৎ আমাদের ছোটবেলার এই গলিতে ভ্রাম্যমাণ বিভিন্ন রকমের ফেরিওয়ালাদের কথা মনে এসে গেল। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত নানা রকমের ফেরিওয়ালা বিভিন্ন পসারি নিয়ে হাজির হতো আমাদের এই গলিতে । তাদের বিভিন্ন রকমের চিৎকার , অঙ্গভঙ্গি , ছড়াকাটা সবই ছিল আমাদের কাছে আকর্ষণীয় । কিন্তু এরা কোনোদিন আমাদের বাড়িতে কড়া নেড়ে জিনিসপত্র বিক্রি করার অনুরোধ করতো না । নানাবিধ জিনিস বিক্রি করা ছাড়া নানা রকমের কাজের ব্যাপারে যেমন ছাতা সারাই , জুতো সারাই , খবরের কাগজ ও শিশি বোতল সংগ্রহ করা , চুল কাটার নাপিত , লোহার হাড়ি , কড়াই , ঘটি , বাটির ফুটো সারাই , ছুরি কাঁচি , বটিতে সান দেওয়া , তালা , চাবি নিয়ে বাড়ির সমস্যা মেটানো , বাটনা বাটার শিল নোড়া কুটিয়ে নেওয়া ইত্যাদি কাজের লোকের ভিড় লেগেই থাকতো দিনভর ।

এখন আমাদের জীবন যাত্রার ধরণ বদলে গেছে । আমরা আধুনিক যন্ত্র চালিত নানা দৈনন্দিন সাজ সরঞ্জাম ব্যবহার শুরু করেছি । সেজন্যে এই সব ফেরিওয়ালাদের বেশির ভাগকেই আর প্রয়োজন পড়ে না । সেজন্যে এরাও ধীরে ধীরে আমাদের গলি থেকে বিদায় নিয়েছে । এখন এদের জায়গাতে বিভিন্ন আধুনিক দোকান থেকে সুবেশা ছেলে মেয়েরা দৈনন্দিন জীবন যাপনের সরঞ্জাম বিক্রির জন্যে সাত সকালে কলিং বেল বাজিয়ে হাজির হন । অনেকে তাদের কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে হয়তো কিছু জিনিসপত্রের অর্ডার দিয়েও দেন । তবে সবাইয়ের উপর পুরানো ফেরিওয়ালাদের আন্তরিকতার ছোঁয়া কিন্তু খুবই মিস করি । এখন বলি সেদিনের সেই ফেরিওয়ালাদের কথা আমার স্মৃতির  সরণি বেয়ে ।




সকাল থেকেই শুরু হতো পুরানো কাগজ ,শিশি বোতল বিক্রি করার জন্য এই সব ক্রেতাদের বিভিন্ন ধরণের আওয়াজ ।ছোটবেলায় এটা খেয়াল করি নি ,কিন্তু বড় হয়ে ভাবতাম যে সাত সকালে কারা বাড়িতে কাগজ নিয়ে বসে আছে বিক্রি করার জন্যে আর ওই বিক্রিলব্ধ পয়সা দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে !

এরই সঙ্গে জুতো সেলাইয়ের মুচির আওয়াজ শোনা যেত ।কত যে জুতো হাজির হত ওর কাছে,তার ইয়ত্তা নেই । শীতকালে ভোর থেকেই লেপ  তোষক বানানোর জন্যে ধুনুড়িদের টং টং আওয়াজ শোনা যেত , এর সঙ্গে ছাতা সারাইয়ের কাজের লোক এসে যেত,বিশেষত বর্ষা কালে । তখন চুল দাড়ি কাটার সেলুনের চল শুরু হয় নি । সেজন্য পাড়াতেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই নাপিতেরা এই সব কাজ করে আসত । আমাদের ছোটবেলায় শ্রীপতি,রজনী,গণেশ আমাদের বাড়িতে সময় বুঝে আসত । শ্রীপতি তো আমাদের এক বাড়িতেই থাকত ,খেত,শুতো । এরই মাঝে ফলওয়ালা হাজির হত ফলের ঝুড়ি নিয়ে । তারপরে এসে হাজির শোনপাপড়িওয়ালা । হাতের থালাতে শোনপাপড়ি সাজিয়ে কতরকমেরে হাঁক পেড়ে সে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে শোনপাপড়ি বিক্রি করত ।ওর অত্যাধিক পরিশ্রমের জন্যই অনেকে শোনপাঁপড়ি কিনে নিত, যদিও দোকানে শোনপাঁপড়ি পাওয়া যেত ।আমাদের এখানে  বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রিটের সিটি কলেজের বিপরীতেই শোনপাপড়ি তৈরির কারখানা ছিল । ওখানে সস্তাতে শোনপাঁপড়ির ছাট পাওয়া যেত । ভাঙা বিস্কুটের মত এই ছাট দামে সস্তা আর খেতে খুব সুস্বাদু থাকত ।মাঝে মাঝে বেলার দিকে হঠাৎ হঠাৎ একটি মাছওয়ালা নানা রকম মাছ ঝুড়ি করে বিক্রি করতে আসত ।আমাদের বাড়ির কাছেই দুটো বাজার থাকাতে ও কেন মাছ নিয়ে আসত কে জানে ? বিক্রিবাট্টা বেশি হতে দেখি নি ।এরই মাঝে একটি লোককে ধীরে ধীরে ‘রিপ ‘ ’ রিপ’আওয়াজ করে যেতে দেখতাম । অনেকদিন পর্যন্ত বুঝতেই পারতাম না যে ওই লোকটি কি বলতে চাইছে আর ও কি বিক্রি করতে চাইছে । পরে জানলাম যে ও রিপু কর্ম ভালো করতে পারে । সেই রকম কাজ খোঁজার জন্যেই ঐরকম করে ডাক দিয়ে যায় ।

শীতকালে সকালের দিকে খেজুর গুড় মাথায় মাটির হাড়ি কিংবা কাঁধের বাঁকে মাটির কুঁজোর মত জালাতে করে নিয়ে আসত নিকটবর্তী গ্রামের লোকেরা । সঙ্গে আবার নলেন গুড়ের পাটালি থাকত ।এগুলোর কদর ছিল খুব ।এই গুড় কিংবা পাটালি পায়েসের মধ্যে দিলেই ভুর ভুর করে সুন্দর গন্ধে চারিদিক আমোদিত হয়ে যেত ।সে সব দিন চুকে বুকে গেছে ।এখন খেজুর গাছে চড়ে খেজুর রস আনার সেই শিউলি সম্প্রদায় প্রায় বিলুপ্ত হত বসেছে ।সুতরাং ভালো খেজুর পাওয়া এখন খুবই দুষ্কর ।এ ছাড়া এই সময়ে আমাদের কাছের জয়নগর থেকে জয়নগরের বিখ্যাত মোয়া নিয়ে আসত । খই আর ক্ষীর দিয়ে সুস্বাদু এই মোয়ার  অনেক সন্দেশ ,রসগোল্লার চেয়ে কদর ছিল বেশি । বহু সময় আত্মীয় কুটুম বাড়িতে এক হাড়ি জয়নগরের মোয়া অনেক উপাদেয় উপহার ছিল ।তবে এখন আর সেদিন ফুরিয়ে গেছে ।এখন জয়নগরের মোয়া বলে যেসব জিনিস বিক্রি হয় সেগুলি সবই ভেজাল দ্রব্য ।

দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত অনেক রকমের ফেরিওয়ালা এবং অন্যরকম লোকেদের আনাগোনা বেড়ে যেত  গলিতে ।কোনো কোনো দিন বাঁদর নিয়ে খেলা দেখাতে আসত ।দূর থেকে পরিচিত ডুগডুগির আওয়াজ শুনলেই আমরা ছোটরা দরজা দিয়ে মুখ বাড়াতাম  ।ছোটদের আবদারে কোনো না কোনো বাড়ি থেকে বাঁদর খেলা দেখার ব্যবস্থা হয়ে যেত ।ভীষণ প্রিয় ছিল এই খেলাটি ।অনেক কিছু উঠে গেলেও বাঁদর খেলা এখনও মাঝে মাঝে গলিতে দেখা যায় ।মাঝে মাঝে ভালুক নিয়ে খেলাও দেখা যেত ।ভালুকের দুলে দুলে নাচ ,ডিগবাজি খাওয়া ,শুয়ে গড়াগড়ি দেওয়া কত দেখেছি আর হেসে কুটোপাটি হয়েছি ।তবে ভালুকগুলো দেখলে মনে হত ওগুলোকে ভালো করে যত্ন করা হয় না, ভালো করে খাওয়ানো হয় না ।এ ছাড়া কাঁসার বাসন ও এলুমিনিয়ামের বাসনওয়ালাও চিৎকার করে তাদের বাসন বিক্রি করার কথা বলে যেত ।এর মধ্যেই মাথায় এক কাঠের বাক্স ও হাতে হাপর নিয়ে হাজির হত পুরানো বালতি,হাড়ি ,কড়াই প্রভৃতি সারাই করার লোক । হাঁক পাড়ত  ,পুরানো বালতি ,হাড়ি ,কড়াই সারাবেন? এই ঝালাই করার লোকের খুব চাহিদা ছিল তখন। অনেক সময় ঘাড়ে সান দেওয়ার যন্ত্র নিয়ে ছুরি,কাঁচি,বঁটি ইত্যাদিতে সান দেওয়ার জন্যে লোক হাঁক পাড়তে পাড়তে আসত । বেলার দিকে ‘সিল কোটাও’ বলে সিল নোড়া কুটিয়ে নেওয়ার জন্যে ডাক পেড়ে লোকের আনাগোনা ছিল ।অনেকেই এদের থেকে নানা গৃহস্থালী জিনিসে সান দিয়ে নিতো । শিল নোড়াও কুটিয়ে
নিত ।
তা ছাড়া আরও দুটি খুব মজাদার ফেরিওয়ালা মাঝে মাঝে আসত ।একটা হল ঠেলাগাড়ি করে তাতে জামা কাপড় থেকে গৃহস্থালির নানারকম প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে নিলামওয়ালা ‘সাড়ে  ছ আনা’ হাঁক পাড়তে পাড়তে এসে হাজির হওয়া ।অনেকেই এদের কাছ থেকে নানারকম টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনত। এদের নিয়েই তো সেই বিখ্যাত ‘নিলামওয়ালা ‘ গানটি চিত্রায়ন হয়েছিল এবং খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ।এ ছাড়া মাথায় করে বড় ঝুড়ির মধ্যে নানারকম মাটির  দেব দেবীর মূর্তি নিয়ে আসত কয়েকজন ফেরিওয়ালা ।

তাদের সুরেই বিখ্যাত সুরকার  সনৎ সিংহ গান লিখেছিলেন ,

আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি এতে রাম রাবণ আছে
দেখে যায় নিজের চোখে হনুমান কেমন নাচে ।
এ সুযোগ পাবে না ,কি দাম দেবে

পুতুল নেবে গো ,পুতুল। …

আমরা ছোটরা  গোল হয়ে নানারকম পুতুল দেখতাম । তবে বেশির ভাগ সময় কিছুই কেনা হত না ।

