Thursday, May 30, 2019

আমার চোখে পুরানো কলকাতার ফেরিওয়ালা





আমার চোখে  পুরানো কলকাতার ফেরিওয়ালা

পুরানো উত্তর কলকাতার এক গলিতে প্রায় ৮০ বছরের উপর কাটিয়ে দিলাম । এই গলিতে বসবাসের কারণে কত ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছি তার লেখাজোকা নেই । স্মৃতিচারণ করতে বসে অনেক কথাই মনে পড়ে যায় । আজ হঠাৎ আমাদের ছোটবেলার এই গলিতে ভ্রাম্যমাণ বিভিন্ন রকমের ফেরিওয়ালাদের কথা মনে এসে গেল। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত নানা রকমের ফেরিওয়ালা বিভিন্ন পসারি নিয়ে হাজির হতো আমাদের এই গলিতে । তাদের বিভিন্ন রকমের চিৎকার , অঙ্গভঙ্গি , ছড়াকাটা সবই ছিল আমাদের কাছে আকর্ষণীয় । কিন্তু এরা কোনোদিন আমাদের বাড়িতে কড়া নেড়ে জিনিসপত্র বিক্রি করার অনুরোধ করতো না । নানাবিধ জিনিস বিক্রি করা ছাড়া নানা রকমের কাজের ব্যাপারে যেমন ছাতা সারাই , জুতো সারাই , খবরের কাগজ ও শিশি বোতল সংগ্রহ করা , চুল কাটার নাপিত , লোহার হাড়ি , কড়াই , ঘটি , বাটির ফুটো সারাই , ছুরি কাঁচি , বটিতে সান দেওয়া , তালা , চাবি নিয়ে বাড়ির সমস্যা মেটানো , বাটনা বাটার শিল নোড়া কুটিয়ে নেওয়া ইত্যাদি কাজের লোকের ভিড় লেগেই থাকতো দিনভর ।

এখন আমাদের জীবন যাত্রার ধরণ বদলে গেছে । আমরা আধুনিক যন্ত্র চালিত নানা দৈনন্দিন সাজ সরঞ্জাম ব্যবহার শুরু করেছি । সেজন্যে এই সব ফেরিওয়ালাদের বেশির ভাগকেই আর প্রয়োজন পড়ে না । সেজন্যে এরাও ধীরে ধীরে আমাদের গলি থেকে বিদায় নিয়েছে । এখন এদের জায়গাতে বিভিন্ন আধুনিক দোকান থেকে সুবেশা ছেলে মেয়েরা দৈনন্দিন জীবন যাপনের সরঞ্জাম বিক্রির জন্যে সাত সকালে কলিং বেল বাজিয়ে হাজির হন । অনেকে তাদের কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে হয়তো কিছু জিনিসপত্রের অর্ডার দিয়েও দেন । তবে সবাইয়ের উপর পুরানো ফেরিওয়ালাদের আন্তরিকতার ছোঁয়া কিন্তু খুবই মিস করি । এখন বলি সেদিনের সেই ফেরিওয়ালাদের কথা আমার স্মৃতির  সরণি বেয়ে ।




সকাল থেকেই শুরু হতো পুরানো কাগজ ,শিশি বোতল বিক্রি করার জন্য এই সব ক্রেতাদের বিভিন্ন ধরণের আওয়াজ ।ছোটবেলায় এটা খেয়াল করি নি ,কিন্তু বড় হয়ে ভাবতাম যে সাত সকালে কারা বাড়িতে কাগজ নিয়ে বসে আছে বিক্রি করার জন্যে আর ওই বিক্রিলব্ধ পয়সা দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে !

