Sunday, September 14, 2014

পূণ্যভূমি দক্ষিণ পাসাডেনার বিবেকানন্দ হাউস -দ্বিতীয় পর্ব

ভূমিকা 

স্বামী বিবেকানন্দের দক্ষিণ পাসাডেনার ৩০৯ নম্বর মন্টেরী রোডে অবস্থিত মীড ভগিনীদের বাসভবনে আগমনের ঘটনা এবং কালক্রমে সেই বাসভবনের  পুণ্য স্মৃতি হিসাবে বিবেকানন্দ হাউস নামে পরিচিত হবার বিশদ বিবরণ আগের পর্বে আলোচিত হয়েছে। এই পর্বে এই বাসভবনে অবস্থানকালীন স্বামীজীর সমস্ত কিছু কার্যকলাপ ,তাঁর খাওয়া দাওয়া , পোশাক- আশাক, সবাইয়ের সাথে বাড়ির একজন লোকেদের মত চাল চলনের কথা বিশদ ভাবে আলোচনা করার প্রয়াস করব।  এই সমস্ত থেকে স্বামীজীর সম্বন্ধে পাঠক কুলের একটি অন্যরূপ ধারণা প্রকাশ পেতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।  

    মন্টেরী  রোডের রাস্তার বিপরীত থেকে বিবেকানন্দ হাউসের দৃশ্য



স্বামীজী যখন মীড ভগিনীদের বাড়িতে আগমন করলেন সেই সময়ে ওই বাসভবনে মীড পরিবারের অনেক সদস্য থাকতেন। এরা  হলেন পরিবারের কর্তা মি: জেস মীড ,তাঁর তিন মেয়ে ,তাঁর দুই নাতি-নাতনি -মিসেস হ্যান্সব্রো -র চার বছরের  মেয়ে ডরোথি আর মিসেস ওয়াইকফের সতের বছরের ছেলে রাল্ফ ; আর ছিল বাড়ির দেখাশোনা করার লোক মিস ফেয়ারব্যাংকস।  ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, এতগুলো লোক এই ছোট্ট বাড়িতে কীভাবে বসবাস করত।  কিন্তু এর সঙ্গে সমাগত অতিথি অভ্যাগতদের নিয়েও তাঁরা বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যেই বাস করতে পারতেন বলে মনে হয়।  
 স্বামীজী যখন এই বাড়িতে থাকতেন,তখন তিন বোন (এবং কিছু দিন মিস ম্যাকলাউডও ) ঘুমাতেন সামনের দুটি ঘরের মধ্যে বড় ঘরটিতে -(মিসেস হ্যান্সব্রো  -র ভাষাতে 'হাসপাতালের রোগীদের মতো। ') স্বামীজীকে  ব্যবহারের জন্য একটি ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল- তা পূর্বেই বলা হয়েছে।  বৃদ্ধ মি: মীড (তখন তাঁর বয়স ৮৪ বত্সর ) নিচের তলায় শুতেন, রাল্ফ থাকত সামনের ছোট ঘরটিতে। আর মিস ফেয়ার ব্যাংকস এবং ডরথী ঘুমাতেন গির্জার চূড়ার  ন্যায় ছোট চিলেকোঠাতে।  মিসেস কোহেন  মনে রেখেছিলেন   যে,সেই ছোট চিলেকোঠাতে  উঠতে হত স্বামীজীর ঘর এবং স্নানের ঘরের মধ্যিখানে অবস্থিত সরু একটা  সিঁড়ি  বেয়ে।  এভাবেই স্বামীজী জনবহুল এ বাড়িতে একান্তভাবেই  নিজের মতো করে থাকতে পারতেন।  এই বন্ধুত্বভাবাপূর্ণ খোলামেলা অবসরময়  পরিবেশে স্বামীজী ইচ্ছামতো বসবাস করতে পারতেন -  ভদ্রতা জ্ঞাপক গৃহস্থালির কোনও আনুষ্ঠানিক চালচলন তাঁকে বিব্রত করত না।  মিসেস হ্যান্সব্রো বলেছেন -" যদিও স্বামীজী বাইরে যাবার সময় বা কোন অপরিচিত  ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাঁর পোশাক -পরিচ্ছদ সম্বন্ধে খুবই  সচেতন ছিলেন, বাড়িতে কিন্তু তিনি যেমন-তেমনভাবেই চলাফেরা করতেন। এক রবিবার সকালবেলা তিনি বলে উঠলেন ,'বাড়িতে আমি পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে এতটা  সচেতন থাকব কেন ?-আমি তো আর বিয়ে করতে চাইছি না!'  আর একদিন যখন আমার বোনপো  রাল্ফ স্বামীজীর জুতো পালিশ করছিল, তখন স্বামীজী  তাকে বললেন,' জান ,রাল্ফ  ! এই অদ্ভূত মেয়েলি ব্যাপারটা আমার কাছে যাচ্ছেতাই বলে মনে হয়  !' পাশ্চাত্য দেশে বিভিন্ন সময়ে   এবং স্থানে রকমারি সব  'পোশাক' পরে যাবার যে একটা বাধ্যতামূলক ব্যাপার আছে, তাকে স্বামীজী একটা লোক-দেখানো ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিতেন।" 

   প্রতিদিন সকাল প্রায় ৭ টা নাগাদ স্বামীজী সাদা-কালো রং -এর স্নান ঘরের হেরিং  মাছের কাঁটার মতো দেখতে সেলাইয়ের ডিজাইন দেওয়া খসখসে পশমি  বস্ত্রের পোশাক ,কোমরে দড়িবাঁধা - পরেই নিচে নেমে আসতেন।  স্নান করার পর এলোমেলো  ভিজে চুলেই থাকতেন-যেমনটি মিসেস  ব্লজেটের  বাড়িতেও থাকতেন।  এ সময় তোলা  তাঁর একটা  ফটোগ্রাফেও তাঁর এলোমেলো লম্বা চুল দেখতে পাওয়া যায়। 
  