আর আসত মাঝে মাঝে ম্যাজিক দেখাতে  দুটো লোক ।দুজনের মুখে সব অদ্ভুত সব রং আঁকা থাকত।একজনের মাথায় একটা বড় ট্রাঙ্কে ম্যাজিকের সমস্ত সরঞ্জাম থাকত ।নানান রকম হাতের কারসাজির ম্যাজিক দেখাত ওরা ।চারিদিকে খুব ভিড় জমে যেত ।এছাড়া দড়ির রোপ ট্রিক দেখতে যাযাবর ছেলে ও মেয়ের দল দড়ির উপর দিয়ে হাঁটত ,দড়ি বেয়ে ওঠা ,নানারকম ব্যালান্সের খেলা দেখাত ।এগুলো সবই আমাদের মজা ও আনন্দ দিত ।এত সামান্যতেই আমরা তখন এত খুশি হতাম ,যে আজকালকার ছেলেমেয়েরা সেগুলো বুঝবেই না ।পরবর্তী জীবনে অনেক বড় খেলাধূলা থেকেও এত নির্মল আনন্দ পাই নি ।দুপুরে চাবির  গোছা হাতে নিয়ে ঝনঝন শব্দ করে তালাচাবিওয়ালা ঘুরে বেড়াতো পাড়াময় ।অনেক মুশকিল করেছে অনেক বাড়ির ,যার মধ্যে আমার বাড়ির সদর দরজার তালা খোলা এক অন্যতম কাণ্ড ।


এইভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত । বিকেল থেকেই অনেক রাত পর্যন্ত চলত নানারকম মুখরোচক খাওয়ার ফেরিওয়ালাদের আনাগোনা । বিকেল গড়িয়ে গেলে প্রথমেই হাজির হত গ্যাসবেলুনওয়ালা ।গ্যাসের সিলিন্ডার সহ নানা রঙের বেলুনের ঝুলি নিয়ে । আমরা  সব দৌড়ে যেতাম । অনেকেই বেলুন কিনে সাবধানে সূতো হাতে পেঁচিয়ে বাড়ি নিয়ে আসত। ফস্কে গেলেই সে বেলুন কোন তেপান্তরে চলে যাবে,নাগাল পাওয়া মুশকিল ।গরম কালে এর পরেই হাজির হত ঠেলা গাড়ি করে বরফের গোলা বানানোর উপকরণ নিয়ে বরফওয়ালা ।একটি উঁচু কাঠের টেবিলের উপরে কাঠের ভুষির মধ্যে বরফের বড় বড় খন্ড থাকত ।আমরা দৌড়ে গেলেই ওটা একটু ধুয়েই উপরে রাখা একটা করাতের মত জিনিসের গায়ে ঘষে ঘষে বরফের গুড়ো বার করে গোল একটি কাঠির আগাতে গোলা তৈরি করে ফেলত । তারপরে আমাদের ইচ্ছানুসারে নানা রঙের সিরাপ দিয়ে গোলাকে রং করে দিত ।ওই বরফের গোলা খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা ।আইসক্রিম কোথায় লাগে ! আমার অবশ্য  বেশি খাওয়ার উপায় ছিল না ,কারণ গলায় ঠাণ্ডা লাগলেই টনসিল ফুলে গিয়ে এক কেলেঙ্কারি ।তখন বকুনি ,বাইরে যেতে মানা ইত্যাদি নিষেধ চাপত ।আইসক্রিম তো এল অনেক পরে ।ওই জলি চ্যাপ ,হ্যাপি বয় নামে কোম্পানির আইসক্রিম হাতে টানা ছোট ঠেলা গাড়িতে করে নিয়ে আসত ।তবে সেখান থেকেও রং বেরঙের কাঠি আইসক্রিম খাওয়া হত বেশি ।তবে বরফের গোলার মত ভালো লাগত না ।

দুপুরে অথবা বিকেলের দিকে হাজির হত আইকম বাইকম বায়োস্কোপওয়ালা । মাথায় করে একটি টিনের বড় বাক্স ।নামলেই ওই বাক্সের গায়ে দেখা যেত গোল গোল কতগুলো ফুটো ,সেখানে কাঁচ লাগানো ।সেখানে চোখ লাগিয়ে দেখলে ভিতরে অনেক রকমের সুন্দর সুন্দর ছবি দেখা যেত ।আমরা সবাই গোল হয়ে ওই বাক্সের ওই গোল ফুটোতে চোখ লাগালেই ওই লোকটি বাক্সের পাশে লাগানো একটি হাতল ঘুরিয়ে এবার ভিতরের চলমান দৃশ্যের বর্ণনা দিত। আম্ররা যেন রূপকথার রাজ্যে পৌঁছে যেতাম ।ঐটুকু সময়ে আমরা সবাই যেন এক এক খুদে কলম্বাস হয়ে যেতাম । বলতে ভুলে গেছি ,রথের মেলার সময়ে পাড়াতে এসে হাজির হত তালপাতার বাঁশি নিয়ে গ্রামের ফেরিওয়ালা ।সেই তালপাতার বাঁশি এখন আর দেখা যায় না ।তখন প্রায় সবাইয়ের বাড়িতে সেই বাঁশির প্যাঁ ,পোঁ আওয়াজে বাড়ির লোকের অস্বস্তি বাড়ত । এই বাঁশিওয়ালার কাছে থাকতো আরও দুটি জিনিস ।একটি মাটি আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো বেহালা ।ছড় দিয়ে ওরা দারুন সুরে সেই বেহালা বাজাত ।দামটা একটু বেশি থাকাতে  কিনতে পারতাম না ।কিন্তু যারা কিনত ,তারা কিন্তু ওঁদের মত বাজাতেই পারতো না ।ওটা বাজানোতে একটু অন্য কৌশল ছিল । এ ছাড়া ওর কাছে মাটির তৈরী গোল মত একটি বাটিতে উপরে লাগানো বেশ কিছু কাঠি এমনভাবে লাগানো থাকতো যে দড়ি দিয়ে টানলে সেটিতে চটপট করে বেশ মজাদার শব্দ হত।সবাই খুব হাততালি দিতাম আমরা ।

এ ছাড়া বিকেলের দিকে কাঁচের বাক্সের মধ্যে তিলের সব খাওয়ার সামগ্রী নিয়ে হাজির হতো  ফেরিওয়ালা হাতে ছোট ঘন্টা বাজাতে বাজাতে ।সেই বাক্স থেকে বার করে দিতো তিলকুট ,তিলের তক্তি , তিলের নাড়ু ,কদমা ইত্যাদি ।ওগুলো খেতে খুবই সুস্বাদু ছিল । কোনো কোনো দিন বিকেলেই এসে পড়ত একটি বাক্সে ঘুরন্ত চাকতির সাহায্যে একরকম গোলাপী রঙের শনের মতো এক গুচ্ছ খাওয়ার জিনিস । মুখে দিলেই গলে যেত। এর নাম আমরা দিয়েছিলাম বুড়ির চুল । ফেরিওয়ালা বলত , গোলাপী রেউড়ি । এ ছাড়া বাঁশের ডান্ডার মধ্যে জড়ানো একরকম রং বেরঙের চটচটে খাওয়ার জিনিস । লোকটির কাছে হাজির হলেই ,সেখান থেকে খানিকটা নিয়ে সেখান থেকে নানা রকমের জিনিস যেমন পাখা, টেবিল ,চেয়ার ,নৌকা বানিয়ে দিতো ।বেশ ভালো খেতে ছিল এবং অনেকটা চিটে গুড়ের মত।



একটু সন্ধ্যে হতে না হতেই টিনের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে হাজির হত ঘুগনিওয়ালা ।হাঁক পাড়তো ‘ঘুগনি ‘।আমরা ছোটরা যেন ওর অপেক্ষায় থাকতাম ।ভিড় করে দাঁড়াতাম চারপাশে ।বাক্সটা খুললেই  ঘুগনির অপূর্ব একটা গন্ধ নাকে আসত । ঘুগনির মধ্যে নারকোলের কুচি থাকত ।শালপাতাতে ঘুগনি দিয়ে শালপাতার চামচ বানিয়ে দিত।আমরা মহানন্দে চেটেপুটে খেতাম ।ঘুগনির  বাক্সে একটি গোল পাত্রে লাল রঙের ঝোলের মধ্যে ভাসমান আলুর দম থাকত ।খেতে খুবই ইচ্ছা করত কিন্তু পয়সাতে কুলোতো না ।কিন্তু যেদিন একটু বেশি পয়সা পেতাম সেদিন ওই আলুর দম খেয়ে যেন জীবন সার্থক হয়ে যেত ।ঘুগনি,আলুর দম ছাড়াও কয়েকটি সিদ্ধ ডিম্ ও মামলেটের টুকরো থাকতো বাক্সে ।ওতে কোনোদিন হাত ছোঁয়াতে পারি নি ।তবে আজও বলতে পারি বাড়িতে ঘুগনি তৈরি করে খেয়ে অথবা রেস্টুরেন্টে ঘুগনি খেয়েও ওই টিনের বাক্সের ঘুগনীর স্বাদ ভুলতে পারি নি ।
ঘুগনিওয়ালার সাথে অনেকদিন হাজির হত হরিদাসের বুলবুল  ভাজা ।হাতে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে সে নেচে নেচে বলতে থাকত ,

হরিদাসের বুলবুল  ভাজা
খেতে  ভারি মজাই মজা
ফুরিয়ে গেলে আর পাবে না
এ খাবার মজা কোথাও পাবে না ।
তেকোনা মোড়কে সেই হরিদাসের বুলবুল ভাজা এখনকার যে কোনো দামী চানাচুরের বিকল্প হতে পারত ।

একটু রাত হলেই গরমের দিনে উদাস সুরে ডাক শোনা যেত ‘কুলফি  মা লা ই বরফ ‘। মাথায় করে হাড়িতে নিয়ে আসত এই কুলফি মালাই বরফ  ।বরফের ভিতরে তেকোনা টিনের চোঙ্গায় এই কুলফি ভরা থাকত ।আমরা সবাই গোল হয়ে ঘিরে ধরতাম তাকে ।বরফের ভিতর থেকে ওই চোঙাগুলো বার করে ভালো করে হাতের মধ্যে ঝাঁকিয়ে নিয়ে উপরের মুখ খুলে শালপাতার মধ্যে খুলে দিত ভিতরের মালাই বরফ ।এলাচের গন্ধ দেওয়া সেই কুলফি মালাইয়ের সুবাস এখনো মনে হয় মুখে লেগে আছে । আর একটি জিনিস গরমের সময় পাওয়া যেত ।সেটি হচ্ছে ফুলওয়ালার হাঁক ।এই সময়ে বেল ফুল ও জুঁই ফুলের মালা নিয়ে ওরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতো ।বাড়ির মেয়েরা ,বৌয়েরা ওদের কাছ থেকে সেই সব ফুলের মালা কিনত। টাটকা ফুলের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত।

এখানেই শেষ করছি সেকালের পুরানো কলকাতার ফেরিওয়ালাদের কাহিনী । এদের বেশির ভাগ আর বর্তমানে নেই ।অনেকের ভেক বদলে গেছে ।তবু এরা পুরানো কলকাতার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে বর্তমান ছিল তখনকার দিনে ।এদের হাঁক ডাক নিয়ে কলকাতা বিশারদ রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মহাশয়ের একটি বই পর্যন্ত আছে ।শেষ করার আগে আমার প্রিয় কবি শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি কবিতা উপহার দিতে চাই :

পুরনো ছবি  

মই- ঘাড়ে সেই লোকটাকে আর দেখি না ।
বিকেলের আলো ফুরিয়ে যাবার
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে
আমাদের এই গলিতে এসে জ্বালিয়ে দিত
গ্যাসের বাতি ।

হাঁড়ি-মাথায়  সেই লোকটাও অনেককাল নিখোঁজ ।
রোগা  এই গলিটার  সমস্ত আবর্জনা যখন
গ্যাসের সবুজ আলোয় ডুবে গিয়ে
স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ,
ঠিক তখনই সে আমাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াত ।
তারপর
সক্কলের হাতে- হাতে একটা করে শালপাতা ধরিয়ে দিয়ে
তার উপরে
টিনের মোড়ক থেকে
আলতো হাতে নামিয়ে দিত
এলাচের -গন্ধে- ভুরভুর মালাই বরফ ।

ঝাঁক-হাতে সেই লোকটাই বা গেল কোথায় ?
ছাতের উপরে মাদুর বিছিয়ে
আমরা যখন পাশের-বাড়িতে-বাজতে -থাকা
কলের গান শুনতুম :
‘ফুটেছে  এত ফুল, ফুলমালি কই ‘,
তখন
অনেক দূর  থেকে সে তার মিহি গলায়
ডাক দিয়ে যেত : বে -ল  ফুল !