এরই সঙ্গে জুতো সেলাইয়ের মুচির আওয়াজ শোনা যেত ।কত যে জুতো হাজির হত ওর কাছে,তার ইয়ত্তা নেই । শীতকালে ভোর থেকেই লেপ  তোষক বানানোর জন্যে ধুনুড়িদের টং টং আওয়াজ শোনা যেত , এর সঙ্গে ছাতা সারাইয়ের কাজের লোক এসে যেত,বিশেষত বর্ষা কালে । তখন চুল দাড়ি কাটার সেলুনের চল শুরু হয় নি । সেজন্য পাড়াতেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই নাপিতেরা এই সব কাজ করে আসত । আমাদের ছোটবেলায় শ্রীপতি,রজনী,গণেশ আমাদের বাড়িতে সময় বুঝে আসত । শ্রীপতি তো আমাদের এক বাড়িতেই থাকত ,খেত,শুতো । এরই মাঝে ফলওয়ালা হাজির হত ফলের ঝুড়ি নিয়ে । তারপরে এসে হাজির শোনপাপড়িওয়ালা । হাতের থালাতে শোনপাপড়ি সাজিয়ে কতরকমেরে হাঁক পেড়ে সে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে শোনপাপড়ি বিক্রি করত ।ওর অত্যাধিক পরিশ্রমের জন্যই অনেকে শোনপাঁপড়ি কিনে নিত, যদিও দোকানে শোনপাঁপড়ি পাওয়া যেত ।আমাদের এখানে  বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রিটের সিটি কলেজের বিপরীতেই শোনপাপড়ি তৈরির কারখানা ছিল । ওখানে সস্তাতে শোনপাঁপড়ির ছাট পাওয়া যেত । ভাঙা বিস্কুটের মত এই ছাট দামে সস্তা আর খেতে খুব সুস্বাদু থাকত ।মাঝে মাঝে বেলার দিকে হঠাৎ হঠাৎ একটি মাছওয়ালা নানা রকম মাছ ঝুড়ি করে বিক্রি করতে আসত ।আমাদের বাড়ির কাছেই দুটো বাজার থাকাতে ও কেন মাছ নিয়ে আসত কে জানে ? বিক্রিবাট্টা বেশি হতে দেখি নি ।এরই মাঝে একটি লোককে ধীরে ধীরে ‘রিপ ‘ ’ রিপ’আওয়াজ করে যেতে দেখতাম । অনেকদিন পর্যন্ত বুঝতেই পারতাম না যে ওই লোকটি কি বলতে চাইছে আর ও কি বিক্রি করতে চাইছে । পরে জানলাম যে ও রিপু কর্ম ভালো করতে পারে । সেই রকম কাজ খোঁজার জন্যেই ঐরকম করে ডাক দিয়ে যায় ।

শীতকালে সকালের দিকে খেজুর গুড় মাথায় মাটির হাড়ি কিংবা কাঁধের বাঁকে মাটির কুঁজোর মত জালাতে করে নিয়ে আসত নিকটবর্তী গ্রামের লোকেরা । সঙ্গে আবার নলেন গুড়ের পাটালি থাকত ।এগুলোর কদর ছিল খুব ।এই গুড় কিংবা পাটালি পায়েসের মধ্যে দিলেই ভুর ভুর করে সুন্দর গন্ধে চারিদিক আমোদিত হয়ে যেত ।সে সব দিন চুকে বুকে গেছে ।এখন খেজুর গাছে চড়ে খেজুর রস আনার সেই শিউলি সম্প্রদায় প্রায় বিলুপ্ত হত বসেছে ।সুতরাং ভালো খেজুর পাওয়া এখন খুবই দুষ্কর ।এ ছাড়া এই সময়ে আমাদের কাছের জয়নগর থেকে জয়নগরের বিখ্যাত মোয়া নিয়ে আসত । খই আর ক্ষীর দিয়ে সুস্বাদু এই মোয়ার  অনেক সন্দেশ ,রসগোল্লার চেয়ে কদর ছিল বেশি । বহু সময় আত্মীয় কুটুম বাড়িতে এক হাড়ি জয়নগরের মোয়া অনেক উপাদেয় উপহার ছিল ।তবে এখন আর সেদিন ফুরিয়ে গেছে ।এখন জয়নগরের মোয়া বলে যেসব জিনিস বিক্রি হয় সেগুলি সবই ভেজাল দ্রব্য ।

দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত অনেক রকমের ফেরিওয়ালা এবং অন্যরকম লোকেদের আনাগোনা বেড়ে যেত  গলিতে ।কোনো কোনো দিন বাঁদর নিয়ে খেলা দেখাতে আসত ।দূর থেকে পরিচিত ডুগডুগির আওয়াজ শুনলেই আমরা ছোটরা দরজা দিয়ে মুখ বাড়াতাম  ।ছোটদের আবদারে কোনো না কোনো বাড়ি থেকে বাঁদর খেলা দেখার ব্যবস্থা হয়ে যেত ।ভীষণ প্রিয় ছিল এই খেলাটি ।অনেক কিছু উঠে গেলেও বাঁদর খেলা এখনও মাঝে মাঝে গলিতে দেখা যায় ।মাঝে মাঝে ভালুক নিয়ে খেলাও দেখা যেত ।ভালুকের দুলে দুলে নাচ ,ডিগবাজি খাওয়া ,শুয়ে গড়াগড়ি দেওয়া কত দেখেছি আর হেসে কুটোপাটি হয়েছি ।তবে ভালুকগুলো দেখলে মনে হত ওগুলোকে ভালো করে যত্ন করা হয় না, ভালো করে খাওয়ানো হয় না ।এ ছাড়া কাঁসার বাসন ও এলুমিনিয়ামের বাসনওয়ালাও চিৎকার করে তাদের বাসন বিক্রি করার কথা বলে যেত ।এর মধ্যেই মাথায় এক কাঠের বাক্স ও হাতে হাপর নিয়ে হাজির হত পুরানো বালতি,হাড়ি ,কড়াই প্রভৃতি সারাই করার লোক । হাঁক পাড়ত  ,পুরানো বালতি ,হাড়ি ,কড়াই সারাবেন? এই ঝালাই করার লোকের খুব চাহিদা ছিল তখন। অনেক সময় ঘাড়ে সান দেওয়ার যন্ত্র নিয়ে ছুরি,কাঁচি,বঁটি ইত্যাদিতে সান দেওয়ার জন্যে লোক হাঁক পাড়তে পাড়তে আসত । বেলার দিকে ‘সিল কোটাও’ বলে সিল নোড়া কুটিয়ে নেওয়ার জন্যে ডাক পেড়ে লোকের আনাগোনা ছিল ।অনেকেই এদের থেকে নানা গৃহস্থালী জিনিসে সান দিয়ে নিতো । শিল নোড়াও কুটিয়ে
নিত ।
তা ছাড়া আরও দুটি খুব মজাদার ফেরিওয়ালা মাঝে মাঝে আসত ।একটা হল ঠেলাগাড়ি করে তাতে জামা কাপড় থেকে গৃহস্থালির নানারকম প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে নিলামওয়ালা ‘সাড়ে  ছ আনা’ হাঁক পাড়তে পাড়তে এসে হাজির হওয়া ।অনেকেই এদের কাছ থেকে নানারকম টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনত। এদের নিয়েই তো সেই বিখ্যাত ‘নিলামওয়ালা ‘ গানটি চিত্রায়ন হয়েছিল এবং খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ।এ ছাড়া মাথায় করে বড় ঝুড়ির মধ্যে নানারকম মাটির  দেব দেবীর মূর্তি নিয়ে আসত কয়েকজন ফেরিওয়ালা ।

তাদের সুরেই বিখ্যাত সুরকার  সনৎ সিংহ গান লিখেছিলেন ,

আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি এতে রাম রাবণ আছে
দেখে যায় নিজের চোখে হনুমান কেমন নাচে ।
এ সুযোগ পাবে না ,কি দাম দেবে

পুতুল নেবে গো ,পুতুল। …

আমরা ছোটরা  গোল হয়ে নানারকম পুতুল দেখতাম । তবে বেশির ভাগ সময় কিছুই কেনা হত না ।

আর আসত মাঝে মাঝে ম্যাজিক দেখাতে  দুটো লোক ।দুজনের মুখে সব অদ্ভুত সব রং আঁকা থাকত।একজনের মাথায় একটা বড় ট্রাঙ্কে ম্যাজিকের সমস্ত সরঞ্জাম থাকত ।নানান রকম হাতের কারসাজির ম্যাজিক দেখাত ওরা ।চারিদিকে খুব ভিড় জমে যেত ।এছাড়া দড়ির রোপ ট্রিক দেখতে যাযাবর ছেলে ও মেয়ের দল দড়ির উপর দিয়ে হাঁটত ,দড়ি বেয়ে ওঠা ,নানারকম ব্যালান্সের খেলা দেখাত ।এগুলো সবই আমাদের মজা ও আনন্দ দিত ।এত সামান্যতেই আমরা তখন এত খুশি হতাম ,যে আজকালকার ছেলেমেয়েরা সেগুলো বুঝবেই না ।পরবর্তী জীবনে অনেক বড় খেলাধূলা থেকেও এত নির্মল আনন্দ পাই নি ।দুপুরে চাবির  গোছা হাতে নিয়ে ঝনঝন শব্দ করে তালাচাবিওয়ালা ঘুরে বেড়াতো পাড়াময় ।অনেক মুশকিল করেছে অনেক বাড়ির ,যার মধ্যে আমার বাড়ির সদর দরজার তালা খোলা এক অন্যতম কাণ্ড ।


এইভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত । বিকেল থেকেই অনেক রাত পর্যন্ত চলত নানারকম মুখরোচক খাওয়ার ফেরিওয়ালাদের আনাগোনা । বিকেল গড়িয়ে গেলে প্রথমেই হাজির হত গ্যাসবেলুনওয়ালা ।গ্যাসের সিলিন্ডার সহ নানা রঙের বেলুনের ঝুলি নিয়ে । আমরা  সব দৌড়ে যেতাম । অনেকেই বেলুন কিনে সাবধানে সূতো হাতে পেঁচিয়ে বাড়ি নিয়ে আসত। ফস্কে গেলেই সে বেলুন কোন তেপান্তরে চলে যাবে,নাগাল পাওয়া মুশকিল ।গরম কালে এর পরেই হাজির হত ঠেলা গাড়ি করে বরফের গোলা বানানোর উপকরণ নিয়ে বরফওয়ালা ।একটি উঁচু কাঠের টেবিলের উপরে কাঠের ভুষির মধ্যে বরফের বড় বড় খন্ড থাকত ।আমরা দৌড়ে গেলেই ওটা একটু ধুয়েই উপরে রাখা একটা করাতের মত জিনিসের গায়ে ঘষে ঘষে বরফের গুড়ো বার করে গোল একটি কাঠির আগাতে গোলা তৈরি করে ফেলত । তারপরে আমাদের ইচ্ছানুসারে নানা রঙের সিরাপ দিয়ে গোলাকে রং করে দিত ।ওই বরফের গোলা খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা ।আইসক্রিম কোথায় লাগে ! আমার অবশ্য  বেশি খাওয়ার উপায় ছিল না ,কারণ গলায় ঠাণ্ডা লাগলেই টনসিল ফুলে গিয়ে এক কেলেঙ্কারি ।তখন বকুনি ,বাইরে যেতে মানা ইত্যাদি নিষেধ চাপত ।আইসক্রিম তো এল অনেক পরে ।ওই জলি চ্যাপ ,হ্যাপি বয় নামে কোম্পানির আইসক্রিম হাতে টানা ছোট ঠেলা গাড়িতে করে নিয়ে আসত ।তবে সেখান থেকেও রং বেরঙের কাঠি আইসক্রিম খাওয়া হত বেশি ।তবে বরফের গোলার মত ভালো লাগত না ।

দুপুরে অথবা বিকেলের দিকে হাজির হত আইকম বাইকম বায়োস্কোপওয়ালা । মাথায় করে একটি টিনের বড় বাক্স ।নামলেই ওই বাক্সের গায়ে দেখা যেত গোল গোল কতগুলো ফুটো ,সেখানে কাঁচ লাগানো ।সেখানে চোখ লাগিয়ে দেখলে ভিতরে অনেক রকমের সুন্দর সুন্দর ছবি দেখা যেত ।আমরা সবাই গোল হয়ে ওই বাক্সের ওই গোল ফুটোতে চোখ লাগালেই ওই লোকটি বাক্সের পাশে লাগানো একটি হাতল ঘুরিয়ে এবার ভিতরের চলমান দৃশ্যের বর্ণনা দিত। আম্ররা যেন রূপকথার রাজ্যে পৌঁছে যেতাম ।ঐটুকু সময়ে আমরা সবাই যেন এক এক খুদে কলম্বাস হয়ে যেতাম । বলতে ভুলে গেছি ,রথের মেলার সময়ে পাড়াতে এসে হাজির হত তালপাতার বাঁশি নিয়ে গ্রামের ফেরিওয়ালা ।সেই তালপাতার বাঁশি এখন আর দেখা যায় না ।তখন প্রায় সবাইয়ের বাড়িতে সেই বাঁশির প্যাঁ ,পোঁ আওয়াজে বাড়ির লোকের অস্বস্তি বাড়ত । এই বাঁশিওয়ালার কাছে থাকতো আরও দুটি জিনিস ।একটি মাটি আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো বেহালা ।ছড় দিয়ে ওরা দারুন সুরে সেই বেহালা বাজাত ।দামটা একটু বেশি থাকাতে  কিনতে পারতাম না ।কিন্তু যারা কিনত ,তারা কিন্তু ওঁদের মত বাজাতেই পারতো না ।ওটা বাজানোতে একটু অন্য কৌশল ছিল । এ ছাড়া ওর কাছে মাটির তৈরী গোল মত একটি বাটিতে উপরে লাগানো বেশ কিছু কাঠি এমনভাবে লাগানো থাকতো যে দড়ি দিয়ে টানলে সেটিতে চটপট করে বেশ মজাদার শব্দ হত।সবাই খুব হাততালি দিতাম আমরা ।