তাঁর চুল যে লম্বা থাকত ,তা অসাবধানতাবশত  নয়-বরং অন্যের খুশির আবদার  রাখতেই তিনি এরূপ চুল রাখতেন। মিসেস হ্যান্সব্রো তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন," তাঁর চুলগুলি খুবই সুন্দরভাবে ঢেউখেলানো ছিল।  বাস্তবিকই এগুলো এতই  সুন্দর ছিল এবং তাঁর চেহারার সঙ্গে এতই মানান সই ছিল যে , আমরাই তাঁকে তাঁর চুল  ছাঁটতে দিতে চাইতাম না।"  তিনি আরও বলেন,"স্বামীজী তাতে কোনো  আপত্তি করতেন না।  তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আপনভোলা মানুষ।"

  ওপরতলা থেকে নেমে আসা এবং প্রাতরাশ আরম্ভ হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে স্বামীজী কিছু সময়ের জন্য বাড়ির  পেছনের নির্জন বাগানে একাকী পায়চারি করতেন  অথবা কখনও কখনও একই রকমের নির্জন রাস্তার উপর দিয়ে বেড়িয়ে  আসতেন।  কখনো কখনো গান গাইতেন বা মন্ত্র পাঠ করতেন - কখনো  একেবারে নীরব এবং আত্মসমাহিত হয়ে থাকতেন।  প্রাতরাশ সাত্টাতেই  আরম্ভ হতো ,কারণ রাল্ফের স্কুল স্কুল আরম্ভ হত সাড়ে আটটাতে এবং সবচেয়ে ছোট বোন্ হেলেন ওই সময় লস এঞ্জেলসে তাঁর বীমা কোম্পানির কাজে  যোগদান করতে যেত।  স্বামীজী  বেশ  হালকা এবং ভালো আমেরিকান খাবারই খেতেন।  তাঁর খাবারের মধ্যে মুখ্যত ছিল ফল, দুটি ডিম (তিনি ডিমের পোচ -ই পছন্দ করতেন),দুই টুকরো টোস্ট এবং চিনি ও ক্রিম  দিয়ে দুকাপ কফি।  একদিন মিসেস হ্যান্সব্রো  তাঁকে তৃতীয় এককাপ কফি খাবার  উপরোধ করতে লাগলেন। পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত স্বামীজী বললেন -"বেশ ,দাও।  মেয়েমানুষের স্বভাবই হচ্ছে পুরুষ কে প্রলুব্ধ করা।" কিন্তু তিনি খাওয়া-দাওয়া,কফি-পান  ও পাইপে তামাক খাওয়ার ব্যাপারেও বেশ সংযত-ই 
 থাকতেন।  
     
    যদিও 'বোনঝি হেলেন ' এবং রাল্ফ বাধ্য হয়েই তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ  সেরে চলে যেত, মিসেস হ্যান্সব্রো,মিসেস ওয়াইকফ এবং স্বামীজী কিন্তু ধীরেসুস্থে প্রাতরাশ সারতেন।  তাঁরা  কখনও অত তাড়াহুড়ো করতেন না।  পরবর্তী কালে কোন  কোন কদাচিত দুর্লভ দিনে স্বামীজীর যদি সকালবেলা  ক্লাস না  থাকত, তাহলে তিনি আবার বাগানে গিয়ে পায়চারি করতেন অথবা পড়ার ঘরে বইগুলোয়  চোখ বোলাতেন।  মিসেস হ্যান্সব্রো তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন -" কখনও  কখনো তিনি বাড়ির সামনের মাঠে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করতেন।  ডরোথী র অনেকগুলো বন্ধুবান্ধবী ছিল -তারা সবাই এসে হাজির হতো এবং তিনি সবাইয়ের  সাথে হাত ধরে 'রিঙ্গা -রিঙ্গা '-ঘোরার খেলা বা অন্য রকমের খেলার আনন্দ উপভোগ করতেন  -তাঁর ছোট ছোট সঙ্গীরা খেলায় যেমনটি আনন্দ উপভোগ  করত -তিনিও ঠিক তেমনি আনন্দ পেতেন।  কিন্তু আবার তিনি শিশুদের চালচলন  লক্ষও করতেও ভালোবাসতেন  এবং তিনি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার  ব্যাপারেও বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। 

   মিসেস হ্যান্সব্রো  তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন : " তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে   কথা বলতে ভালোবাসতেন  এবং  তাদের কাজকর্ম  সম্পর্কর নানা প্রশ্নও করতেন:কেন তারা এ খেলাটা  বা ও খেলাটা করতে ভালবাসে এরকম নানা ধরনের প্রশ্ন।  তিনি শিশুদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সমস্যাদি সম্পর্কেও বিশেষ আগ্রহী ছিলেন এবং সময়- সময় তিনি এ বিষয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করতেন।  তিনি মোটেও শাস্তিদান  পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না।  তিনি বলেছেন যে এ পদ্ধতিতে কোনও  উপকারই পান নি।  তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলতেন-'আমি কখনো এমন ব্যবহার করব না ,যাতে শিশুরা ভয় পায়।' কখনও কখনও স্বামীজী পিছনের বাগানে  একটি চালার নিচে শিশুদের সঙ্গে বসে তাদের ছবির বইগুলি দেখতেন।  "তিনি বিশেষভাবে 'এলিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড ' এবং 'এলিস থ্রু দি  লুকিং গ্লাস' -বই দুটি পড়ে বেশ মজা পেতেন।  তিনি বলতেন যে বই দুটিতে মানবমনের ক্রিয়াকলাপের  চিত্রটি যথার্থভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং  ক্যারল-এর একটি বিশেষ  অন্তর্দৃষ্টি আছে এবং সেটি অতি অসাধারণ -যার ফলে তিনি এই বই দুখানি লিখতে পেরেছিলেন। বাস্তবিকই স্বামীজী মনে করতেন যে 'এলিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ড' হচ্ছে এই শতাব্দীর(উনবিংশ শতাব্দী) মধ্যে লেখা শিশুসাহিত্যের  মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।"   