তাদের কাউকেই এখন দেখি না ।

কিন্তু তারা ফিরে এলেই যে
পুরনো কলকাতার
ছবিটাকে আবার ফেরত পাওয়া যেত ,
তাও নয় ।
ফেরত পাবার জন্যে আরও -একজনকে চাই ।
শহরের এই গলিঘুঁজির  মধ্যে
হঠাৎ কবে কোনখানে সে
হারিয়ে গেছে,
কেউ সে কথা বুঝতেই পারেনি ।

১০ শ্রাবণ ,১৩৮৮

হটাৎই  ছোটবেলার  আমাদের এই বহুদিনের পুরানো পাড়ার সেই ফেরিওয়ালাদের কথা মনে পড়ে যাওয়াতেই তাদের নিয়ে আমার এই স্মৃতিচারণা । জানি না ,এটা পড়ে তোমাদের মনে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা ! আসলে দক্ষিণ কলকাতা বা পূর্ব কলকাতার  ঝাঁ চকচকে আবহাওয়ায় যারা থাকেন তারা অনেকেই এই ধরণের ফেরিওয়ালাদের কথা ভাবতেই পারবে না ।আর এটাই পুরানো কলকাতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।


                        








x

Thursday, December 22, 2016

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো র সম্পর্ক

আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী
   আমি    চিনি গো চিনি  তোমারে  ওগো বিদেশিনী.
   তুমি    থাক  সিন্ধুপারে  ওগো  বিদেশিনী//

প্রেম পর্যায়ের এই গানটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ১৮৯৫ সালের ১১ই অক্টোবর.
‘জীবনস্মৃতি’ র ‘গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ’ –তে বলেছেন, বহু বাল্যকালে একটি গান শুনিয়াছিলাম, “তোমায় বিদেশিনী সাজিয়ে কে দিলে!” সেই গানের ওই একটিমাত্র পদ মনে এমন  একটি  অপরূপ চিত্র আঁকিয়া দিয়াছিল যে, আজও ওই লাইনটা মনের মধ্যে গুঞ্জন করিয়া বেড়ায় . একদিন ওই গানের ওই পদটার মোহে ,আমিও একটি গান লিখিতে বসিয়াছিলাম. স্বরগুঞ্জনের সঙ্গে প্রথম লাইনটা লিখিয়াছিলাম, “আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী”—সঙ্গে যদি সুরটুকু না থাকিত তবে এ গানের কী ভাব দাঁড়াইত বলিতে পারি না. কিন্তু ওই সুরের মন্ত্রগুণে বিদেশিনীর এক অপরূপ মূর্তি মনে জাগিয়া উঠিল. আমার মন বলিতে লাগিল, আমাদের এই জগতের মধ্যে একটি কোন বিদেশিনী আনাগোনা করে, কোন রহস্যসিন্ধুর পরপারে ঘাটের উপরে তাহার বাড়ি, তাহাকেই শারদপ্রাতে  মাধবীরাত্রিতে ক্ষণে ক্ষণে দেখিতে পাই, হৃদয়ের মাঝখানেও মাঝে মাঝে তাহার আভাস পাওয়া গেছে, আকাশে কান পাতিয়া তাহার কন্ঠস্বর কখনো বা শুনিয়াছি. সেই বিশ্বব্রহ্মান্ডের বিশ্ব্মোহিনী বিদেশিনীর দ্বারে আমার গানের সুর আমাকে আনিয়া উপস্থিত করিল এবং আমি কহিলাম ---
   ভুবন ভ্রমিয়া শেষে
   এসেছি তোমারি দেশে
   আমি অতিথি তোমারি দ্বারে, ওগো বিদেশিনী.   
১৯২৪-এর মার্চ মাসে রবীন্দ্রনাথ রওনা হলেন চীনদেশের উদ্দেশ্যে. এটির আমন্ত্রণ পত্র পেয়েছিলেন আগেই. সেখান থেকে দ্বিতীয়বারের জন্য জাপানে গেলে সেখানেই পেলেন দক্ষিণ আমেরিকার পেরু থেকে স্বাধীনতা শতবর্ষ পালনের উত্সবের আমন্ত্রণ পত্র. ২১ জুলাই ক’টি মাসের জন্য দেশে ফিরে এলেও রবীন্দ্রনাথের মনে আমেরিকার সংগ্রামী মানুষদের দেশে যাওয়ার ইচ্ছাটি অক্ষুন্ন রইল. একসময়ে লেখা ‘যক্ষপুরী’ কে রূপ দিলেন ‘রক্তকরবী’-তে. ‘প্রবাসী’তে লেখাটি প্রকাশিত হতেই রবীন্দ্রনাথ এর ইংরাজি অনুবাদ শুরু করলেন . নাম দিলেন Red Oleanders.
১৯শে সেপ্টেম্বর  পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী,নাতনী পুপে এবং শিল্পী সুরেন কর সহ রবীন্দ্রনাথ রওনা হলেন প্যারিসের পথে. সেখানে সঙ্গী চারজন নেমে গেলে রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনার উদ্দেশ্যে উঠে পড়লেন আন্ডেস জাহাজে. এখান থেকে তাঁর সঙ্গী হলেন এলমহার্স্ট. এর আগে এক কন্যার অনুরোধে ‘ডায়ারি’ লিখতে শুরু করেছিলেন. কিন্তু এবারে ডায়েরী লেখা তেমন পছন্দ না হলেও চেষ্টা করলেন রক্তকরবীর ইংরাজি অনুবাদ Red Oleanders শেষ করবার জন্যে.

এবারে দেশ ছাড়ার আগে তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিলেন. অথচ শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হবার আগেই তিনি পেরুর ৯ই ডিসেম্বরের উত্সবে যোগদানের জন্য রওনা হয়েছিলেন. এর ফলে জাহাজেই সেই ব্যামো ফিরে এলো দ্বিগুণিত হয়ে. তাই ৬ই নভেম্বর তিনি যখন আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে নামলেন, তখন তিনি খুব অসুস্থ এবং নেমেই বিশ্রামের প্রয়োজন অনুভব করলেন. এদিকে পেরুর আমন্ত্রণপত্রটি সত্যি ছিল না. আর্জেন্টিনায় নামার আগেই সেই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল. এতে অবশ্য আর্জেন্টিনার   মানুষ রবীন্দ্রনাথের অভ্যর্থনার আয়োজনে কিছুমাত্র কম করে নি. তাই  লোকের অভিনন্দনের ধকলে এবং ডাক্তারের মুখোমুখি হয়ে কবি যখন খুবই বিপর্যস্ত, তখন দেবদূতির মতন পেয়ে গেলেন সেদেশের এক গোপন অনুরাগিণী, নাম তার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো. তিনি একাধারে সম্ভ্রান্ত-বংশীয়া,স্কুল কলেজের বিদ্যালাভ ছাড়াই রীতিমত বিদুষী , বহু ভাষাবিদ,স্বনামধন্য লেখিকা এবং সপ্রতিভ ও সুন্দরী. এই অপরিচিতা অনুরাগিনী,ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, বহুদিন ধরেই তার অদেখা কবির জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন.
বুয়েনোস আইরেসের জাহাজঘাটায় বিব্রত অবস্থায় হাস্যমুখী অনুরাগিণী ভিক্টোরিয়ার প্রথম দর্শনেই কবির মনে ত্রিশ বছর আগের পূর্বোল্লিখিত গানটি কবির মনে গুঞ্জরিত হয়ে উঠেছিল. বিশেষত ভিক্টোরিয়ার কাছে ওই গানের শেষ তিনটি কলি বলতে চেয়ে তার একান্ত সহায়তা চেয়েছিলেন. রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল এই গানের উল্লিখিত কল্পলোকের বিদেশিনী এতদিনে যেন প্রত্যক্ষ হয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়েছে.
এই গানটির ইংরাজি অনুবাদ  রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার (তাঁর অনুরক্তা ‘বিজয়া’)হাতে তুলে দেন পরে.  “আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী”  গানটির শেষ চরণে অতিথি শব্দটি বিশেষ লক্ষ্যনীয় ও তাপর্যপূর্ণ . এই গানের ‘অতিথি’ শব্দটির সাদৃশ্যে রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার ‘মিরালরিও’ আরোগ্যআবাসে ১৫ই নভেম্বর ‘অতিথি’ কবিতাটি লিখলেন, যেটি ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যেই লিখিত বুঝতে কোন সংশয় জাগে না. কবিতাটি নিম্নরূপ:
 প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী,
মাধুর্যসুধায়; কত সহজে করিলে আপনারই
দূরদেশী পথিকেরে; যেমন সহজে সন্ধ্যাকাশে
আমার অজানা তারা স্বর্গ হতে স্থির স্নিগ্ধ হাসে
আমারে করিল অভ্যর্থনা;
* * * * * * * * *
তেমনি তারার মতো মুখে মোর চাহিলে, কল্যাণী
কহিলে তেমনি স্বরে, ‘তোমারে যে জানি আমি জানি।
জানি না তো ভাষা তব, হে নারী, শুনেছি তব গীতি
প্রেমের অতিথি কবি, চিরদিন আমারই অতিথি।
রবীন্দ্রনাথের কাছে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো অপরিচিতা হলেও ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম যোগাযোগ ঘটে আঁদ্রে জিদ অনুদিত ‘গীতাঞ্জলি’ বইটির সূত্রে ১৯১৪ সালে. সে সময়ে তাঁর জীবনে বড় এক সংকট চলছে. তিনি বলছেন, “অল্প বয়সে আমাদের সবারই জীবনে এমন সব সংকটকাল আসে,যার থেকে আর বেরুতে পারব বলে মনে হয় না. ঠিক তেমনি এক সময়ে ‘গীতাঞ্জলি’ এলো আমার হাতে, এ বই পড়ে ওঠা আমার পক্ষে দ্বিগুণ মূল্যবান হলো . এই সময়ে প্রথম প্রণয়ের ফলে উদ্ভূত বিবাহ বিচ্ছেদের সমস্যাতে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি. সেই সংকটের মুহুর্তে ‘গীতাঞ্জলি’ হাতে এল এবং এই বইকে নির্ভর করেই একটা সান্ত্বনা ও আশ্রয়ের জগত খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি. জেনেছিলেন,
‘তোমার তরবারি করবে সকল বাঁধন ক্ষয়,
আমি ছাড়ব  সকল ভয়.’ 
যে কবির কাব্য তাঁর মানস  সংকটে দ্বিগুণিত আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল তাঁকে দেখবার পরম আকাঙ্খা নিয়ে বসেছিলেন ভিক্টোরিয়া. গীতাঞ্জলির কবিতা তিনি বারবার আবৃত্তি করতেন, যার মূল বাংলাটি নিম্নরূপ:
যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু
এবার এ জীবনে,
তবে তোমায় আমি পাই নি যেন
সে কথা রয় মনে.
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে.
ভিক্টোরিয়া বলেন, এই পংক্তিগুলি কন্ঠে  নিয়ে, আমি স্পষ্ট করে বলতে পারব না, আমি কার প্রতীক্ষায় বসেছিলাম-রবীন্দ্রনাথের না রবীন্দ্রনাথের ভগবানের. কবির প্রতি অনুরাগিণী এই ভক্তের প্রতীক্ষাই পূর্ণ হল রবীন্দ্রনাথের আগমনে.
সেই সংকটের দশ বছর বাদে যখন রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখার সুযোগ এসেছে ভিক্টোরিয়ার  কাছে তখন তিনি অনেকটা স্থির ও পরিণত. তখন তাঁর বয়স ৩৪ . প্রথম বিবাহের সেই অসহ্য দিনগুলি থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন. জীবনে এসেছে নতুন ভালবাসার মানুষ. সেইসঙ্গে নারীমুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ শুরু করেছেন. ততদিনে রবীন্দ্রনাথের ‘সাধনা’, ‘চিত্রা’, ‘ঘরে বাইরে’ পড়ে ফেলেছেন. এমন পরিস্থিতিতে তাঁর বিশেষ আগ্রহের মানুষ সে দেশে এলেন.