এ ছাড়া বিকেলের দিকে কাঁচের বাক্সের মধ্যে তিলের সব খাওয়ার সামগ্রী নিয়ে হাজির হতো  ফেরিওয়ালা হাতে ছোট ঘন্টা বাজাতে বাজাতে ।সেই বাক্স থেকে বার করে দিতো তিলকুট ,তিলের তক্তি , তিলের নাড়ু ,কদমা ইত্যাদি ।ওগুলো খেতে খুবই সুস্বাদু ছিল । কোনো কোনো দিন বিকেলেই এসে পড়ত একটি বাক্সে ঘুরন্ত চাকতির সাহায্যে একরকম গোলাপী রঙের শনের মতো এক গুচ্ছ খাওয়ার জিনিস । মুখে দিলেই গলে যেত। এর নাম আমরা দিয়েছিলাম বুড়ির চুল । ফেরিওয়ালা বলত , গোলাপী রেউড়ি । এ ছাড়া বাঁশের ডান্ডার মধ্যে জড়ানো একরকম রং বেরঙের চটচটে খাওয়ার জিনিস । লোকটির কাছে হাজির হলেই ,সেখান থেকে খানিকটা নিয়ে সেখান থেকে নানা রকমের জিনিস যেমন পাখা, টেবিল ,চেয়ার ,নৌকা বানিয়ে দিতো ।বেশ ভালো খেতে ছিল এবং অনেকটা চিটে গুড়ের মত।



একটু সন্ধ্যে হতে না হতেই টিনের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে হাজির হত ঘুগনিওয়ালা ।হাঁক পাড়তো ‘ঘুগনি ‘।আমরা ছোটরা যেন ওর অপেক্ষায় থাকতাম ।ভিড় করে দাঁড়াতাম চারপাশে ।বাক্সটা খুললেই  ঘুগনির অপূর্ব একটা গন্ধ নাকে আসত । ঘুগনির মধ্যে নারকোলের কুচি থাকত ।শালপাতাতে ঘুগনি দিয়ে শালপাতার চামচ বানিয়ে দিত।আমরা মহানন্দে চেটেপুটে খেতাম ।ঘুগনির  বাক্সে একটি গোল পাত্রে লাল রঙের ঝোলের মধ্যে ভাসমান আলুর দম থাকত ।খেতে খুবই ইচ্ছা করত কিন্তু পয়সাতে কুলোতো না ।কিন্তু যেদিন একটু বেশি পয়সা পেতাম সেদিন ওই আলুর দম খেয়ে যেন জীবন সার্থক হয়ে যেত ।ঘুগনি,আলুর দম ছাড়াও কয়েকটি সিদ্ধ ডিম্ ও মামলেটের টুকরো থাকতো বাক্সে ।ওতে কোনোদিন হাত ছোঁয়াতে পারি নি ।তবে আজও বলতে পারি বাড়িতে ঘুগনি তৈরি করে খেয়ে অথবা রেস্টুরেন্টে ঘুগনি খেয়েও ওই টিনের বাক্সের ঘুগনীর স্বাদ ভুলতে পারি নি ।
ঘুগনিওয়ালার সাথে অনেকদিন হাজির হত হরিদাসের বুলবুল  ভাজা ।হাতে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে সে নেচে নেচে বলতে থাকত ,

হরিদাসের বুলবুল  ভাজা
খেতে  ভারি মজাই মজা
ফুরিয়ে গেলে আর পাবে না
এ খাবার মজা কোথাও পাবে না ।
তেকোনা মোড়কে সেই হরিদাসের বুলবুল ভাজা এখনকার যে কোনো দামী চানাচুরের বিকল্প হতে পারত ।