   রাল্ফ স্বামীজীকে খুব ভালবাসত এবং যে কোন সময় ,যে কোন ভাবেই  স্বামীজীর সেবা নিজেই  চেষ্টা করত। সে স্বামীজীর জুতো  পালিশ  করে দিত- ওপরতলা থেকে স্বামীজীর  স্বামীজীর ধুমপানের জিনিস নামিয়ে এনে দিত এবং স্বামীজীর ইচ্ছেমত  আরও অনেক ছোটখাট কাজকর্ম করে দিত।  সময়-সময় তাঁরা দুজনে  গল্প গুজবও করতেন।  একবার স্বামীজী রাল্ফকে  জিজ্ঞাসা করলেন ,' তুমি কি তোমার নিজের চোখ দেখতে পাও?' উত্তরে রাল্ফ বলল  যে সে আয়নাতে  না হলে তা দেখতে পায় না।  তখন স্বামীজী তাকে বললেন,"ভগবানও  হচ্ছেন ঠিক সেই রকম।  তিনি তোমার চোখের মতোই তোমার অতি কাছে আছে।  তিনি তোমার অতি আপনজন।  তাহলেও তুমি তাঁকে  দেখতে পাচ্ছ না। " 

   স্বামীজী প্রায় দিনই ধীরে সুস্থে বাগানে বেড়াতে পারতেন বা ডরোথি ও তার বন্ধুবান্ধবদের  সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারতেন।  তবে প্রায় দিনই তিনি বেলা দশটার সময় নিকটবর্তী পাসাডেনা  শহরে ক্লাস নিতেন। যেদিন ক্লাস থাকত ,সেদিন তিনি নটা সাড়ে নটা নাগাদ মিসেস হ্যান্স ব্রো কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে  পরতেন।  তিনি তাঁর ঢিলেঢালা  কালো কোটটি ও কালো টুপিটি পরতেন  ,আর সুটকেসে করে নিয়ে যেতেন তাঁর গেরুয়া পোশাক ও পাগড়ি -ক্লাসের আগে তা পরে নিতেন।  যে সেক্সপিয়ার ক্লাবে স্বামীজী অধিকাংশ ক্লাসগুলি নিয়েছিলেন  ,সেখান পৌঁছানো বেশ সহজ ছিল।  বাড়ি থেকে ক-পা বাড়ালেই তিনি এবং হ্যান্সব্রো  বিদ্যুত চালিত ট্রেনে চড়ে পাসাডেনা পৌঁছে যেতেন এবং সেখান থেকে অল্প  একটু দূরত্বে ফেয়ার ওক এভিনিউতে অবস্থিত  সোজা ক্লাবঘরে চলে যেতেন।   

      অন্যান্য সময় কিন্তু স্বামীজী শুধু ভ্রমণের আনন্দের জন্যই ভ্রমণ করতেন।  তিনি বেশ সুস্থ বোধ করছিলেন- না হলেও আগের চেয়ে অনেকটা ভালই।  জানুয়ারী  মাসের ১৭ তারিখে তিনি মিসেস বুলকে লিখেছেন-" স্বাস্থ্যের দিক থেকে নিশ্চিতই  আমি আগের চেয়ে অনেকটা ভালো।  মিসেস মেল্টন  মনে করে আমি এখন স্বাধীন ভাবে  ইচ্ছামত যত্রতত্র যেতে পারি- এভাবে আমার চলতে হবে, তাহলেই আমি অল্প কয়েক মাসে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠব। "
তবে একথা সত্য যে, স্বামীজী যতদিন মীডদের পরিবারে ছিলেন,ততদিন তিনি বাস্তবিকই  তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন নি।  মিসেস হ্যান্সব্রো-র স্মৃতি অনুসারে -"তাঁকে সবসময়ই বেশ হাসিখুশি দেখাত , বিশেষত  তিনি যখন কোনো বিশেষ একটা কাজে মগ্ন হয়ে থাকতেন।  তিনি যতদিন আমাদের বাড়িতে ছিলেন, তখন  কখনো তিনি তাঁর অসুস্থতার কথা আমাদের কাছে বলেননি।  সে সময় তিনি কোনও বেলা তাঁর খাবার বন্ধ করেন নি, অথবা কখনও  কোন প্রকারে এমন   ভাব দেখান নি যে তিনি অস্বুস্থ।"

 স্বামীজী যে শুধু প্রতি বেলায় তাঁর খাবার খেয়েছিলেন নয়,তিনি প্রায় সব রকম  খাবারই খেয়েছেন এবং এতে তাঁর শরীর খারাপ করেছিল বলে মনে হয় নি।  আগেই দেখা গেছে,তিনি প্রাতরাশে বেশ  ভালই খেতেন। দুপুরের আহারে সাধারণত  তিনি ভেড়ার মাংস খেতেন;তার সঙ্গে থাকত নানা   রকমের পছন্দমত শাক সবজি  -বিশেষত  কড়াই শুঁটি।  মিসেস হ্যান্সব্রো -র স্মৃতি অনুযায়ী -"আহারের শেষভাগে  মিষ্টি ইত্যাদি খাবারের স্থলে আমরা ফলই খেতাম। আঙুর  তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল। " কিন্তু কোন কোন প্রকারের ফল তিনি পছন্দ করতেন না।  একবার একটি ঘটনায় তাঁর ইঙ্গিতে বুঝে গেলাম তিনি পেয়ারা পছন্দ করেন না।  তারপর থেকে খাবার টেবিলে আমরা পেয়ারা রাখতাম না।  