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রথম সাক্ষাতকার

৭ই নভেম্বর ভিক্টোরিয়া বান্ধবী আডেলিয়াকে  নিয়ে প্লাজা হোটেলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান| এই সময়ে নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকাতে এবং নারী আন্দোলনের পুরোধায় থাকায় সেদেশের এবং অন্যান্য দেশের অনেক মনিষীদের সাথে তার পরিচয় হয়ে যায়| এরকম জীবনের পটভূমিকায় ভিক্টোরিয়ার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতকারের কথা তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক:
“শ্রীযুক্ত এলমহার্স্টের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তার পরে আমরা পৌঁছলাম রবীন্দ্রনাথের ঘরে| সেখানে আমাদের একলা রেখে চলে গেলেন সেক্রেটারি| ভয়ে ভয়ে ভাবছি, কী লাভ এই দেখাশোনার? একটাও কথা বলছি না| ভীরু মানুষেরা সমস্ত জীবন ভরে সবচেয়ে বেশি করে যা চায় ,ভাগ্য তাকে প্রায় আয়ত্তের মধ্যে এনে দিলে ভয় পেয়ে যায় তারা|—
আমার এত আকুলতার যিনি কারণ, এই অস্বস্তিজনক প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন তিনি| প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এলেন; নীরব ,সুদূর, তুলনাহীন,বিনীত.—তেষট্টি বছর বয়স, প্রায় আমার বাবার বয়সী, অথচ কপালে একটিও রেখা নেই,যেন কোনো দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তাঁর সোনালী শরীরের স্নিগ্ধতা| সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে ওঠা সাদাচুলের রাশি| শ্মশ্রুমন্ডলের নীচের দিকটা আড়াল , আর তারই ফলে উপরের অংশ হয়ে উঠেছে আরও দীপ্যমান|  
 -- মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তাঁর সমগ্র মুখাবয়বের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তাঁর কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব| শুভ্র কেশদাম আর স্নিগ্ধ শ্মশ্রু, এর বৈপরীত্যে জ্বলে উঠেছে তাঁর চোখের সজীবতা| দীর্ঘ দেহ, শোভন চলন. তাঁর প্রকাশময় দুটি অতুলনীয় শুদ্ধ হাতের সুধীর সুষমা যেন অবাক করে দেয়,মনে হয় যেন এদের নিজেদেরই কোনো ভাষা আছে| অনেকদিন পরে যখন মৃণালিনী সারাভাইয়ের নৃত্য দেখেছি, তখন জেনেছি যে সত্যি ভারতীয় নৃত্যে হাতের মুদ্রা কথা বলে তার নিজের ভাষায়|
 আমার হৃদয়ের এত কাছাকাছি এই মানুষটির সত্যি আবির্ভাবের সামনে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এলো| কয়েক মিনিটের মধ্যে উঠে পড়লাম আমি, বিদায় নিলাম| এইটুকু দেখা হবার স্বপ্ন  কত যে  দেখেছি তা জানত আমার বন্ধুটি| সে তাই থতমত হয়ে গেল আমার এই ব্যবহারে,”
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষের দু’বছর আগে এই স্মৃতিচারণা যখন ভিক্টোরিয়া করছেন, তখন সমাজে তিনি রীতিমত প্রতিষ্ঠিত এবং একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব| সে সময়ে এতদূরে বসে এই আবেগবহুল ভাষাতে তার ‘নির্বাক’ থাকার ইতিহাসটি তিনি যে রচনা করলেন, তার প্রকৃত সত্যতা কতদূর তা জানতে ইচ্ছে করে| ভিক্টোরিয়া যে সবটাই নিজের স্মৃতি থেকে বলছেন না, তার প্রমাণ রবীন্দ্রনাথকে দেওয়া ৮ই নভেম্বরে তাঁর প্রথম চিঠিতে| তিনি লিখছেন, “ I felt so dreadfully shy and awkward ,when i was seating in your room, that I  said things I did not want to say and forgot all about the things I have been waiting so eagerly to tell you|” তাহলে সেদিন ভিক্টোরিয়া আর রবীন্দ্রনাথের কথা হয়েছিল| রবীন্দ্রনাথ যে সাক্ষাতকারীদের সাথে সে দেশের সংস্কৃতি ও অবস্থা সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছিলেন
‘Nacion’ পত্রিকায়, তার উল্লেখ আছে|  
প্রতিমা দেবীর স্মৃতিসূত্রে জানা যায়; ভিক্টোরিয়া ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতেন| ভিক্টোরিয়াও প্রথম লেখা চিঠিতে জানিয়েছেনযে, সেদিন সব কথাই তার এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল| এখানে কৌতুহল জাগে, প্রথম সাক্ষাতের দিনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নামটি জিজ্ঞাসা করার মতো সৌজন্যটুকুও কি দেখান নি?
এরই সঙ্গে মনে পড়বে বুয়েনাস আইরেসে ভিক্টোরিয়ার রবীন্দ্রনাথকে লেখা ৮ই নভেম্বরের প্রথম চিঠির বাকি অংশটুকু| আগের দিন ভালো করে কথা বলতে না পেরে ভিক্টোরিয়া এই চিঠির সঙ্গে একগুচ্ছ ফুল পাঠিয়ে লিখেছিলেন, “ It will unburden me to send you flowers, because you know so  well that they are not merely ‘color and scent’ but ‘beauty and joy’ untramelled by necessity.”
 এই চিঠির উত্তরে রবীন্দ্রনাথ যা লিখলেন ,তাও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য| তিনি ভিক্টোরিয়ার এই উপহারকে বললেন, ‘Precious gift’.   “ It will be difficult for you to fully realise what an immense burden of loneliness I carry about me,the burden that has specially been imposed upon my life by my sudden and extraordinary fame. – My market price has risen high and my personal value has been obscured. This value I seek to realise with an aching desire which constantly pursues me.This can be had only from a woman’s love and i habe been hoping for a longtime that i do deserve it.
I know that i have come to that period of my life when in my travel across a desert I need my supply of water more than ever before but i neither have the means  nor strength to carry it and therefore can only think my good fortune when it is offered to me and then take my leave” (কেতকীর বই)
এল্মহার্স্টের কাছে প্রথম দিন হোটেলে গিয়ে শুনেছিলেন যে হৃদযন্ত্রের দুর্বলতার জন্যে ডাক্তারেরা জানিয়েছেন যে আপাতত আন্দেস পেরিয়ে লিমা যাবার পরিকল্পনা স্থগিত রাখাই ভালো| পেরুর প্রেসিডেন্টকে এখনই তার করে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে তাঁর অতিথি এখন পেরু পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন না| তার পরিবর্তে ডাক্তারেরা রবীন্দ্রনাথকে কোনো গ্রামাঞ্চলে গিয়ে বিশ্রাম নেবার পরামর্শ দিয়েছেন|
এসব শুনে হঠাই  ভিক্টোরিয়া প্রস্তাব দিলেন এল্মহার্স্টের কাছে, ওঁরা দুজন এসে সান ইসিদ্রোতে থাকুন না কেন| রবীন্দ্রনাথের ব্যবহারের জন্য একটি পুরো বাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে| কথা তো দিলেন, কিন্তু এই কথা রাখবার জন্যে কীভাবে কী ব্যবস্থা করা যাবে সেসব তখনও ভেবে ওঠেন নি| সান ইসিদ্রোতে ভিক্টোরিয়ার নিজের কোনো বাড়িই ছিল না, তাঁর মা-বাবার কাছে কিছুদিনের জন্য তাঁদের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যাত হলেন| কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আরোগ্যের জন্যে একটা পছন্দসই শান্তির বাড়ির জন্যে ভিক্টোরিয়া স্বর্গ মর্ত্য তোলপাড় করতে প্রস্তুত ছিলেন| তখন আরেক আত্মীয়জনের কথা মনে হতেই সেখানে দৌড়ে গেলেন, সেটি ওনার বাড়ি থেকে এক মাইলের মধ্যে| বাড়ির নাম ‘মিরালরিও’| এই বাড়িটি মাত্র এক সপ্তাহের  জন্যে নিজস্ব হীরের টায়রা বিক্রি করে ব্যবস্থা করে ফেললেন| পরে  এখানে  বেশ কিছুদিনের জন্যে রবীন্দ্রনাথকে রাখতে হয়েছিল ভিক্টোরিয়াকে|