একটু রাত হলেই গরমের দিনে উদাস সুরে ডাক শোনা যেত ‘কুলফি  মা লা ই বরফ ‘। মাথায় করে হাড়িতে নিয়ে আসত এই কুলফি মালাই বরফ  ।বরফের ভিতরে তেকোনা টিনের চোঙ্গায় এই কুলফি ভরা থাকত ।আমরা সবাই গোল হয়ে ঘিরে ধরতাম তাকে ।বরফের ভিতর থেকে ওই চোঙাগুলো বার করে ভালো করে হাতের মধ্যে ঝাঁকিয়ে নিয়ে উপরের মুখ খুলে শালপাতার মধ্যে খুলে দিত ভিতরের মালাই বরফ ।এলাচের গন্ধ দেওয়া সেই কুলফি মালাইয়ের সুবাস এখনো মনে হয় মুখে লেগে আছে । আর একটি জিনিস গরমের সময় পাওয়া যেত ।সেটি হচ্ছে ফুলওয়ালার হাঁক ।এই সময়ে বেল ফুল ও জুঁই ফুলের মালা নিয়ে ওরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতো ।বাড়ির মেয়েরা ,বৌয়েরা ওদের কাছ থেকে সেই সব ফুলের মালা কিনত। টাটকা ফুলের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত।

এখানেই শেষ করছি সেকালের পুরানো কলকাতার ফেরিওয়ালাদের কাহিনী । এদের বেশির ভাগ আর বর্তমানে নেই ।অনেকের ভেক বদলে গেছে ।তবু এরা পুরানো কলকাতার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে বর্তমান ছিল তখনকার দিনে ।এদের হাঁক ডাক নিয়ে কলকাতা বিশারদ রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মহাশয়ের একটি বই পর্যন্ত আছে ।শেষ করার আগে আমার প্রিয় কবি শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি কবিতা উপহার দিতে চাই :

পুরনো ছবি  

মই- ঘাড়ে সেই লোকটাকে আর দেখি না ।
বিকেলের আলো ফুরিয়ে যাবার
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে
আমাদের এই গলিতে এসে জ্বালিয়ে দিত
গ্যাসের বাতি ।

হাঁড়ি-মাথায়  সেই লোকটাও অনেককাল নিখোঁজ ।
রোগা  এই গলিটার  সমস্ত আবর্জনা যখন
গ্যাসের সবুজ আলোয় ডুবে গিয়ে
স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ,
ঠিক তখনই সে আমাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াত ।
তারপর
সক্কলের হাতে- হাতে একটা করে শালপাতা ধরিয়ে দিয়ে
তার উপরে
টিনের মোড়ক থেকে
আলতো হাতে নামিয়ে দিত
এলাচের -গন্ধে- ভুরভুর মালাই বরফ ।

ঝাঁক-হাতে সেই লোকটাই বা গেল কোথায় ?
ছাতের উপরে মাদুর বিছিয়ে
আমরা যখন পাশের-বাড়িতে-বাজতে -থাকা
কলের গান শুনতুম :
‘ফুটেছে  এত ফুল, ফুলমালি কই ‘,
তখন
অনেক দূর  থেকে সে তার মিহি গলায়
ডাক দিয়ে যেত : বে -ল  ফুল !

তাদের কাউকেই এখন দেখি না ।

কিন্তু তারা ফিরে এলেই যে
পুরনো কলকাতার
ছবিটাকে আবার ফেরত পাওয়া যেত ,
তাও নয় ।
ফেরত পাবার জন্যে আরও -একজনকে চাই ।
শহরের এই গলিঘুঁজির  মধ্যে
হঠাৎ কবে কোনখানে সে
হারিয়ে গেছে,
কেউ সে কথা বুঝতেই পারেনি ।

১০ শ্রাবণ ,১৩৮৮

হটাৎই  ছোটবেলার  আমাদের এই বহুদিনের পুরানো পাড়ার সেই ফেরিওয়ালাদের কথা মনে পড়ে যাওয়াতেই তাদের নিয়ে আমার এই স্মৃতিচারণা । জানি না ,এটা পড়ে তোমাদের মনে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা ! আসলে দক্ষিণ কলকাতা বা পূর্ব কলকাতার  ঝাঁ চকচকে আবহাওয়ায় যারা থাকেন তারা অনেকেই এই ধরণের ফেরিওয়ালাদের কথা ভাবতেই পারবে না ।আর এটাই পুরানো কলকাতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।


                        








x

No comments:

Post a Comment