      প্রায়ই স্বামীজী তাঁর সকালবেলার   ক্লাসের কোন না কোন ব্যক্তিকে মীডদের বাড়িতে  মধ্যাহ্নভোজের জন্যে নিমন্ত্রণ করে   নিয়ে আসতেন। উপরন্তু মিস ম্যাকলাউড  এবং মিসেস লেগেটও  লস এঞ্জেলস  থেকে সকালবেলা  স্বামীজীর ক্লাসে যোগ দিতে এসে প্রায়ই  মীড দের বাড়িতে দুপুরের   আহার করে যেতেন।  এইসব ভোজসভায় খুবই  অন্তর্দৃষ্টি উদ্দীপক এবং প্রাণপ্রদ  আলাপ আলোচনা হত। কোনো  কোনো দিন -সম্ভবত প্রায় দিনই আলোচনার প্রসঙ্গ চলে আসতো ভারতবর্ষ  সম্পর্কে।  ভারতের কথা তাঁর মন থেকে কখনও মুছে যেত না - তাঁর দেশবাসীর নানা সমস্যার কথা  ভেবে ভেবে তিনি কখনও কখনও হতাশায় নীরব ও স্তব্ধ  হয়ে যেতেন। কখনো কখনো তাঁর অন্তর থেকে প্রতিবাদের অসহনীয়  সুর উত্সারিত হয়ে উঠত।  মিসেস লেগেট স্বামীজীর সব কথাতেই  শ্রদ্ধার সঙ্গে সায়  দিতেন।  তিনি হিন্দুদের শান্তশিষ্ট প্রতিকারহীন ভাবকে  প্রশংসা করেই স্বামীজীকে কিছু বলেন। উত্তরে স্বামীজী বলেন ,'হিন্দুদের এরূপ মনোভাবকে  তুমি কিরূপে ভালো বলে প্রশংসা করতে চাও? তুমি কি মনে কর যে , যদি হিন্দুদের একটুও ক্ষাত্রবীর্য থাকত ,তাহলে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ইংরেজ  ভারতবর্ষকে শাসন করতে পারত ? আমি ভারতের সর্বত্র আমিষ আহারের উপকারিতার  কথা প্রচার করে থাকি, তাতে যদি আমরা ক্ষত্রিযচিত  পৌরুষ জাগিয়ে তুলতে পারি। '  

   মধ্যাহ্নভোজের মধ্যে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হতো নিকটবর্তী  পাহাড়ের উন্মুক্ত চূড়ার  ওপর অনুষ্ঠিত বনভোজন।  হ্যান্সব্রো   বলেন: "আমরা যারা নিয়মমত স্বামীজীর ক্লাসে যোগদান করতাম  ,তাদের কয়েকজন মিলে  একটা দল  গড়তাম। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কথাবার্তা হত আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে। পিকনিক করতে আসা  দলের সঙ্গে স্বামীজীর একটি ছবি বিবেকানন্দ হাউসের দেওয়ালে টাঙ্গানো  আছে।  ওই ছবিটি তোলা  হয় ওই পাহাড়ের চূড়ার উপরে।"  এই ফটোর মধ্যে স্বামীজী আসন করে বসে আছেন পিকনিকের চাদরের ওপর ; তাঁর বাঁদিকে বসে আছেন হ্যান্সব্রো,পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস ওয়াইকফ ;আর ডান দিকে আছেন মিসেস ব্রুস নাম্নী জনৈকা মহিলা।  দুপাশে দেখা যাচ্ছে দুই বা তিন জন মহিলা অতিথিকে।  তাঁরা সবাই পরে আছেন সে   যুগের লম্বা ঝুলানো  স্কার্ট ,টাইট অন্তর্বাস ,লম্বা হাতার জামা এবং খুব ভারী মাথার টুপি।  এই ফটোটি তলা হয়েছিল সকলের স্বাভাবিক যেমন তেমন অবস্থায়।  দুজন মহিলা পরস্পর কথাবার্তা বলছেন; মনে হচ্ছে স্বামীজী যেন খুব কৌতুকভরে চীনে তৈরি  মিষ্টি রুটি কিনলে কি রকম সম্পত্তি লাভ করা যায়, সে বিষয়ে এক টুকরো কাগজ থেকে কি যেন পড়ছেন  ,আর মিসেস ব্রুস স্বামীজীর কাঁধের ওপর দিয়ে তা পড়ার  চেষ্টা করছেন।  কারও গায়ে কোনো কোট ,শাল  অথবা  চাদর না থাকাতে অনুমান করা যায় যে সেদিন কার আবহাওযা ছিল খুবই আরামদায়ক।  সে বছর শীতকালের প্রায় প্রতিটি দিনই ছিল এরূপ আরামদায়ক।   

জানুয়ারী মাসের সেই সব শান্ত নীরব উষ্ণ দিনগুলোতে বনভোজনে অংশগ্রহণকারী সকলে যেখানে ওপর   থেকে নিচের  দিকে তুষারাচ্ছন্ন পর্বতের ঢালে বিস্তীর্ণ  শস্যসমৃদ্ধ  উপত্যকাগুলি দেখতে পাওয়া যেত সেরকম স্থানে বসে  কথাগুলো  শুনতো আর তা শুনতে শুনতে তারা যেন তাদের অস্তিত্বের  উচ্চতর স্থানে উন্নীত হয়ে তাদের মাঝে প্রজ্জ্বলিত  দিব্যবহ্নির আমেজে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ত।  মিসেস হ্যান্সব্রো   বলেন-"যখন স্বামীজী কোথাও কিছুক্ষণের জন্য  কথাবার্তা বলতেন ,তখন সেই সমগ্র পরিবেশটি  যেন এক আধ্যাত্মিকভাবে  ভরপুর  হয়ে যেত। " মিসেস হ্যান্সব্রো একটি বিশেষ ঘটনার কথা বলেছেন ,যেখানে স্বামীজী একটি বিষয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একেবারে তন্ময়  হয়ে গিয়েছিলেন।  তিনি বলেছেন - "স্বামীজী অবিরতভাবে একটানা না থেমে  সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টে পর্যন্ত  ছ ঘন্টা বিষয়টি আলোচনা করলেন।  যখন তাঁর আলোচনা শেষ হলো তখন স্থানটি এক আধ্যাত্মিক ভাবে একেবারে ভরপুর হয়ে গিয়েছিল। "