রবীন্দ্রনাথের মিরালরিও-র বাগানবাড়িতে আগমন  

‘মিরালরিও’ শব্দটির অর্থ হল ‘স্রোতস্বিনীকে দেখা’| এই বাগানঘেরা বাড়িটির প্রাকৃতিক শোভা বর্ণনাতীত| একটি সুউচ্চ মালভূমির উপরে অবস্থিত স্বপ্নপুরীর মত বাড়িটি| শাদা ঝকঝক করছে নতুন বাড়ি| এর তিনতলার অলিন্দ থেকে আর দোতলার হলঘর থেকে দেখা যায় নদী| বাড়িটির সামনেই ডানদিকে বিরাট একটি মেপল গাছ| দেখা যায় ওক গাছ, সবুজ ঘাসের গালিচা, মাঝে মাঝে ফুলের মালঞ্চ এবং বহুবিচিত্র  পুষ্পের বর্ণচ্ছটায় যেন সমস্ত প্রাঙ্গনটিকে মোহময় করে তুলেছে| প্রাঙ্গনের সীমারেখার চারিদিকে দাঁড়িয়ে আছে বয়োবৃদ্ধ ওক গাছ আর দীর্ঘ পাইন বন| সমস্ত বাড়িটিকে ঘিরে বিরাজ করছে এক অখন্ড শান্তি| গৃহ থেকে উত্তরদিকে কয়েক পা অগ্রসর হলেই দেখতে পাওয়া যায় ওপরের তটরেখাহীন বিশাল প্লাতা নদী| প্লাতা শব্দটির অর্থ হল রূপা| সান ইসিদ্রোর এই পুষ্পশোভিত বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ এসে পৌঁছলেন ১২ই নভেম্বর| সেই প্রথম দেখাশোনার পর আর ভিক্টোরিয়ার সাথে দেখা হয় নি রবীন্দ্রনাথের|
  দুপুরে কয়েকজন গণ্যমান্য লোক খাবারের জন্যে ডেকে নিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথকে  এখানের প্রথামত| এই আসরে ওকাম্পো যান নি|
বিকেল তিনটেয় ভিক্টোরিয়া গেলেন ওকে ফিরিয়ে আনতে মিরালরিওতে প্রথমবারের জন্য| সমুদ্রবাতাসের প্রকান্ড ঝাপটায় কালাও স্ট্রিট তখন বিপর্যস্ত| গাছের নতুন পাতা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ,পথের ধার থেকে উড়িয়ে আনছে শুকনো ধুলো আর ছেঁড়া কাগজের রাশি| আকাশ কোনখানে হলুদ, কোথাও-বা সীসার মতো ধূসর| পথচলতি মানুষের পক্ষে এ যেন এক সতর্কবাণী: ঘরে ফেরো, ঘরে ফেরো| সান ইসিদ্রোর দিকে চলেছি আমরা, ধুলোর ঝড়ে ভরে গেছে গাড়ি| কিন্তু যখন এসে পৌঁছলাম সান ইসিদ্রোতে, সমস্ত দৃশ্য যেন পালটে গেল বাড়িটির সামনে, সব কেমন ঠান্ডা ছিমছাম|  মোমের গন্ধ,টাটকা ফুলের গন্ধ| বাইরের গাছে বাতাসের ঝাপাঝাপি, তারই ফলে আরও ঘন হয়ে উঠছে ভিতরের নীরবতা| যেন শঙ্খের মধ্যে শুনছে কেউ সমুদ্রধ্বনি| সদর দরজা বন্ধ হল| ঘরের শ্বেত নির্জনতায় আমাদের ঘিরে ধরল গোলাপ আর সোনালী হথর্নগুচ্ছ| এইভাবেই মিরালরিও তে প্রথম আগমন ঘটল কবির|
সেই বিকেলে আকাশ ক্রমেই আরো হলুদ হয়ে আসছিল ,আর বিশাল ঘন কালো মেঘ| এমন ভয়ংকর গুরু মেঘ, অথচ এমন তীব্র ভাস্বর কখনো এমন দেখা যায় নি| আকাশ কোথাও সীসার মতো ধূসর, কোথাও মুক্তর মতো, কোথাও বা গন্ধকের মতো হলুদ, আর এতেই আরো তীব্র  হয়ে উঠেছে নদীতট আর তরুশ্রেনীর সবুজ আভা| ঊর্ধ- আকাশে যা ঘটছিল ,জলের মধ্যে তাই ফলিয়ে তুলছিল নদী| কবি ঘরের বারান্দা থেকে  দেখছিলেন এই আকাশ,এই নদী, বসন্তের সাজে ভরা এই প্রান্তর| বালুচরের উইলো গাছগুলি খেলা করছিল ছোট ছোট হাজার নম্র পাতায়|
ঘরে ঢুকতেই কবিকে নিয়ে আসা হল অলিন্দে, বলা হল: নদীটি দেখতেই হবে| সমস্ত প্রকৃতি যেন আমাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে দৃশ্যটাকে করে তুলল  পরম রমণীয়| আলোর পাড়ে বোনা প্রবল মেঘপুঞ্জের অন্তরালে কে যেন এক প্রতিফলক সাজিয়ে ধরেছে আকাশে|
এই সুন্দর প্রাকৃতিক পরিস্থিতি এবং সুন্দরী বিদুষী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর উপস্থিতি কবিকে প্রথম দিনেই উদ্বুদ্ধ করে সেই বিখ্যাত কবিতা ‘বিদেশী ফুল’ লিখতে|
পাঁচটি স্তবকে সজ্জিত ‘বিদেশী ফুল’ কবিতার প্রথম স্তবকেই আছে-
“হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম
   ‘কী তোমার নাম’
হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তবে
   নামেতে কী হবে|
   আর কিছু নয়|
 হাসিতে তোমার পরিচয়|”
কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকে সে কোথায় থাকে জিজ্ঞাসা করা হলে বলে, ‘ জানি না, জানি নাকো|’ তৃতীয় স্তবকে জানতে চাওয়া হল তার ভাষার কথা| এবারে ফুল নির্বাক| চতুর্থ স্তবকে কবিই প্রশ্নদাতা ও উত্তরদাতা| পঞ্চম স্তরে কবি জানান,
‘দুই দিন পরে
চলে যাব দেশান্তরে,
তখন দূরের স্বপ্নের  টানে আমি হব তব চেনা;-
মোরে ভুলিবে না|’
এই কবিতাটির সাথে রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরে লিখিত ‘লেখন’ নামে দু চার পংক্তির কবিতার বইতে  অন্য একটি কবিতার সাথে বিশেষ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়|
কবিতাটিতে লেখা হয়েছিল :
বিদেশে অচেনা ফুল পথিক কবিরে ডেকে বলে-
“যে দেশ আমার ,কবি, সেই দেশ তোমারো কি নহে|” 
কবিতাটির ইংরাজি অনুবাদে কবি লিখেছিলেন,
An unknown flower in a strange land
Speaks to the poet:
“Are we not of the same soil, my lover.’
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ‘অন্যদেশে’র এক কন্যা প্রায় অনুরূপ ইঙ্গিতবহ কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন একসময় রবীন্দ্রনাথকে,
“Could you forget your Indian sky, even if you had no
 chance of seeing it again? You are to me what the sky
 is to you” ( কেতকী কুশারীর In your blossoming flower garden)| অন্য দেশটি হল দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা| আর কন্যাটি হল আমাদের পূর্বোল্লিখিত আর্জেন্টিনা-দুহিতা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো|
মিরালরিও বাড়িটির সামনে ছিল একটি পূর্ণ মেপল গাছ| আর গোলাপ আর হথর্ন-য়ে ভরা একটি বাগান| তার সামনেই প্লাতা নদী| ভিক্টোরিয়ার এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথকে প্রথমদিনের আনন্দের স্মৃতিতে বাড়িটির সামনে থেকে প্রকৃতিকে দেখার আনন্দ ছিল মিশে|
বিদেশী ফুল কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ১২ই নভেম্বর তারিখে| গোলাপ রবীন্দ্রনাথের কাছে বিদেশী ফুলের মুগ্ধতা আনবে বলে মনে হয় না| রইলো বাকি সাদা ধবধবে হথর্ন ফুল| এই ফুলই কি রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘বিদেশী ফুল’ কবিতার প্রেরণা হতে পারে? এই বিদেশী ফুল বলিতে তিনি ভিক্টোরিয়া না সেই বাগানের সৌন্দর্যকে বুঝিয়েছিলেন সেটা পাঠকের উপরে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে|
কবিতাটি ১৯৮০ সালের জানুয়ারী-জুন সংখ্যা ‘Sur’-এ ‘A Vijaya’ লিখে ছাপা হয়েছে| অথচ যখন এটি লেখা হয়, তখন ভিক্টোরিয়ার ‘বিজয়া’ নামকরণ কোনমতেই সম্ভব নয়|
‘মিরালরিও’ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের থাকার কথা ছিল মাত্র আট দিন| আটদিন পরে সেখানকার পাট চুকানোর জন্যে তিনি ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন| কিন্তু ভিক্টোরিয়া যেতে দিলে তো? পেরুর অসত্য আমন্ত্রণের কথা প্রথমে রবীন্দ্রনাথকে জানানো হয় নি| অবশ্য ইতিমধ্যে পেরুর কাছ থেকে নতুন আমন্ত্রণ পত্র এসে গেলেও তকালীন  শাসকদের স্বৈরতন্ত্রী মনোভাব ও কার্যকলাপের ব্যাপারে ভিক্টোরিয়া যথেষ্ট অবহিত থাকার ফলে তিনি রবীন্দ্রনাথকে পেরুতে যেতে দিলেন না| উপরন্তু সান ইসিদ্রোর এই বাড়িতে আরও কিছুদিন থাকার জন্যে আবদার, অনুরোধ উপরোধ অবশেষে ভালবাসার অভিমান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ওখানে আরও দুমাস ওখানে থাকতে রাজি করালেন| ততদিনে সান ইসিদ্রোর এই নির্জনতা, এখানের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা এবং সর্বদা অনুরাগিণী ভিক্টোরিয়া এবং এল্মহার্স্টের সান্নিধ্য রবীন্দ্রনাথকে দেশ ছাড়ার সময়ের বহু সমস্যার থেকে মনকে মুক্ত করতে পেরেছিল|
কোনো একটি কবিতাশিল্পের আদ্যন্ত একটি মানুষের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া সবসময় ঠিক নাও হতে পারে| অনেকের মতে, শিল্পটি গড়বার উপাদান কবির সমকাল বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক উপলব্ধি টুকরো টুকরো ভাবে থাকতে পারে| যেমন ১৫ নভেম্বরে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ কবিতাটির আড়ালে যে ভিক্টোরিয়াই আছেন ,তা নিয়ে সমালোচক মহলে কোনো দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই| কবিতার শেষ দুই পংক্তিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
জানি না তো ভাষা তব, হে নারী শুনেছি তব গীতি,
প্রেমের অতিথি কবি, চিরদিন আমারি অতিথি|
লেখামাত্র রবীন্দ্রনাথ কবিতাটির ইংরাজি অনুবাদ করে ভিক্টোরিয়াকে পাঠিয়েছিলেন|
 এর উত্তরে ১৬ নভেম্বর ভিক্টোরিয়া রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার সীমাহীন ভালবাসার কথা জানিয়ে লিখেছেন,  “ All I received from you has made mo so rich in love that more I spend, the more I have to give. And all I give comes from yourself.” (কেতকীর বই)  এক্ষেত্রে নিশ্চয় আমরা রবীন্দ্রনাথের সেবাযত্ন ও আশ্রয় স্থানটির জন্য ভিক্টোরিয়ার অর্থব্যয়ের কথা ভাববো না| বরঞ্চ সঙ্গতভাবে কেতকীর মনে পড়েছে এর অন্তর্নিহিত ভাবনার  কথা, যা ১৯২৮-এ ‘বিদায়’ কবিতাটিতে (শেষের কবিতায় ব্যবহৃত ও মহুয়ায় সংকলিত) রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেছিলেন এইভাবে ,
“তোমায় যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান;
 গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়|”
এইসূত্রে অন্য একটি প্রসঙ্গ খেয়াল করবার মত. ‘মিরালরিও’ বাড়িটি থেকে ভিক্টোরিয়ার নিজের বাড়িটি খুব একটা দূরে ছিল না| তাঁরই সাহায্যকারীরা রবীন্দ্রনাথের সেবা করেছেন, এমন কি বাসন-কোসনও সব তাঁর বাড়ি থেকে রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে চলে গেছে| তাই রোজ রাত্রে ভিক্টোরিয়া কবির সঙ্গে ‘মিরালরিও’ বাড়িতে খেয়ে আসতেন| আর এইটুকু দূরত্ব থেকে দেখা হওয়ার পরও তাঁদের মধ্যে চিঠির আদান প্রদান চলতো| এটি আমাদের ‘শেষের কবিতা’র ‘দীপক’ ‘মানসী’র ভাবনা স্মরণ করিয়ে দেয়| যেদিন ডাক দিতে ইচ্ছে করবে সে-দিন এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে ,আর ও বাড়ি থেকে এ-বাড়িতে চিঠি আসে| মাঝে থাকবে শুধু একটি সেতুর দূরত্ব|
এরপরেই ভিক্টোরিয়ার অনুভব, “অল্পে অল্পে বুঝে নিলাম মানুষ রবীন্দ্রনাথকে, ধরতে পারলাম ওঁর চালচলন| অল্পে অল্পে রবীন্দ্রনাথও বস করে নিলেন একাধারে বন্য আর-নিরীহ এই নবীন প্রাণীটিকে| রাত্রিবেলায় যে-কোনো গৃহপালিতের মতো তাঁর দরজার বাইরে মেঝের টালির ওপর যে শুয়ে থাকতাম না, তার একমাত্র কারণ এই যে ব্যাপারটা খুব ভালো দেখায় না|”
  যে রাতে এ বাড়িতে বসে ভিক্টোরিয়া রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নি:সীম ভালোলাগার কথা লিখছেন, সেই ১৬ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘অন্তর্হিতা’ কবিতাটি. লিখলেন,
“প্রদীপ যখন নিবেছিল
আঁধার যখন রাতি
দুয়ার যখন বন্ধ ছিল
ছিল না কেউ সাথী|
মনে হলো অন্ধকারে
কে এসেছে বাহির-দ্বারে
মনে হয় শুনি যেন
পায়ের ধ্বনি কার
রাতের হাওয়ায় বাজল বুঝি
কনক ঝংকার|”
তন্দ্রার মধ্যেও একই অনুভব ঘটায় একবার কবি ভাবেন দরজাটা খুলে দিই| পরমুহুর্তে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হন| নিদ্রাভঙ্গের পরও তাঁর মনে হয়,ছিল কেউ সেখানে,যে ‘বাহির সবারে রাতের অতিথি সে|’ ১৭ নভেম্বর লিখলেন ‘আশঙ্কা|’ এতে আশঙ্কা করলেন,(কারণ তাঁরও অপরিসীম নি:সঙ্গতার কথা আমরা তাঁর চিঠিতে জেনেছি)
“ পাছে আমার আপন ব্যথা মিটাইতে
 ব্যথা জাগাই  তোমার চিতে
-- পাছে আমার একলা প্রাণের ক্ষুব্ধ ডাকে
 রাত্রে তোমায় জাগিয়ে রাখে|”
১৬ নভেমবরের চিঠিতে ভিক্টোরিয়াও কবিকে লিখেছিলেন, “This happiness is so great that it keeps me awake in the night and dreaming in the day,”
কিন্তু নি:সঙ্গ মানুষটি তখন কি এমন কিছু ‘আশঙ্কা’ করেছিলেন ,যার জন্যে তাঁকে কবিতাটির শেষে লিখতে হলো,
“ হবি হবে তোমার প্রেমের হোমাগ্নিতে
  এমন কী মোর আছে দিতে|
  তাই তো আমি বলি তোমায় নতশিরে  তোমায় দেখার স্মৃতি নিয়ে
  একলা আমি যাব ফিরে|”
২২  নভেম্বার ‘বিপাশা’ কবিতায় হালকাভাবে জানালেন (প্রসঙ্গত জানাই রবীন্দ্রনাথের রসিকতা-প্রবণ মনটির পরিচয় বিজয়ার যে অজানা ছিল না, তা তাঁর স্মৃতিকথা ধৃত আছে)
“মায়ামৃগী ,নাই বা তুমি পড়লে প্রেমের ফাঁদে.
ফাগুন রাতে চরা মেঘে নাই হরিলে ছাঁদে|”
আর যদি কবির কথা জিজ্ঞাসা করা হয় তো তিনি বলবেন যে তাঁর চাওয়ার জন্যই চাওয়া , পাওয়ার ইচ্ছা মোটেই নেই| বললেন,
“চাই-না তোমায় ধরতে আমি
মোর বাসনায় ঢেকে
আকাশ থেকে গান গেয়ে নাও
নয় খাঁচাটার থেকে|”
আন্দেস জাহাজ থেকে বুয়েনস আইরেসে নেমে আসা আর ফিরতি-পথে জুলিও চেজারে উঠে বসা: অন্তর্বর্তী এই সময়ের মধ্যে লিখেছেন ছাব্বিশটি কবিতা| সান ইসিদ্রোতে ভিক্টোরিয়ার আতিথ্য নেবার আগেই লেখা হয়ে গেছে তার তিনটি| বাকী রচনাগুলির মধ্যে –দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া –বিদেশী এই নারীর অনুসঙ্গ জড়িয়ে আছে অনেকটাই, এ অনুমান অসঙ্গত নয়| জীবনের প্রতি, বসন্তের প্রতি, প্রেমিক স্মৃতির প্রতি তাঁর নবীন আগ্রহ একেবারে নিষ্কারণ ছিল না| এই কবিতাগুলির মধ্যে বিশেষ করে, ‘বিদেশীফুল’, ‘অতিথি’, ‘অন্তর্হিতা’, ‘আশঙ্কা’, ‘শেষ বসন্ত’, ‘বিপাশা’, ‘চাবি’, ‘প্রভাতী’, ‘মধু’, ‘অদেখা’, ‘চঞ্চল’ , ‘প্রবাহিনী’, ‘না পাওয়া’, ‘বনস্পতি’ এই চোদ্দটি কবিতায় ভিক্টোরিয়া সম্পর্কে কবির অনুভূতি সরাসরি ভাষা পেয়েছে| 
১২ই নভেম্বর সান ইসিদ্রোতে পৌঁছবার দিন,  ‘বিদেশী ফুল’ কবিতায় লিখেছিলেন তিনি ‘দুই দিন পরে চলে যাব দেশান্তরে’, আর ফিরবার পথে জুলিও চেজারে জাহাজের প্রথম কবিতা ‘মিলন’-এর মধ্যে বলতে হলো ,
চলেছি আজ একা ভেসে
কোথা যে কত দূর দেশে
************
যেখানে ধরণীর সীমার শেষে
স্বর্গ আসিয়াছে নামি
সেখানে একদিন মিলেছি এসে
কেবল তুমি আর আমি|
এটা ঠিক যে অন্তর্গত এই কবিতাগুলির মধ্যে অনুভব করা যায় এক নবীন প্রেমের উদ্দীপন, ভাষার অপরিচয়গত নিরন্তর বেদনা, অথবা স্তবকবন্ধের নূতন পরিপাট্য|
এই কবিতাগুচ্ছ নিয়ে তিনি এক কাব্য রচনা করলেন যার নামকরণ করলেন বিকেলের এক সঙ্গীত রাগিণী ‘পূরবী’ নামে|  আর এই ‘পূরবী’কে উত্সর্গ করলেন তাঁর একান্ত অনুরাগিণী ভালবাসার পাত্রী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে| ততদিনে তিনি ভিক্টোরিয়ার নতুন নামকরণ করেছেন ‘বিজয়া’ বলে আর সেই বিজয়াকেই এই ‘পূরবী’ উত্সর্গ করা হল| আলোচকদের মতে পূরবীর পথিক অংশে সংকলিত কবিতাগুলি বিশেষত ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছিল|
১৯২৫ সালের ২৯শে অক্টোবর ভিক্টোরিয়াকে লেখা একটি চিঠিতে কলিকাতা থেকে পূরবীর এই কবিতা সংগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন, ‘বাংলায় লেখা একটি বই তোমাকে পাঠাচ্ছি,নিজের হাতে দিতে পারলেই ভালো লাগত! এ-বই তোমাকেই উত্সর্গ করা, যদিও তুমি জানতে পাবে না কী আছে এর মধ্যে| সান ইসিদ্রোতে যখন ছিলাম, এর অনেক কবিতাই তখনকার লেখা| ভরসা করি, এর লেখক তোমার পাশে যতদিন থাকতে পেরেছে, তার চেয়ে বেশিদিন থাকতে পাবে এ-বই|’ আরও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনথ,   ‘ ‘My readers who will understand these poems will never know who my Vijaya is with whom they are associated.’
পূর্ববী গ্রন্থখানি  হাতে পাওয়ার পরে ভিক্টোরিয়া ১৯২৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথকে লেখেন, ‘ But it is quiet impossible for me to go on looking at the book and not being able to know what is inside those pages. What can I do?—The book you sent me is my greatest treasure, but i am mad to know what is inside it.’
শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনের তত্কালীন অধ্যক্ষ শ্রী ক্ষিতীশ রায়(১৯১১-৯৫) রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে পূরবী থেকে কয়েকটি কবিতার অনুবাদ করেন, নাম দেন Poems of Puravi(1960)এবং পাঠিয়ে দেন ভিক্টোরিয়াকে| এতে ছিল ‘পূরবী’র পূর্ণতা, বিদেশী ফুল,অন্তর্হিতা ,আশঙ্কা, শেষ বসন্ত, বদল কবিতাগুলি| এতে হয়ত ভিক্টোরিয়ার আক্ষেপ কিছুটা দূর হয়েছিল.
অনেক পরবর্তী একটি চিঠিতে(১০ই জুলাই১৯৪০) রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে ‘পূরবী’ নামটি বোঝাবার চেষ্টা করেছেন এইভাবে: ‘It is named Purabi(the east in feminine gender). এর একমাস আগে (৮ই জুন) ভিক্টোরিয়া জানতে চেয়েছিলেন: ‘Now tell me, what is the title of the poetry book you dedicated to me?’
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘শ্রীমতী ওকাম্পো আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বল তো পূরবী কথার মানে কী? আমার পক্ষে এক কথায় এর উত্তর দেওয়া অসম্ভব মনে হল| বললাম, পূরবী কথাটার কয়েকটা মানে আছে| ব্যুপত্তিগত অর্থে পূর্ব বা পূরব শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ পূরবী| আর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের অন্যতম রাগিণীর নাম পূরবী| তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এই রাগিণীটির তাপর্য কী| বললাম , সন্ধ্যাকালীন রাগিণী|  সন্ধ্যাকালটি আমাদের মনে একটা বিদায়ের সুর সূচিত করে| পূরবীর সুরে  সমাপ্তির এই  বিদায় ব্যথাটিই মানুষের মনে অনুরণিত হয়ে ওঠে| শ্রীমতী ওকাম্পো বললেন, বুঝলাম ,কিন্তু তবে এই রাগিণীকে পূরবী না বলে পশ্চিমী বললেই তো তার সার্থকতা বজায় থাকত|’ 
আজেন্টিনার দিন ফুরোলে ৫ই জানুয়ারি জুলিও চেজারে জাহাজের করে দেশের দিকে রওনা হলেন কবি. জাহাজ থেকেই সেই দিন ভিক্টোরিয়াকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন, সেটি মনে হয় তাঁদের দুজনের নারী-স্বাধীনতা কেন্দ্রিক আলোচনা নিয়ে. ততদিনে রবীন্দ্রনাথের ‘Personality’(যেটিতে রয়েছে ‘woman’ প্রবন্ধটি) প্রতীচ্যে সাড়া জাগিয়েছে. সান ইসিদ্রোতে থাকবার সময়ে একাধিকবার এই প্রসঙ্গে পরস্পরের আলোচনা হয়েছে.
শুধু নারী মুক্তির ব্যাপারেই নয়, অধিকার ও ভালবাসার ক্ষেত্রেও ভিক্টোরিয়া যে কতটা ব্যক্তিত্বময়ী ছিলেন ,তার প্রমাণ মিলল রবীন্দ্রনাথের ফেরার পথে. ভিক্টোরিয়ার প্রতিপত্তির জোরেই জাহাজের দরজা কেটে একটি আরাম কেদারা রবীন্দ্রনাথের জন্য জাহাজে ঢোকানো হল. সেইসঙ্গে দুটি বিলাসবহুল কেবিন তিনি রবীন্দ্রনাথের জন্য ভাড়া  করলেন. একটিতে তিনি লিখবেন সকালে আর একটিতে তিনি শোবেন রাত্রে.
এই হলো সেই আরাম কেদারা যেটি দিয়েই আমি আমার এই কথিকাটি শুরু করব ভেবেছিলাম. পরে অন্য কারণে এই কথিকাটি বর্তমান ধরণে লিখতে শুরু করি. এই আরাম কেদারাটি রবীন্দ্রনাথ ‘মিরালরিও’র বাড়িতে খুব ব্যবহার করতেন এবং এটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল. এই আরাম কেদারাটি বিশেষ ভাবে কৌতুহলের উদ্রেক করেছে আমার মনে বারে বারে.
এই আরাম কেদারাটির বিশদ গঠন প্রণালী এবং ব্যবহৃত বস্তু সম্বন্ধে কোন তথ্য পাই নি. ওটা কি আর্জেন্টিনার কোনো শিল্পীদল বানিয়েছিল না ওটি আর্জেন্টিনার বাইরে থেকে এসেছিল সেসম্বন্ধে কৌতুহল থাকলেও সেগুলো সম্বন্ধে  কোনো বিশেষ তথ্য পাই নি.
ভিক্টোরিয়ার সেবার, ভালোবাসার এই আন্তরিক ধরণটি  সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একাধিকবার একাধিক জনের কাছে স্নেহভরে বলেছেন.
কবির অনুরাগিণী রানী চন্দ তাঁর ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’ বইতেলিখেছেন  রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভিক্টোরিয়ার   অনুভবের কথা. বলেছেন,’ ‘ তোমার চিঠিতে বোধ হচ্ছে ভিক্টোরিয়ার উল্লেখ করেছ. তিনি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন কিন্তু সে সব ব্যয় হয়ে গেছে. অনেক খরচ করে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফিরে আসবার উপায় করে দিয়েছিলেন-সেই উপলক্ষ্যে প্রচুর অনাবশ্যক ব্যয় করেছেন. তিনি আমার জাহাজ যাত্রার জন্যে যে একটি আরাম কেদারা দিয়েছিলেন সেইটেই কেবল তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সাক্ষ্য-স্বরূপে রয়েছে.
আরও বলেছেন, সেই স্প্যানিশ মেয়ে বিজয়া, প্রথমেই আমায় বললে যে, আমি তোমার জন্যে কি করতে পারি. আমি যখন ওখান থেকে এলুম তখন সে করলে কি-খুব দামী ইতালিয়ান জাহাজে দু-দুটো ক্যাবিন ঠিক করলে আমার জন্যে. আমি বললুম, এর প্রয়োজন কি. কিন্তু সে কিছুতেই মানলে না, বললে, একটাতে তুমি দিনের বেলা কাজ করবে আর-একটা ক্যাবিনে  রাত্রে শোবে. এর কারণ আর কিছুই নয়-আমার জন্যে কিছু করতে চায়, এই ছিল তাঁর আকাঙ্খা. একটা সোফা  সেট কিছুতেই ঢোকে না ক্যাবিনের দরজা দিয়ে . কাপ্তেনকে ব’লে দরজা কাটিয়ে বড় করে তবে, সেই সোফাকে ক্যাবিনে ঢোকালে. বসে বিশ্রাম করব তাতে.’  
তাই দেখেছি যে, বিদেশী মেয়েরা তাদের ভালবাসার প্রতিষ্ঠা করে কাজের মধ্যে দিয়ে, ত্যাগের মধ্যে দিয়ে. আর-একরকম ভালবাসা আছে- আমাদের দেশে যেটা মারে, চাপা দিয়ে দেয়.
বিজয়া আমার ‘চাওয়া’র কাছে ওর সমস্ত তুচ্ছ জ্ঞান করত. বিজয়া খুব শিক্ষিত মেয়ে ছিল. মাঝে মাঝে আসতো আমার কাছে নানা বিষয়ে আলাপের  জন্যে. প্রায়ই আমার বলত,কেন তুমি স্প্যানিশ ভাষা জানলে না, আমি যে সব-কথা ইংরাজিতে তোমায় বোঝাতে পারি নে . আমারও দু:খ হত খুব, কেন  স্প্যানিশ ভাষা শিখিনি কোনদিন.
৬ই জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথকে ভিক্টোরিয়া লিখলেন তিনি ‘Red Oleander’ অনুবাদে হাত দিয়েছেন. ছোট্ট চিঠি. রবীন্দ্রনাথের অভাব ভীষণ বোধ করছেন এ-কথাও অকপটে স্বীকার করলেন. ফেরবার পথে রবীন্দ্রনাথের শরীর সুস্থ ছিল না, তবুও তার মধ্যে কয়েকটি মর্মস্পর্শী কবিতা লিখলেন.
৯ই জানুয়ারি জুলিও চেজারে জাহাজেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘মিলন’ কবিতাটি .
 শুরু করলেন এই ভাবে :
জীবন-মরণের স্রোতের ধারা
      যেখানে এসে গেছে থামি
সেখানে মিলেছিনু সময়হারা
            একদা তুমি আর আমি।
      চলেছি আজ একা ভেসে
      কোথা যে কত দূর দেশে,
      তরণী দুলিতেছে ঝড়ে
      এখন কেন মনে পড়ে
যেখানে ধরণীর সীমার শেষে
            স্বর্গ আসিয়াছে নামি
সেখানে একদিন মিলেছি এসে
            কেবল তুমি আর আমি।
আর শেষ করলেন এইভাবে:
রজনী কী খেলা যে প্রভাত-সনে
            খেলিছে পরাজয়কামী
বুঝিনু যবে দোঁহে পরান-পণে
            খেলিনু তুমি আর আমি।
১০ তারিখে তিনি লিখলেন ‘অন্ধকার’ কবিতাটি. তাতে এক স্তবকে লিখলেন :
নিস্তব্ধের সে আহ্বানে বাহিয়া জীবনযাত্রা মম
           সিন্ধুগামী তরঙ্গিণীসম
এতকাল চলেছিনু তোমারি সুদূর অভিসারে
বঙ্কিম জটিল পথে সুখে দুঃখে বন্ধুর সংসারে
           অনির্দেশ অলক্ষ্যের পানে।
কভু পথতরুচ্ছায়ে খেলাঘর করেছি রচনা,
শেষ না হইতে খেলা চলিয়া এসেছি অন্যমনা
                অশেষের টানে।
এই কবিতার ‘পথতরুচ্ছায়ে’ খেলাঘর রচনা করেছেন তিনি. শব্দটি উল্লেখযোগ্য. তরুর ছায়া ছিল-পথিমধ্যে. কিন্তু খেলা শেষ না হতেই তিনি চলেছেন অশেষের টানে , এবং তিনি ক্লান্ত. ইটালিতে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন.
১৭ই জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ‘বদল’ কবিতাটি. সেখানে নারীর ছিল’হাসির কুসুম’ ও  ‘হাসি কৌতুক’. সে ফিরে যেতে যেতে বলেছিল, ‘ মোর হল জয়’. তখন ভিক্টোরিয়া ‘বিজয়া’তে রূপান্তরিত হয়েছেন. এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ যখন গানে রূপ দিচ্ছেন, তার পংক্তি সাজাচ্ছেন এইভাবে,
‘ তার হাতে ছিল হাসির ফুলের হার কত রঙে রঙ করা.’
তারপরে বম্বে হয়ে কলকাতায় এসে তিনি ভিক্টোরিয়াকে তারবার্তায় জানালেন,
‘Arrived. Love from Rabindra’
  দেশে ফিরবার পর শত কাজের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ  তাঁর ‘বিজয়া’কে চিঠি লেখা অব্যাহত রেখেছেন| ভিক্টোরিয়াও তখন অতীব ব্যস্ত মানুষ| তবু কখনও ছোটো, কখনও বড় চিঠিতে  কবির অদর্শনে তাঁর ব্যথিত চিত্তের কথা জানিয়েছেন| জানিয়েছেন অনেক কাজের কথাও| একসময় চিঠির প্রবাহ ভিক্টোরিয়ার দিক থেকে ক্ষীণ হয়ে এলে রবীন্দ্রনাথ এখানে অস্থিরতা বোধ করেছেন| বারে বারে লিখেছেন বিজয়া’ যেন একটিবার ভারতে আসেন| কিন্তু ভিক্টোরিয়া কিছুতেই সময় করে উঠতে পারেন নি| অবশ্য দুজনের প্রকৃত সম্পর্ক কারও  কাছেই অস্পষ্ট ছিল না| এর আগে ১৩ তারিখে জাহাজ থেকেই ভিক্টোরিয়াকে যে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাতে একটি জায়গায় লিখেছেন, “ I have lost most of my friends because they asked me for themselves, and when I said I was not free to offer away myself-they thought I was proud. I have deeply suffered from this over and over again-and therefore I always feel nervous wherever a new gift of friendship comes in my way.But I accept my destiny and if you also have the courage fully to accept it we shall ever remain friends.”
 ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় এবং শেষবারের মতো রবীন্দ্রনাথের দেখা হয় ১৯৩০-এ প্যারিসের ‘কাপ মার্টিন’-এ| রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনী করবেন ভেবেই বেশ কিছু ছবি নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন| সেখান থেকে তিনি যাবেন  অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতায় ‘The Religion of Man’ বলতে| তবে তার আগে ছবির প্রদর্শনীর ব্যাপারে উদ্যোগ নিতেই দেখা গেল কাজটা সহজ নয়| ওই সময় ভিক্টোরিয়া প্যারিসেই অন্য একটি জায়গায় ছিলেন| রবীন্দ্রনাথ তারবার্তায় ভিক্টোরিয়াকে তাঁর ইচ্ছের কথা জানালেন| কেতকী  জানাচ্ছেন, প্রথমে ভিক্টোরিয়া এ-নিয়ে হাল্কা মন্তব্য করেছিলেন| কিন্তু পরে অতি দ্রুত প্রদর্শনীর সমস্ত ব্যবস্থাই তিনি তাঁর বন্ধুমহলের সহায়তায় করে ফেলতে পারলেন| বিখ্যাত  ‘তেয়াতল পিগাল’ গ্যালারিটি পাওয়া গেল, যথাসময়ে কাগজে কাগজে প্রদর্শনী বিষয়ে প্রচার শুরু হল| অল্প কয়েকদিন পরেই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের কাছাকাছি ২রা মে থেকে ১০ই মে পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে  এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল| উল্লেখযোগ্য যে, ভিক্টোরিয়া ছবির গুরুত্ব প্রায় না বুঝে একরকম বাধ্য হয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করলেও ক্রমশ যখন এই ছবির খ্যাতি ছড়াতে লাগল, তখন তিনি একটি ক্যাটালগের উপর লিখে রাখলেন, ‘ This exhibition is my work.’ ক্যাটালগটি বুয়েনাস আইরেসে ওকাম্পো আর্কাইভস-এ সংরক্ষিত আছে|
প্রদর্শনীর পরে রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে তাঁর সঙ্গে অক্সফোর্ডে যেতে অনুরোধ জানালেন. কিন্তু ভিক্টোরিয়ার কাছে পত্রিকা প্রকাশের কাজ, নারী সংগঠনের কাজ, সর্বোপরি উত্তর আমেরিকাতে এক বিশেষ বন্ধুর টানই প্রাধান্য পেল| ইংল্যান্ডে যাওয়ার পথে প্যারিসের gare du nord রেলওয়ে স্টেশনে তাই তাঁদের শেষ দেখা| রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত মর্মাহত হলেন ভিক্টোরিয়ার এই প্রস্থানে|
এই চিত্র প্রদর্শনী সম্বন্ধে রানী চন্দকে বলেছেন, ‘ দ্বিতীয়বার যখন বিদেশে যাই তখন ভিক্টোরিয়াও ইউরোপে ছিল| সঙ্গে ছিল সেবারে আমার আঁকা ছবিগুলো| সে বললে, আমি এগুলো এদেশের বড় বড় ক্রিটিকদের দেখাব| সে দেদার টাকা খরচা করে ছবি দেখাবার ব্যবস্থা করলে; একজিবিশন করলে, তাও কত খরচ করে|’
  