   তাহলে মীড দের বাড়ির পরিবেশটি না জানি কিরূপ হয়ে উঠেছিল।   বোনদের অনুভব সম্পর্কে পরে এক    বোন বলেছিলেন-"স্বয়ং যিশুখ্রিস্টই  যেন তাঁদের মধ্যে বিরাজিত ছিলেন।" তিনি তাঁর সম্পূর্ণ অবসর সময়ে বা চরম কর্মব্যস্ততার মধ্যে যা কিছুই  করুন না কেন ,তাঁর মন সর্বদা সচেতনভাবেই এক উচ্চস্তরের ঈশ্বরীয় ভাবে নিমজ্জিত হয়ে থাকত। কারণ এটাই ছিল তাঁর স্বাভাবিক  অবস্থা।   কিন্তু  দেখলে কখনো মনে হত না যে ,তিনি একজন অতিমানব অথবা নাগালের বাইরের  কোনো এক সত্তা ,পরন্তু তাঁকে মনে হতো অতি আপনজন।  মিসেস হ্যান্সব্রো   তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন - "আমাদের সকলের ক্ষেত্রেই স্বামীজীর ধৈর্য ছিল অপরিসীম। তিনি যে আমাদের চেয়ে বড় -এ ভাবটি আমাদের মন থেকে দূর করে দিয়েছিলেন। যদিও তাঁর মধ্যে কেউ কেউ উদাসীনতার ভাব   দেখতে পেয়েছেন, আমি কিন্তু কখনও তা দেখিনি।  আমি মনে করতাম যে সর্বদাই তাঁর সঙ্গে আমার একটা ঘনিষ্ঠ  সম্বন্ধ আছে।  যেন তিনি আমার এমন এক আপনজন  ,যাঁকে দীর্ঘকাল দেখিনি এবং যিনি দীর্ঘকাল যাবত  আমার কাছে আসছেন।  আমার মনে হত আমার কোথাও যেন একটা বেদনার ভার আছে-সে ভার আমার পিঠে নয়,আমার হৃদয়ে।  স্বামীজীর সঙ্গে  সাক্ষাত হবার পর আমি অনুভব করলাম যে , আমার হৃদয়ের সে বেদনার ভার কে যেন তুলে নিচ্ছে  ,ক্রমে ক্রমে আমার সে বেদনার অনুভবটি দূর হয়ে গেল।  

     এর চেয়েও স্থুল এবং বহুজনবিদিত একটি কাহিনী আছে -যাতে মিসেস ওয়াইকফ  তাঁর এক মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি লাভ করেছিলেন  -স্বামীজীর ব্যবহৃত তামাক খাবার পাইপটি স্পর্শ করে।  মিসেস হ্যান্সব্রো কাহিনীটিকে এভাবে বিবৃত করেছেন  :"দক্ষিণ পাসাডেনা ছেড়ে যাবার কিছু দিন পূর্বে  স্বামীজী আমাকে বললেন -'আমি যেখানেই যাই না কেন ,সেখান থেকে চলে যাবার সময় আমি কিছু একটা জিনিস  ফেলে রেখে যাই।  এবার সানফ্রানসিসকো  যাবার সময় আমি আমার এ পাইপটা এখানে রেখে যাব। ' তিনি খাবার ঘরের উনুনের  পাশের তাকের উপরে পাইপটি রেখে গেলেন।  আমরাও সেখানে এই পাইপটাকে অলংকারের মতো অনেকদিন ধরে সাজিয়ে রেখেছিলাম।  তারপর একদিন মিসেস ওয়াইকফ এসে ওটাকে হাতে তুলে নিলেন। তিনি বহুদিন যাবত কোন স্নায়বিক অসুখে ভুগছিলেন এবং তাঁর জীবনে আরও  নানা ব্যক্তিগত সমস্যাদি ছিল।  কিছু দিন যাবত তাঁর অসুখ প্রায় অসহনীয়  হয়ে উঠেছিল এবং সঙ্গে আরও সব নানা গোলমাল এসে জুটল।  সব মিলে  তিনি একেবারে মনমরা হয়ে পড়লেন।  তিনি উনুনের পাশের তাকের কাছে  গিয়ে স্বামীজীর সেই পাইপটি হাতে তুলে নিলেন।  সেই পাইপটা  হাতে তুলে নিতে না নিতেই তিনি একটি দিব্যবাণী শুনতে পেলেন -'ম্যাডাম  ,এ কাজটা কি খুব কঠিন ?' যে কোনো কারণেই হোক তিনি সেই পাইপটাকে তাঁর কপালের উপর ঘসলেন।   সঙ্গে সঙ্গেই  তাঁর যন্ত্রণা কমে গেল।  তিনি যেন একটা স্বস্তির ভাব  অনুভব  করতে থাকলেন।  তারপর আমাদের মনে হলো  এই পাইপটা  তাঁর কাছে থাকাই ভালো এবং বহুদিন পর্যন্ত সেটা তাঁর কাছেই ছিল। " (বর্তমানে এই পাইপটি দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বেদান্ত সোসাইটির অধিকারে আছে।  )  

   তবে স্বামীজীর সবচেয়ে তাতপর্যপূর্ণ  দৈব  শক্তির খেলা হলো ,তিনি যেখানেই থাকতেন,সেখানেই তাঁর চারপাশে  একটি অনির্বাণ  জ্যোতির  বেষ্টনী রচনা করত। যাঁরা  তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে  ছিলেন, তাঁদের স্মৃতিতে স্বামীজীর সামান্য,ছোট -আপাত তুচ্ছ  ব্যাপার বা তাঁর কথাবার্তাও স্পষ্ট  বিরাজিত আছে।  তাঁরা এতই  শ্রদ্ধার সঙ্গে এগুলিকে স্মরণে রেখেছেন ,কারণ তাঁরা স্পষ্টই জানতেন যে এসবই ছিল স্বামীজীর অতীন্দ্রীয় অনুভূতিপ্রসন্ন বিষয়। তাঁর   প্রতিটি   চালচলন ছিল দিব্য করুণা  ও মহিমার প্রকাশ।  স্বামীজীর এই চিরন্তন দৈবশক্তির মহিমা, উপরন্তু  তাঁর অকস্মাত জ্যোতির্ময় এবং উজ্জ্বল শক্তির বিস্ফুরণের জন্যই মীড  ভগিনীগণ প্রতিটি মুহুর্তেই মনে করতেন যে  যিশুখ্রিস্ট  স্বয়ং তাঁদের মধ্যে বিরাজিত আছেন। সে সময়কার পূর্বাপর ঘটনাবলীর প্রতিটিই যে খুব উল্লেখযোগ্য  ছিল,তা নয়।  বরং একটি প্রদীপ যেমন প্রজ্জ্বলিত অবস্থায় থাকে -তেমনি প্রতিটি  দিন,প্রতিটি ঘন্টা স্বমহিমায় মূর্ত থাকত।  