প্রতিমা দেবীকে লেখা ১৯৩০ সালের এপ্রিলের চিঠিতে জানাচ্ছেন, ‘ ভিক্টোরিয়া যদি না থাকত তাহলে ছবি ভালোই হোক মন্দই হোক কারও চোখে পড়ত না| একদিন রথী ভেবেছিল ঘর পেলেই ছবির প্রদর্শনী আপনি ঘটে –অত্যন্ত ভুল| এর কত কাঠখড় আছে যে সে আমাদের পক্ষে অসাধ্য- আন্দ্রে জিদের পক্ষেও| খরচ কম হয় নি- তিন চারশো পাউন্ড হবে| ভিক্টোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্ছে| এখানকার সমস্ত বড় বড় গুণী-জ্ঞানীদের ও জানে – ডাক দিলেই তারা আসে| ভিক্টোরিয়া ছবি বিক্রির কথা বলেছিল- বোধহয় এই উপলক্ষে নিজে কিনে নেওয়ার ইচ্ছা| আমি বলেছি এখন বেচবার কথা বন্ধ থাক|—ভিক্টরিয়া স্থির করেছে এখানকার একজন বড় ডাক্তারকে দিয়ে আমার পরীক্ষা করাবেন| – ভিক্টোরিয়ার আমেরিকা যাওয়ার তাড়া| কেবল আমার এই ছবির জন্যেই আছে..’
ভিক্টোরিয়া বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে যে ক’টি বাংলা শব্দ শিখিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি হল ‘ভালোবাসা’| রবীন্দ্রনাথ যখন ভিক্টোরিয়াকে চিঠি লিখতেন কখনও রোমান হরফে, কখনও বাংলায় লিখতেন ‘ভালোবাসা’ শব্দটি| ভিক্টোরিয়াও রোমান হরফে কথাটি অনেক সময় লিখতেন, তবে বেশি লিখতেন ‘Love’ কথাটি|
ভিক্টোরিয়ার উপহারের আরাম কেদারা অনেক ঘাট পেরিয়ে জাহাজে করে কলকাতায় পৌঁছলে সেটিকে প্রথমে নিয়ে আসা হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে| পরে সেটিকে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের উত্তরায়নে নিয়ে যান|  পরে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরে এই আরাম কেদারাটিকে রবীন্দ্রভবনের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে| ভবিষ্যতের শান্তিনিকেতনের দর্শনার্থীদের  পরের বারে ওখানে গেলে এই মূল্যবান সংগ্রহটি নিশ্চয় দেখে আসার অনুরোধ করি |
 প্রতিমা দেবীর স্মৃতিকথা সূত্রে জানা গেছে, রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ বহু বছৰ এই আরাম কেদারায় বসতেন না| কোনো বিশেষ কারণে নয়, হয়ত এমনিই| তাঁর কথায়, আমাদের কাছেই পড়ে ছিল| কিন্তু শেষবারের অসুস্থতার সময় দেখলুম তিনি এই আরামকেদারায় বা ‘চৌকি’ তে অনেকক্ষণ বসে থাকতে পছন্দ করছেন| সমস্ত দিনই প্রায় ঘুম বা বিশ্রামান্তে তিনি ওই আসনের উপর বসে থাকতেন| রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দিনরাত্রির বেশির ভাগ সময় এই চৌকিটার উপর বসে কাটাই!’
রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে এই চেয়ারটির আরও কিছু উল্লেখ আছে| তার কয়েকটি এইরকম:
‘I shall completely have to surrender myself to your easy chair which has followed me from shore to shore,’ ২৭ ফেব্রুয়ারি,১৯২৫
‘I am writing this, reclining on your armchair,which,I am afraid,will keep me within its enclosure much longer than what I calculated,’ ৩১ মার্চ ১৯২৫   
প্রতিমা দেবী আরও বলেছেন, ‘ ভিক্টোরিয়া ইংরেজি খুব ভাঙা-ভাঙা বলতেন, ফরাসী ভাষাতেই তাঁর দক্ষতা ছিল বেশী| তাঁকে সুন্দরী বলা চলে না , কিন্তু বুদ্ধির প্রখরতা তাঁর মুখে একটি সৌন্দর্যের দীপ্তি এনে দিত| তাঁর বড় বড় কালো পল্লব-ঢাকা গাড় নীল  চোখে একটি স্বপ্নময় আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল|
 তার দীর্ঘ দেহ গৌরবময় আভিজাত্যের পরিচয় দিত| তিনি যখন নতজানু হয়ে বাবামশায়ের পায়ের কাছে বসতেন, মনে হত ক্রাইস্টের পুরানো কোনো ছবির পদতলে তাঁর হিব্রু ভক্ত মহিলার নিবেদন-মূর্তি| ইনি দক্ষিণ আমেরিকার স্বনামধন্য প্রভাবপূর্ণ  মহিলা|   
রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের একেবারে  শেষবেলাতে ‘শেষলেখা’ বলে যে কাব্য গ্রন্থটি লেখেন তার ৪ এবং ৫ নম্বর দুটি কবিতাতেই এই আরাম কেদারা বা চৌকির এবং ইহার উপহারদাত্রীর  বিশেষ উল্লেখ আছে| তিনি এই আরাম কেদারাকে কবিতায় চৌকি বলেই  সম্বোধন করতেন কখনও সখনও|
 ১৯৪১ সালের ৬ই এপ্রিল দুপুরে শান্তিনিকেতনের উদয়নে এই কেদারায় বসেই তাঁর বিদেশিনী ভক্তের কথা মনে পড়তেই রচনা করলেন ‘শেষলেখা’ কাব্যের ৫ নম্বর কবিতা  সেই পুরাতন স্মৃতিভরা মন নিয়ে:
আরো একবার যদি পারি
খুঁজে দেব সে আসনখানি
যার কোলে রয়েছে বিছানো
বিদেশের আদরের বাণী ।