       দৈনন্দিন কার্যসূচি ছিল খুবই সহজ সরল।  দুপুরে আহারের পর স্বামীজী সাধারণত  শোবার ঘরে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে বই পড়তেন বা কথাবার্তা বলতেন  আর তখন মিসেস ওয়াইকফ ব্যস্ততার সঙ্গে তাঁর গৃহস্থালির যতসব কাজকর্ম  সেরে  নিতেন।  একদিন স্বামীজী তাঁকে বললেন ,"ম্যাডাম ,আপনি এত পরিশ্রম  করে সব কাজকর্ম করেন ,তাতে আমিই যেন ক্লান্তিবোধ করি।  আচ্ছা ক্ষেত্রবিশেষে  মার্থারও প্রয়োজন হয় ,আর আপনি হচ্ছেন একজন মার্থারই মতো। "  

   আবার কখনও কখনো তিনি তাঁকে তাঁর কাজকর্ম রেখে তাঁর সঙ্গে বাগানে বেড়াতে যেতে বলতেন।  বাগানে বেড়াতে বেড়াতে তিনি বাংলা গান গাইতেন অথবা সংস্কৃত  মন্ত্র আবৃত্তি করতেন।  মিসেস হ্যান্সব্রো আমাদের বলেছেন: " তিনি আমাদের কাছে ঐসব ব্যাখ্যা করতেন তাঁর ব্যক্তিগত ভাব ভঙ্গিতে -মঞ্চে ভাষণ দেবার সময় যেভাবে ব্যাখ্যা করতেন তার চেয়েও অনেক   নিবিড়  আন্তরিকতায়।"   আবার কখনো কখনো হয়ত তিনি খ্রিস্টীয় প্রার্থনা সঙ্গীত গাইতেন: "পৌত্তলিকেরা অন্ধভাবে   গাছ পাথরকে  প্রণাম  করে।"  মিসেস হ্যান্সব্রো স্বামীজীকে এসব কথা শিখিয়েছিলেন এবং স্বামীজীও এসব শুনে বেশ কৌতুক অনুভব করেছিলেন।  তিনি হেসে জবাব দিতেন -"আমি হচ্ছি সে 'হিদেন' -মূর্তিপূজক।"  

 খুব সম্ভব বিকালবেলাতে  স্বামীজী কিছু লেখার কাজ করতেন। মিসেস বুলকে ও নিবেদিতাকে অনেক গল্প লিখে পাঠাতেন। তাঁর ক্যালিফর্নিয়া থাকাকালে নিবেদিতাকে  একটি সুন্দর কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। কবিতাটির নাম 'কে জানে মায়ের খেলা।' কবিতাটির প্রথম আরম্ভ হচ্ছে -
 "কে জানে -হয়তো তুমি ক্রান্তদর্শী ঋষি !
সাধ্য কার স্পর্শে সে অতল গভীর গহন ,
যেখানে লুকানো রয়  হাতে অমোঘ অশনি। "

আর এই কবিতাটির সমাপ্তি হচ্ছে:

" হয়তো শিশুর চোখে দিব্যদৃষ্টি জাগে,
 স্বপ্নেও ভাবেনি যাহা  পিতার হৃদয় ,
  হয়তো সহস্র শক্তি কন্যার অন্তরে 
রেখেছেন বিশ্বমাতা সযত্ন সঞ্চয়। "
এই কবিতাটি  'জন্মদিন' উপলক্ষে লেখা।  উত্তরে নিবেদিতা ১৩ই জানুয়ারী লিখলেন," জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখা আপনার আশীর্বাদী কবিতাটি গতকাল রাতে পেয়েছি।  এর উত্তরে আমি আর কি লিখব,বলুন ? কি-ই বা আমি লিখতে পারি? যা লিখব,তাই অতি সাধারণ শোনাবে।  শুধু বলতে পারি, আপনার সুন্দর ইচ্ছাটি যদি বাস্তবে ঘটেও ,তা আমার পক্ষে হৃদয়বিদারক হবে।  আমি শান্তি পাব না,যদি নিশ্চিতভাবে আমি একথা না বুঝি আমার গুরু (যে আনন্দের অধিকারী হয়েছেন,তা ) মহত্তর।   

   এটা খুবই সম্ভব যে,বিকালবেলাগুলিতে স্বামীজী কখনো কখনো ব্যক্তিগতভাবে  কাউকে দর্শন দিতেন অথবা যাঁরা  মীড ভগিনীদের বাড়িতে আসতেন, তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা  বলতেন। তাহলেও তিনি সবসময়ে কথাবার্তা বলার মেজাজে  থাকতেন না।  
বিকালবেলার শেষ দিকে স্বামীজী নৈশ ভোজ তৈরী করার ব্যাপারে কখনো কখনো  মিসেস ওয়াই কফকে সাহায্য করতেন এবং প্রায়শই তিনি নিজেই সব কটি  পদ রান্না করতেন।  মিসেস হ্যান্সব্রো বলেছেন-"যখন লিঙ্কন পার্কে আমাদের বাড়িতে থাকতেন, তখন তিনি নিজেই সকলের জন্যে পুরো রান্নাটাই  সেরে ফেলতেন।  তিনি প্রায়ই তরকারি ও চাপাটি তৈরি করতেন, যা রাল্ফ ও  ডরোথির খুব প্রিয় হয়ে   উঠেছিল।  তিনি যেসব মশলাপাতি দিয়ে রান্না করতেন ,তার অধিকাংশকেই বাটতে হতো (গুড়ো  করতে হতো ) . যেহেতু তিনি  টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করা পছন্দ করতেন না ,সেজন্য তিনি একটি মাখন রাখার  বাটি  তাঁর সামনে রেখে আসনপিড়ি করে রান্নাঘরের মেজেতে বসে পড়তেন।" স্বামীজী মশলাগুলো গুড়ো করে নেবার পর ঐগুলো দিয়ে ভাজার জন্য- তরকারি  সাঁতলাবার জন্য উনুনের কাছে যেতেন।  মশলা 
সাঁতলানোর সময় মশলার যে চোখ -জ্বালা করা ধোঁয়া বের হতো তাতে বোনেদের  নাস্তানুবুদ হতে হতো -তার এক সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ব্রহ্মচারিণী  ঊষা  তাঁর লেখা এক প্রবন্ধে যা 'বেদান্ত এন্ড দি ওয়েস্ট 'পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে।  স্বামীজী সবাইকে সাবধান করার জন্য আগে থেকেই  উঁচু গলায় ঘোষণা  করতেন -'ঐ  ঠাকুরদাদা আসছেন, মহিলাদের বেরিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। ' 