অতীতের পালানো স্বপন
আবার করিবে সেথা ভিড় ,
অস্ফুট গুঞ্জনস্বরে
আরবার রচি দিবে নীড় ।

সুখস্মৃতি ডেকে ডেকে এনে
জাগরণ করিবে মধুর ,
যে বাঁশি নীরব হয়ে গেছে
ফিরায়ে আনিবে তার সুর ।

বাতায়নে রবে বাহু মেলি
বসন্তের সৌরভের পথে ,
মহানিঃশব্দের পদধ্বনি
শোনা যাবে নিশীথজগতে ।

বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে
যে প্রেয়সী পেতেছে আসন
চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া
কানে কানে তাহারি ভাষণ ।

ভাষা যার জানা ছিল নাকো ,
আঁখি যার কয়েছিল কথা ,
জাগায়ে রাখিবে চিরদিন
সকরুণ তাহারি বারতা ।
কিন্তু সে বাঁশি কি ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন? হ্যা, এখানেই তাঁর সেই বিশ্বাসের পুনরজ্জীবন এই কবিতায় প্রস্ফুটিত হয়েছে| তৃতীয় ও পঞ্চম স্তবকের বক্তব্যে সব অবিশ্বাস আর অভিযোগের অবসান হয়েছে. চেতনার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছে কবি বলেছেন, বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে যে প্রেয়সী পেতেছে আসন,'সে চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া/কানে কানে তাহারি ভাষণ'| শেষপর্যন্ত বিজয়ার ভালোবাসা কবিচিত্তে প্রশান্তি এনে দিয়েছে| 

 তবে ঠিক এই কবিতার আগেই তিনি খুব ব্যথিত চিত্তে লিখেছেন তাঁর প্রিয় সেই আরাম কেদারা বা চৌকির কথা (২৩শে মার্চ,১৯৪১  বিকেলে শান্তিনিকেতনের উদয়নে, শেষলেখা-র ৪ নম্বর কবিতা )| কবিতাটি খুবই মর্মস্পর্শী এবং মনটাকে কিরকম উদাস করে দেয়.
রৌদ্রতাপ ঝাঁঝাঁ করে
জনহীন বেলা দুপহরে ।
শূন্য চৌকির পানে চাহি ,
সেথায় সান্ত্বনালেশ নাহি ।
বুক ভরা তার
হতাশের ভাষা যেন করে হাহাকার ।
শূন্যতার বাণী ওঠে করুণায় ভরা ,
মর্ম তার নাহি যায় ধরা ।
কুকুর মনিবহারা যেমন করুণ চোখে চায়
অবুঝ মনের ব্যথা করে হায় হায় ;
কী হল যে , কেন হল , কিছু নাহি বোঝে
দিনরাত ব্যর্থ চোখে চারি দিকে খোঁজে ।
চৌকির ভাষা যেন আরো বেশি করুণ কাতর ,
শূন্যতার মূক ব্যথা ব্যাপ্ত করে প্রিয়হীন ঘর ।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর চার মাস আগে রথীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ‘যে বাঁশি নীরব’-এর ইংরাজি অনুবাদ পেয়ে গেছেন| রবীন্দ্রনাথের চূড়ান্ত অসুস্থতার খবর পেয়ে ঠাকুরবাড়ির পরিবারের কাছে তারবার্তা করেছেন| মৃত্যুর খবর পেয়ে ব্যথিত হয়েছেন| ১৯৪২-এর মার্চ মাসে তিনি রথীন্দ্রনাথকে লিখছেন, “ How i regret not to have gone to India while he was still alive! – I loved him so much.—I lectured and wrote about him after his death. Did you receive ‘Sur’?”
    এরপর রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিজড়িত অনুভবের কথা তিনি লিখেছেন তাঁর ‘সান ইসিদ্রোর শিখরে রবীন্দ্রনাথ’- বই এ. নিজের দশ খণ্ডের আত্মজীবনীর একটা বড় অংশ জুড়ে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথকে| এতে যেমন সৃষ্টির, কর্মের ও মননের আলোচনা করেছেন, তেমনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তাঁকে এত কাছের থেকে দেখার ও পাওয়ার জন্য| সান ইসিদ্রোর যে বাড়িটিতে রবীন্দ্রনাথের প্রায় দুই মাস কেটেছিল, সেই বাড়িটি একসময় তিনি কিনে নিয়েছিলেন| আমৃত্যু তিনি সেটিতেই বাস করেছেন এবং ইচ্ছাপত্রে জানিয়ে গেছেন যে বাড়িটি যেন ‘রবীন্দ্র-স্মৃতি’ হিসাবে রাখা হয়| সেখানকার একটি পথের নামকরণও তিনি করিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের নামে. রাস্তাটির নাম রাখা হয়েছে ‘আদেনিদা তাগোরে’|
ডাকবিভাগ থেকে বেরিয়েছে তাঁর নামে বিশেষ স্ট্যাম্প. শতবর্ষে অনুষ্ঠিত ৭ই মের জনসভায় ভাষণ দিলেন ভিক্টোরিয়া; দুদিন পরে রবীন্দ্রবিষয়ক এক আলোচনাবৃত্তেরও এক অপরিহার্য কথক হয়ে রইলেন তিনি| স্পেনীয় ভাষায় ডাকঘরের অভিনয় হলো ৩১শে মে তাঁর নিজস্ব অবধানে| একটি রেকর্ডে ভিক্টোরিয়া পড়লেন জিদ-অনুদিত ‘গীতাঞ্জলি’র কয়েকটি কবিতা|

আর, এই তথ্যপুঞ্জের চারপাশে, আমরা যেন ঘিরে রাখি ভিক্টোরিয়ার নিজের এই নিভৃত  উচ্চারণগুলি,কবিতার মতো, কবির কাছে একটির পর  একটি চিঠিতে  লেখা তাঁর এইসব গুঞ্জন:
It is my turn now to be homesick; I am homesick for you since you went away, and I cannot find rest. 
True, my love hurts me sometimes--- but that is only a sign that is not yet good enough for you.
Why did you go away so soon?—Why are you always in such a hurry? Why don’t you think a little about your health when it is wise to think about it? Dear Gurudev, I beg your pardon, but I am inclined to scold you hard.
The mist of homesickness is in me too & has been in me since you left San Isidro, 15 years ago( How very long it seems, how unreally long ago)! Those days in ‘Miralrio’ are some of the happiest I have ever known. The more my heart gives to you, the more it has to give.  


রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর আটত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি| ১৯৭৯ সালের ২৭ জানুয়ারী উননব্বই বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন| মনে পড়ে রবীন্দ্র-স্মৃতিতে লেখা তাঁর ক’টি কথা, লিখছেন,
“ আমার এই স্মৃতির দলিলকে রবীন্দ্রনাথ হয়তো নাম দিতেন ‘উপলব্ধির উচ্চারণ’| একটি অশ্রুবিন্দুকে অথবা একটি হাস্যরেখাকে কবিতায় রূপ দেবার কোনো যোগ্যতা যদি আমার থাকতো, তাহলে হয়তো কবিতা হিসেবেই লিখতাম এটা| কিন্তু সে-যোগ্যতা নেই আমার| চোখের জল চোখেই রয়ে যায়| ঠোঁটেই মিলিয়ে যায় ঠোঁটের হাসি|”

তথ্যঋণ: ১) ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ- শংখ ঘোষ
      ২) In Your Blossoming Flower Garden- Ketaki Kushaari Dyson
      ৩) উপলব্ধির উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-কবিতা চন্দ
      ৪) কবিমানসী(প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড)- জগদীশ ভট্টাচার্য
              ৫) গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ – সমীর সেনগুপ্ত