  হ্যান্সব্রোর উক্তি   অনুসারে স্বামীজী খুব একটা হাসতেন না বা ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেন না।  স্বামীজী  সবচেয়ে হাসিখুশির মেজাজে থাকতেন যখন তিনি রান্নাঘরে স্বাধীনভাবে  ছোটাছুটি করে সমগ্র পরিবারের জন্য হরেক রকমের ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর  পদের রান্না করার অনুমতি পেতেন।  কিন্তু স্বামীজীর হাসিখুশির হালকা মেজাজের  সময়ও তাঁর সান্নিধ্যে থাকতে পারলে বহু কিছু শিক্ষা করা যেতো।  তিনি কখনো মৌখিক নীতি উপদেশ দিতেন না। তিনি শুধুমাত্র চোখ খুলে দিতেন আর তাঁর এই সময়ে অসময়ে দেওয়া শিক্ষাগুলি  কেউ  ভুলতে পারত না।  

      মীড দের পরিবারে নৈশভোজ হত সাধারণত সাড়ে ছটায় এবং যেসব রাত্রে আটটার  সময় স্বামীজীর ভাষণ দানের কর্মসূচী থাকত ,সেসব দিনে হয়তো আরও আগেই রাত্রির আহার হয়ে যেত।  মিসেস হ্যান্সব্রো-র স্মৃতি অনুসারে ভোজ্যপদগুলি  বেশ পুষ্টিকরই ছিল :" আমরা সাধারণত সুপ এবং হয় মাছ না হয় মাংস  ,শাকসব্জি এবং শেষে মিষ্টি ইত্যাদি -যেমন মাংস ও ফলের পিঠে যাকে পাই বলা হয়  তাই খেতাম।  স্বামীজী অন্য যেসব মিষ্টি ভালবাসতেন ,তাও খেতাম।  সাধারণত তিনি রাত্রে কফি খেতেন না।" তবে প্রায়ই অবশ্য স্বামীজীর তৈরি  তরকারি ,চাপাটি এবং অন্যান্য খাবারও  থাকত।  রাত্রির আহারের পর টেবিলটি  পরিস্কার করা হতো ; চুল্লির খোলা ঝাঁঝরির সামনে   আগুন জ্বালা হতো এবং পরিবারের সকলে ও অতিথিবর্গ এই গরম ঘরে অনেকক্ষণ  পর্যন্ত থেকে যেতেন।  কেউ বসতেন টেবিলের পাশে,কেউবা ইজিচেয়ারে।  স্বামীজীর বসার জন্য এমন একটা বড় ইজিচেয়ার বানানো হয়েছিল যার উপর তিনি আসন করেও বসতে পারতেন।  তিনি সাধারণত পরতেন, যাকে বলা যায় ,একটা 'ডিনার  জ্যাকেট ' বা 'ধূমপানের জ্যাকেট।'  ঘরভর্তি  লোক,আগুনের উত্তাপ এবং গ্যাসের আলো মিলে  কখনো কখনো ঘরটি  স্বামীজীর কাছে বেশি গরম বলে মনে হতো।  একদিন যখন সকলের অলক্ষ্যে  আগুনের শিখাগুলি নিভে গিয়েছিল ,তখন স্বামীজী হঠাত ঈশ্বরের নামে জয়ধ্বনি  দিয়ে উঠলেন -"জয়, প্রভুর জয়-আগুন নিভে গেছে। "   

    স্বামীজী রাত্রির আহারের পর তাঁর খুব অন্তরঙ্গ ব্যক্তিদের সঙ্গে যেসব আলোচনা করতেন  ,তা যদি তাঁদের কেউ লিপিবদ্ধ করে রাখতে পারতেন,তাহলে তা দিয়ে একটা বই হয়ে যেত  -কিন্তু কেউই তা  করেন নি।  তবে যাই হোক ,চল্লিশ বত্সর পরে মিসেস হ্যান্সব্রো তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, "স্বামীজী   বহুবিধ বিষযে আলাপ আলোচনা করতেন ;দর্শন,বিজ্ঞান ,যুক্তরাষ্ট্রের  উন্নতি -ইত্যাদি নানা বিষয়ে।  তিনি আমাদের জাতীয় জীবনের সকল বিষয়েই খুব উত্সাহী  ছিলেন। তিনি আমাদের বৈষয়িক জীবনে এতটা মনোযোগ দেওয়া পছন্দ করতেন না।  ঘরোয়া কথাবার্তার সময় তিনি একদিন আমাদের বলেছিলেন যে, যদি আমরা সব কিছুকে আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিতে গ্রহণ  না করি ,তাহলে আমাদের সভ্যতা আগামী পঞ্চাশ বত্সরের মধ্যেই   ভেঙে পড়বে। তিনি বলেছিলেন যে আমরা বৈষয়িক মূল্যবোধের ওপরই দেবত্ব আরোপ করছি, তাই আমরা এই ভোগবাদের ভিত্তির ওপর কিছুই চিরস্থায়ীরূপে  গড়ে তুলতে পারব না। "

         কখনো কখনো এসব রাত্রে স্বামীজী উচ্চকন্ঠে শাস্ত্রাদি পাঠ করতেন।  
হ্যান্সব্রো র স্মৃতি অনুসারে তিনি ছিলেন একজন সুললিত পাঠক ও আবৃত্তিকার -তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ ছিল চমত্কার।  তিনি নানা গ্রন্থ থেকে পাঠ করতেন।  একবার তিনি যখন অদ্বৈতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন ,তখন তিনি তাঁর 'সন্ন্যাসীর গীতি' কবিতাটি আনতে বলেন এবং উহা পাঠ করে শোনান।  অন্য একদিন বেশি রাত্রে তিনি 'গুরুর প্রয়োজনীয়তা' লেখাটা (তাঁর ভক্তিযোগ গ্রন্থের অন্তর্গত) আনতে বলেন। তখন তিনি আমাদের বোনঝি হেলেনের সঙ্গে কথাবার্তা  বলার সময় তাকে শুনিয়েই লেখাটা পড়লেন।  তিনি কিছুক্ষণ পড়েই  চললেন;তখন যে কোনো কারণেই হোক ,হেলেন তার আসন ছেড়ে উঠে একটি শোয়ার  ঘরের মোমবাতি  জ্বেলে তা স্বামীজীর হাতে তুলে    দিল।  স্বামীজী তাকে জিজ্ঞাসা  করলেন-"এর দ্বারা কি তুমি বুঝাতে চাইছ যে,এখন আমার ঘুমোতে যাওয়া প্রয়োজন ?" উত্তরে হেলেন বলল -"হ্যা ,তাই। এখন রাত্রি ১১টা  বেজে গেছে। " তারপর সব কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল।  'বোনঝি
 হেলেন ' -এর এরকম অগ্রপশ্চাত না ভেবে ঝপ  করে করে  ফেলা এই কাজটি তিন  বোনই দীর্ঘকাল মনে রেখেছিলেন। মিসেস হ্যান্সব্রো তাঁর স্মৃতিকথাতে লিখেছেন,  " বহুদিন পরও আমরা এই ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা করছিলাম  এবং আমাদের তিন বোনই তখন বুজতে পেরেছিলাম যে, পরোক্ষভাবে স্বামীজী হেলেনকে তাঁর কাছে দীক্ষাপ্রার্থী  হতে আহ্বান জানাচ্ছিলেন।  হেলেন বলল যে সে জানে না ,কেন সে দীক্ষা নেয়নি।  তখন তার মনে দীক্ষা  গ্রহণের কোনো প্রেরণা জাগে নি। "  তার এই কথাটি প্রকৃত অবস্থাকে লঘু করে দেখানোর একটা প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়।  

      বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, মীড ভগিনীদের কেউই স্বামীজীর কাছ থেকে  আনুষ্ঠানিক  কোন দীক্ষা গ্রহণ করেনি অথবা তারা নিজেদের কখনও স্বামীজীর অদীক্ষিত  শিষ্য বলেও মনে করেন নি। পরবর্তীকালে মিসেস
 ওয়াইকফ এবং হেলেন স্বামী তুরীয়ানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।  তিনি ওয়াই কফকে দীক্ষান্ত নাম দেন 'ললিতা।' মিসেস হ্যান্স ব্রো সম্পর্কে আর  একটি  ঘটনা -স্বামীজী তাঁকে একবার প্রশ্ন করে বসলেন -"আপনি কেন আমাদের সংঘে  যোগ দিতে পারছেন না ?" তাঁর উত্তর ছিল এই যে, তাঁর ছিল একটা নিজস্ব ক্ষুদ্র  জগত ,যাঁর জন্য তাঁকে সর্বদা ভাবতে হত।  পরবর্তীকালে মিসেস হ্যান্সব্রো বেদান্ত সমিতির সভ্যা হন এবং স্বামী তাঁকে নাম দিয়েছিলেন 'শান্তি'-কিন্তু শান্তি তাঁর কাছ থেকে কোনো দীক্ষা  গ্রহণ করেন নি।  

   তাহলেও ঠিক বলতে গেলে মীড ভগিনীগণ স্বামীজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ না করলেও -তাঁরা সবাই তাঁকে ভালবাসতেন এবং খুব ভক্তিভরে তাঁর সেবা করেছেন।  তাঁরা সবাই ছিলেন তাঁর একান্ত আপনজন।  স্বামীজীও  মীড ভগিনীদের বিশেষ  স্নেহ করতেন।  তিনি একসময় তাঁদের বলেছিলেন ," আগে থেকেই তোমাদের তিন বোনকে  জানতাম। " বিভিন্ন পত্রে নানা সময়ে তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা  করেছেন স্বামীজী।  বেটি লেগেটকে তিনি লিখেছিলেন ,
"ঈশ্বর তাঁদের মঙ্গল করুন ; ভগিনী তিনটি দেবদূতী নয় কি ? এখানে সেখানে এই ধরনের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত্কার সকল নিরর্থকতাকে সার্থক করে তোলে।"  স্বামী তুরীয়ানন্দকে লিখিয়াছিলেন," অকৃত্রিম, পবিত্র ও সম্পূর্ণ নি:স্বার্থ বন্ধু এরা। " 
মীড দের গৃহত্যাগকালে স্বামীজী বলিয়াছিলেন,"তোমরা তিন বোন চিরতরে আমার মনের অংশবিশেষ  হয়ে গেছ। "

    ১৯০০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যখন স্বামীজী মীড দের বাড়ি ছেড়ে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার  সানফ্রান্সিসকো  শহরে যান ,তিনি তাঁর পাইপটি ফায়ারপ্লেসের  ম্যান্টেলের উপর রেখে উঠে বলে ওঠেন ," এই বাড়িটি আর আগের মত থাকবে না। " তাঁর এই সরল উক্তি পরে সত্যি হয়েছিল।  বর্তমানে এই বাড়িটি এক পুণ্যসৌধে  পরিণত  হয়েছে এবং স্বামীজীর ভক্তদের কাছে এক তীর্থক্ষেত্রের  রূপ নিয়েছে। 

     স্বামীজীর পাসাডেনা ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে মীড দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়
নি।  স্বামীজীর বিশেষ অনুরোধে শান্তি সানফ্রান্সিসকোতে   স্বামীজীর সঙ্গে যান।   ওখানে তিনি স্বামীজীর সর্বকার্যে নিযুক্ত থাকতেন এবং তাঁর সেক্রেটারির কাজ করতেন। এই প্রসঙ্গে স্বামীজী এক পত্রে লিখেছিলেন,"মিসেস হ্যান্সব্রো এখানে আছে, আর আমাকে সাহায্য করতে সে শুধু কাজই করে চলেছে। " এখানকার ক্যাম্পে স্বামীজী একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে  শান্তি নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য  ছেড়ে তাঁর সেবা করেছেন।  স্বামীজী তাই মিস ম্যাকলাউড কে লিখেছিলেন,"ভগিনীটি  এত দরদ দিয়ে আমার সেবা করেছে যে তুমি অনুমান করতে পারবে না। " 
এখানেই স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি   গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর পাসাডেনাতে অবস্থিত মীডদের বাড়িতে থাকালীন জীবনযাত্রার একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ  করা সমাপ্ত করলাম ।